গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সংজ্ঞা ছিল একতরফাভাবে সংজ্ঞায়িত। এই দীর্ঘ সময়ে সরকার তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য বিরোধী দল, নাগরিক সমাজ, আলেম সমাজ এবং মুসলিম সংস্কৃতির প্রতীকগুলোকে ‘সন্ত্রাসবাদ’, ‘জঙ্গিবাদ’, কিংবা ‘রাজাকার’ তকমা দিয়ে দমন করেছে। এমনকি একজন হিন্দু তরুণকে হত্যা করা হয়েছে ‘শিবির’ ট্যাগ দিয়ে। স্বাধীনতার ঘোষক ও সেক্টর কমান্ডার শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে বলা হয়েছে ‘রাজাকার’।
শাহবাগকেন্দ্রিক জেনোফোবিক ও উগ্রবাদী বাম অংশকে রাষ্ট্রীয় বন্ধু হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে জনগণের প্রধান অংশকে রাজনৈতিকভাবে অপরাধী করে তোলা হয়েছিল। এই প্রক্রিয়ায় যে নিরাপত্তাহীনতা, বিচারহীনতা ও অনাচার তৈরি হয়েছিল, তা-ই মূলত দেশে একের পর এক রাজনৈতিক গণহত্যা, অজস্র মানুষকে গুম, লাখ লাখ মানুষকে গ্রেপ্তার এবং বিরোধী দলের নেতাদের বিচারিক হত্যাকাণ্ডের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত করেছিল ফ্যাসিবাদ।
কিন্তু ফ্যাসিবাদের পতনের এক বছর পরে এসেও জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে নতুন কোনো নীতি প্রণয়ন করা কিংবা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা লক্ষণীয় নয়, যা নিঃসন্দেহে আশঙ্কাজনক। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল জেমস ম্যাট্টিসেন কথা প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, ‘ইউ ক্যান নট সিকিউর এ নেশন থ্রো ফোর্স এলোন। ইট টেকস ফোরসাইট, ইউনিটি অ্যান্ড আন্ডারস্ট্যান্ডিং অব ইয়োর ভালনারেবিলিটিজ।’ অর্থাৎ ‘শুধু শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে তুমি একটি জাতিকে সুরক্ষিত করতে পারবে না। এর জন্য প্রয়োজন দূরদর্শিতা, ঐক্য এবং নিজের দুর্বলতা সম্পর্কে সঠিক বোধগম্যতা।’
গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশকে কেন্দ্র ক্ষমতাচ্যুত ও কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের সাম্প্রতিক হামলা পুরো জাতিকে একটি জোরালো বার্তা দিয়েছে। এই হামলা কোনো বিচ্ছিন্ন অপকর্ম নয়, বরং এটি সুসংগঠিত, পূর্বপরিকল্পিত ও বহুমাত্রিক হুমকির বহিঃপ্রকাশ, যা পরে ভারতে পালিয়ে থাকা স্বৈরাচারী হাসিনার অডিও ফাঁস থেকে নিশ্চিত হয়েছে। এ ঘটনা দেখিয়ে দিয়েছে শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তন দিয়ে রাষ্ট্রকে নিরাপদ করা যায় না, বরং রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি স্তরকে পুনর্গঠন ও নতুন নীতিগত ভিত্তিতে স্থাপন করতে না পারলে এই পরিবর্তন হবে অস্থায়ী।
বর্তমানে বাংলাদেশে কোনো পূর্ণাঙ্গ, রাষ্ট্রীয়ভাবে গৃহীত অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নীতি নেই। ফলে বাহিনীগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা, সিদ্ধান্তহীনতা ও বিভ্রান্তি প্রায়ই দেখা যায়। প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীর একাংশ এখনো ক্ষমতাচ্যুত দলটির প্রতি অনুগত, উচ্চপর্যায়ের অনেক কর্মকর্তা পতিত স্বৈরাচার ও বর্তমান সরকারের দ্বৈত আনুগত্য বজায় রাখছেন, যা নীতি বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। প্রশাসনের এই অবস্থা দেশে কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া দল আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতাকে সক্রিয় রাখছে।
