ইসরায়েল শুধু ইরানের ওপর আক্রমণই করেনি, এটি ছিল ইহুদি রাষ্ট্রটির বড় সামরিক শক্তির প্রদর্শনও। কিন্তু ইরানের ওপর হামলার ইসরায়েলের সেই সামরিক শক্তি প্রদর্শন তুরস্কের নাগরিকদের হকচকিত করে।
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত ও দরিদ্র হলেও ইরান তুর্কিদের কাছে একটি স্থিতিশীল দেশ। তা ছাড়া ইরানিরা একটি মহৎ জাতি, যার রয়েছে প্রাচীন সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সাহিত্য সম্ভার। তুর্কিরা ইরানিদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা আধিপত্যের প্রতিরোধ এবং নিজেদের ধর্মীয় নেতৃত্বের ওপর আস্থার প্রতি সম্মান করে।
ইরাক বা লেবাননের ওপর হামলার তুলনায় ইরানের ওপর হামলার ঘটনা তুরস্কে ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া হয়। ইরানে হামলা চালিয়ে ইসরায়েল স্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছে যে তাদের আসলে অন্য আরও উদ্দেশ্য রয়েছে, যেমন বৃহত্তর ইসরায়েল গঠন এবং আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তার; ফলে তুরস্কের নাগরিকেরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে সেখানে তুরস্ক হতে পারে ইসরায়েলের পরবর্তী টার্গেট।
ইরানে হামলার পর তুর্কিদের রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে সবার প্রথম ও প্রধান উদ্বেগ তৈরি হয়েছে তুরস্কের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বর্তমান অবস্থা নিয়ে। ‘তুরস্কের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির কী অবস্থা?’, ‘আমাদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কি এফ-৩৫ শনাক্ত করতে পারবে?’—এই প্রশ্নগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে এসেছে। এসব প্রশ্ন ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ চলাকালে দৈনন্দিন আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান ২০২৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তৃতীয় মেয়াদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে আশা প্রকাশ করা যাচ্ছে। ধারণা করা যায় তিনি তুর্কি জনগণের এ প্রশ্নগুলোর উত্তর ভালোভাবে দিতেই প্রস্তুত আছেন। তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের বিষয়ে তিনি ইতিমধ্যে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন।
ইস্তাম্বুলের সাবেক মেয়র একরেম ইমামোগ্লুর দুর্নীতি মামলায় গ্রেপ্তার (যাকে বিরোধীরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করে) এবং অর্থনৈতিক সংকটের বাইরে এরদোয়ান আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে যেখানে নিজের সাফল্য দেখাতে পারেন, তা হলো নিজস্ব প্রতিরক্ষা শিল্পের বিকাশ।
সামনের নির্বাচনে তাঁর চ্যালেঞ্জ হবে তুরস্কের সামরিক শক্তি এবং এর নিজস্ব প্রতিরক্ষা শিল্পের সক্ষমতা সম্পর্কে জনসাধারণকে বোঝানো। প্রতিরক্ষা শিল্পের পরিসর আরও বাড়ানোর জন্য অতিরিক্ত কর আরোপ করে তিনি তুর্কি জনগণের কাছে আর্থিক ত্যাগের জন্য অনুরোধ জানাতে পারেন। এ ধরনের একটি নির্বাচনী প্রচারণার কৌশল তুরস্কের তরুণ প্রজন্মের কাছেও গ্রহণযোগ্য হতে পারে।
প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে পুনরায় নির্বাচনী প্রচারাভিযানে নামার ক্ষেত্রে এরদোয়ান ইসরায়েল ও তুরস্কের তুলনামূলক প্রতিরক্ষাবিষয়ক অর্জনগুলোর ওপর জোর দিতে পারেন। ২০২৩ সালে নির্বাচনের আগে তিনি তুর্কি নৌবাহিনীর ফ্ল্যাগশিপ টিসিজি আনাদলু সামনে এনেছিলেন। জাহাজটিতে সাধারণ তুর্কি নাগরিকদের ওঠার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, মানুষ সেটির বিশালতা নিয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। নির্বাচনের মাত্র ৩৪ দিন আগে জাহাজটি সামরিক শক্তিতে যোগ করা হয়।
ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধের কারণে তুরস্কের তৈরি আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও ক্ষেপণাস্ত্রের সক্ষমতার প্রতি তুর্কি নাগরিকদের মনোযোগ আরও বেশি থাকবে। এরদোয়ানও নির্বাচনী প্রচারণার সময় এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট উত্তর দিতে ভালোভাবে প্রস্তুত হচ্ছেন। তুর্কিদের সংখ্যাগরিষ্ঠদের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ বিরোধীদের তুলনায় এরদোয়ানকে স্থিতিশীল তুরস্কের শক্তি হিসেবে দেখে। ক্রমবর্ধমান অস্থির হয়ে উঠা এ অঞ্চলে দেশ পরিচালনার জন্য বিরোধীদের মধ্যে প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা ও সংকল্পের অভাব রয়েছে বলে তারা মনে করে।
টিসিজি আনাদলু জাহাজ সংযোজন তুর্কি সামরিক বাহিনীর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে মনে করা হয়ে থাকে। এটি এক ব্যাটালিয়নের একটি বাহিনী পরিবহন এবং আটটি নৌযান বহন করতে সক্ষম ও বিমান পরিচালনাও করা সম্ভব এ জাহাজ থেকে। সহায়ক সামরিক সম্পদে অত্যাধুনিক ড্রোনের চেয়েও বড় কিছু দাবি করা হয়ে থাকে এ জাহাজকে।
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ নিয়ে এরদোয়ানের প্রতিক্রিয়া ছিল লক্ষণীয়ভাবে সংযত ও গঠনমূলক। তিনি ট্রাম্পের সঙ্গে একটি আলাদা যোগাযোগের চ্যানেল খোলার চেষ্টা করেছিলেন, যার মধ্য দিয়ে ইস্তাম্বুলে একটি মার্কিন-ইরান বৈঠক করা যায়। যুদ্ধকালীন এরদোয়ানের মন্তব্যগুলো আগের মতো আক্রমণাত্মকও ছিল না।
সামনের নির্বাচনে তাঁর চ্যালেঞ্জ হবে তুরস্কের সামরিক শক্তি এবং এর নিজস্ব প্রতিরক্ষা শিল্পের সক্ষমতা সম্পর্কে জনসাধারণকে বোঝানো। প্রতিরক্ষা শিল্পের পরিসর আরও বাড়ানোর জন্য অতিরিক্ত কর আরোপ করে তিনি তুর্কি জনগণের কাছে আর্থিক ত্যাগের জন্য অনুরোধ জানাতে পারেন। এ ধরনের একটি নির্বাচনী প্রচারণার কৌশল তুরস্কের তরুণ প্রজন্মের কাছেও গ্রহণযোগ্য হতে পারে।
অনেক বিশ্লেষক যা মনে করেন, তাঁর বিপরীতে তুর্কি তরুণদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দেশের প্রতিরক্ষা শিল্পের উন্নয়ন ও এর পেছনে ব্যয়ের বিষয়টি নিবিড়ভাবে অনুসরণ করে। তারা তুরস্কের নির্মিত যুদ্ধবিমানগুলো সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখে এবং এগুলো তৈরির তাৎপর্য বোঝে। ফলে তুরস্কের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার শিল্পকে নির্বাচনী প্রচারণার প্রধান কৌশল হিসেবে নিলে এরদোয়ানের জন্য ভালো ফল দেবে।
ইলকার সেজার তুর্কি টুডে-এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক
তুর্কি টুডে থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ
সূত্র, প্রথম আলো