অন্যদিকে সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় জঙ্গিবাদের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে ৩৫ বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকজনকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। অন্যদিকে, তিনজন পরিচিত ইসলামিক অ্যাকটিভিস্টকে কোনো পূর্বাপর ব্যাখ্যা ও নীতিমালা ছাড়াই জঙ্গি মামলায় পলাতক দেখানো হয়েছে, যা সমাজের একটি অংশকে ক্ষুব্ধ করেছে। অন্যদিকে সচেতন মহলে প্রশ্ন উঠেছে সরকারের নতুন নিরাপত্তা নীতি নিয়ে।
আরো উদ্বেগজনক দিক হলো, দেশের সীমান্ত অঞ্চলে এবং নগরকেন্দ্রিক অনেক এলাকায় পতিত ফ্যাসিবাদের পুনঃসক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে। ছাত্র ও যুবলীগের অস্ত্রধারীরা বিভিন্ন এলাকায় রাজনৈতিক দলগুলোর ঘাড়ে সওয়ার হয়ে ফের আধিপত্য সৃষ্টির চেষ্টা করছে। তারা প্রশাসনিক দুর্বলতা ও রাজনৈতিক অচলাবস্থার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে। যার ফল আমরা দেখতে পাচ্ছি এক বছরে দলীয় অন্তঃকোন্দলে প্রায় ৮০ জন নিহত হয়েছে।
একই সঙ্গে অর্থনৈতিক মাফিয়া চক্র যারা বিগত সময়ে ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত ছিল, তারা নতুন রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ব্যর্থ করার জন্য পরিকল্পিতভাবে কাজ করে যাচ্ছে। শঙ্কার বিষয় হলো, তাদের অনেকের অর্থ ও প্রভাব এখনো অপ্রতিহত। সরকার বেশ কিছু ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ বা ফ্রিজ করলেও তার পরিমাণ খুব বেশি নয়।
অন্যদিকে নিরাপত্তার প্রশ্নে বাইরের চ্যালেঞ্জও উপেক্ষা করা যাবে না। ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল। তারা দীর্ঘদিন রাজধানী ঢাকায় ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রভাবশালীদের ব্যবহার করে এদেশে এক ধরনের ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল। এখনো তাদের সেই কৌশল অনুসরণ করছে বলে বিশ্লেষকদের আশঙ্কা। গোপালগঞ্জ, যশোর, দিনাজপুর, খুলনাসহ বিভিন্ন সীমান্ত এলাকাকে ভারতের নীতিনির্ধারকরা ‘ভারতবান্ধব নিরাপদ জোন’ হিসেবে ধরে রাখতে চায়। ভারত বাংলাদেশের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি ও আঞ্চলিক স্বাবলম্বিতাকে ‘বিপদ’ হিসেবে দেখছে। তাদের দৃষ্টিতে, জুলাই গণঅভ্যুত্থান একটি আঞ্চলিক হুমকি, যা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের আধিপত্যবাদকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে।
ফলে ভারত এদেশে তাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মদতপুষ্ট গোষ্ঠীগুলোকে নানাভাবে পুনর্বাসনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। এছাড়া পুরো ভারত ও বিভিন্ন দেশে থাকা ভারতীয়রা ২৪-এর জুলাই-পরবর্তী ধর্মীয় উসকানিমূলক নানা গুজব ছড়ানো থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশকে বিশ্বমঞ্চে ঝামেলায় ফেলার নানামুখী অপচেষ্টা করে যাচ্ছে। এরপরও দেশের বিভিন্ন সংবেদনশীল পদে ভারতীয় অফিসাররা কাজ করছেন বলে নানা সময়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, যা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি।
এর বাইরে আছে ‘হাইব্রিড হুমকি’, বিশেষ করে পাহাড়ের বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভ্রান্তি, গুজব ছড়ানো ও অপপ্রচার উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সাহায্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বট অ্যাকাউন্ট খুলে নানা ধরনের উসকানি ও গুজবের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করা হচ্ছে। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে গণভিত্তিকে দুর্বল করার চেষ্টা বর্তমানে সবচেয়ে মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখা দিচ্ছে। যার বিরুদ্ধে সরকারের তথ্য বিভাগ যথাযথ ভূমিকা নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
এই জটিল বাস্তবতায় বাংলাদেশের জন্য এখন অবিলম্বে একটি সমন্বিত জাতীয় নিরাপত্তা নীতি প্রয়োজন। এই নীতিতে শুধু বাহিনীগুলোর ভবিষ্যৎ কৌশলগত রূপরেখা থাকবে না, থাকবে নিরাপত্তা ইস্যুতে একটি নতুন রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গীকার। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ঘোষিতব্য জুলাই চার্টারে নতুন নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট নীতিগুলোকেও একীভূত করতে হবে, যা ভবিষ্যতের জন্য দিকনির্দেশনা হয়ে থাকবে বলে আশা করা যায়।
একটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নীতি তৈরি হয় রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা ও জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে, যা অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক হুমকি, রাজনৈতিক এবং সামাজিক বাস্তবতা, ভূরাজনৈতিক অবস্থান, অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা বিবেচনা করে রচিত হয়। এই নীতি রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ, সীমান্ত রক্ষা, সন্ত্রাস ও উগ্রবাদের প্রতিরোধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা, সাইবার ও তথ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আঞ্চলিক শক্তির গতিপথ বিশ্লেষণ করে নিরাপত্তার কৌশল নির্ধারণ করে। সুনির্দিষ্টভাবে, একটি কার্যকর নিরাপত্তা নীতি সরকার, সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশসহ অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী এবং জনগণের মধ্যে সমন্বয় প্রতিষ্ঠা করে, যাতে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত হয়।
এই নিরাপত্তা নীতি থাকলে লাভ কী হবে? যেমন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, স্থিতিশলতা ও নিরাপত্তার জন্য কারা সম্ভাব্য হুমকি হতে পারে, তার একটি পরিচ্ছন্ন ধারণা তৈরি হবে, বাহিনীগুলোর সময় উপযোগী বা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে দ্রুত কৌশল ডিজাইন করতে পারবে। গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ ও জনগণের মধ্যেও দীর্ঘ মেয়াদে দেশের নিরাপত্তা নিয়ে সামগ্রিক এবং বাস্তবসম্মত বোঝাপড়া তৈরি হবে।
এছাড়া নিরাপত্তা কাঠামোকে কার্যকর করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বেসামরিক, সামরিক ও গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি স্বতন্ত্র এবং উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন সংস্থা গঠন করা যেতে পারে, যার নাম হতে পারে ‘ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি (এনএসএ)। এই সংস্থা দেশের প্রতিটি নিরাপত্তা হুমকিকে একটি ‘জাতীয় অগ্রাধিকার সূচক’-এর মাধ্যমে বিশ্লেষণ করবে, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অষণ্ডতা, মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রকে একসঙ্গে রক্ষা করার কৌশল নির্ধারণ করবে। এর বাইরেও পররাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে এই সংস্থা দেশের জন্য প্রয়োজনীয় সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় ও নতুন প্রতিরক্ষা নীতি তৈরির প্রস্তাবনা দিতে পারে। এ ছাড়া কাঠামোগত সংস্কারের পাশাপাশি সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে মানসিক সংস্কার, বিশেষ করে নিরাপত্তা বাহিনীর ভেতরে। রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত ও ফ্যাসিবাদী মানসিকতার বাহিনী দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা সম্ভব নয়।