বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী নায়কের মেয়ে শেখ হাসিনা। তিনি বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। নবীন এই দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পেছনেও তার অবদান কম নেই। তবে কর্তৃত্বপরায়ণতার অভিযোগে এই নেত্রী ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। পদত্যাগ করার আগ পর্যন্ত তার নামের সামনে বহু ধরনের বিশেষণ ব্যবহার করা হতো। তবে পদত্যাগ করার পর তার নামের সামনে বসানো সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা শব্দটি হলো ‘স্বৈরাচার’। এ যেন স্বর্গ থেকে নক্ষত্রের পতন।
১৫ বছর ক্ষমতাসীন ছিলেন তিনি। ২০২৪-এর জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তার চতুর্থ মেয়াদ শুরু হয়। এর আগেও ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব তিনি পালন করেন। যদিও ৭৬ বছর বয়সি এই ‘লৌহ মানবী’ পদত্যাগের পর হেলিকপ্টারে করে প্রতিবেশী ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহার্য জিনিসপত্র গোছানোরও ফুরসত পাননি। পুলিশপ্রধান তাকে সতর্ক করে জানান, লাখো বিক্ষোভকারী তার বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে চলা ছাত্র বিক্ষোভে পুলিশ যে নৃশংসতা দেখিয়েছে, তার প্রতিশোধ নিতে মুখিয়ে আছে বিক্ষোভকারীরা। ওই ছাত্র বিক্ষোভে ৪০০-এরও বেশি মানুষ নিহত হয়।
পদত্যাগের বক্তব্য লেখারও সময় পাননি তিনি। সহিংসতার আগুনে পুড়তে থাকা শহরে কেউ তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। তার পালিয়ে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর বাংলাদেশের সেনাপ্রধান ঘোষণা করেন, তিনি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন প্রক্রিয়ার ওপর নজর রাখবেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে সেনাবাহিনী ক্ষমতায় থাক বা না থাক, তাদের একটা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব সব সময়ই ছিল। জেনারেলরা ঠিক কীভাবে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছেন, সে ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। এবার তারা কার্যত আবার ক্ষমতায় এলো। যদিও সম্ভাব্য সব উপায়ে তারা দেখাতে চাইছে, তারা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় ফেরেনি।
ভূরাজনৈতিক অসংগতি
সাবেক পূর্ববাংলায় একটি নিয়মিত ঘটনা ছিল রাজনৈতিক সহিংসতা। বাঙালিদের দেশটিকে (বাংলাদেশ) যন্ত্রণাদায়কভাবে ১৯৭১ সালে টেনে আনা হয়। এরপর দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে হয় এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশ সমাপ্তির পর ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি দেশের জন্ম হয়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের এলাকাগুলো নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস্তান। দেশটির জন্মই হয় ভূরাজনৈতিক অসংগতি নিয়ে—বিভক্ত একটি দেশ। পশ্চিম অংশের রাজধানী করাচি আর পূর্বাংশে বাঙালিদের ভূখণ্ডটির রাজধানী ঢাকা। আর মাঝ বরাবর পুরো ভারত। ভারতের দুই পাশে দুই খণ্ড পাকিস্তানের ভাষা, সংস্কৃতি পুরোপুরি ভিন্ন। শুধু ধর্মকে দিয়ে একটি রাষ্ট্রকে ঐক্যবদ্ধ রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল।
এই বৈপরীত্য স্থায়ী হয়নি। বাঙালিরা খুব দ্রুতই বুঝতে পারে পশ্চিম পাকিস্তান তাদের ওপর আধিপত্য করছে। সব ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু ছিল পশ্চিম পাকিস্তান। এ সময় ভারতের সহায়তায় একটি অসহযোগ আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই আন্দোলনই চূড়ান্ত পরিণতি পায় ১৯৭১ সালে। স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল সব স্তরের মানুষ—স্বাধীনতার সমর্থক, চরমপন্থি এবং সামরিক শাসক গোষ্ঠীর পুলিশ বাহিনী—সবার অবদান আছে বাংলাদেশের স্বাধীনতায়। এরপর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ১৩ দিনের ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সহযোগিতা শেষে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি বাহিনী। পূর্ব পাকিস্তান হয় বাংলাদেশ। শেখ হাসিনার বাবা শেখ মুজিবুর রহমান হন দেশের প্রথম নেতা। তবে স্বাধীনতার পর মুধুচন্দ্রিমার কাল খুব একটা দীর্ঘ হয়নি। মাত্র চার বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্যের অভিযানে নিহত হন শেখ মুজিব। তার পরিবারের ১৫ সদস্য ওই রাতে প্রাণ হারান। তার দুই মেয়ে—হাসিনা ও রেহানা জার্মানিতে থাকার কারণে বেঁচে যান। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে কর্তৃত্বপরায়ণতা, বিরোধীদের কণ্ঠরোধ, গুম, দেশকে একদলীয় ব্যবস্থায় পরিণত করার অভিযোগ ছিল।
এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড হাসিনাকে তীব্রভাবে নাড়া নেয়। পরে ১৯৯৬ সালে তিনি দেশটির প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। আগে-পরে ক্ষমতায় থাকাকালে প্রায় সব সময় তিনি তার বাবার ঘটনাকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। লা মঁদকে তার পারিবারিক বাসভবনে এক সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় শেখ হাসিনা লাইব্রেরির বইয়েও ঘাতকদের বুলেটের আঘাতের চিহ্ন দেখান। দেয়ালে ঝোলানো ছিল নিহতদের ছবি। নিহতদের রক্তের দাগগুলো কাচ দিয়ে ঢেকে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এসব কিছুই ওই বাড়িতে একটা ভিন্ন আবহ তৈরি করে।
ধারাবাহিক অভ্যুত্থান
৪৯ বছর বয়সে দেশের গণতন্ত্র মুক্তির লড়াইয়ে যোগ দেন শেখ হাসিনা। এর ১৪ বছর আগে দীর্ঘ নির্বাসন শেষে দেশে ফেরেন তিনি।
১৯৭৫-১৯৯০ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে নানা মাত্রার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যায় বাংলাদেশ। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে তিন মাসের আন্দোলনের পর পতন হয় জেনারেল মুহম্মদ এরশাদের এই আন্দোলনে হাসিনাই মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। এরশাদ ১৯৮৩ সালে দেশের রাষ্ট্রপতি হন। এরপরের কয়েক দশক গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারই বাংলাদেশ পরিচালনা করে। ক্ষমতায় আসেন মূলত হাসিনা এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়া।
সম্প্রতি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী তার নিজ দোষেই চেয়ার ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে কর্তৃত্বপরায়ণতা, অত্যধিক নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ও স্বজন তোষণের অভিযোগ ছিল। এসব অভিযোগের ক্ষেত্রে তার অবস্থান হুবহু তার বাবার মতোই। আর এই বাস্তবতাই ক্ষুব্ধ করে তোলে সাধারণ মানুষকে। দেশজুড়ে নির্মিত শেখ মুজিবের ভাস্কর্য হাসিনার পদত্যাগের পর ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। ১৯৭১-এর যুদ্ধে স্বাধীনতা লাভ, ১৯৯০-এর গণআন্দোলনের পর ২০২৪ সালের এই বিপ্লব এশিয়ার বংশানুক্রমিক রাজনীতির একটি শক্ত পিলারকে গুঁড়িয়ে দিল।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে গত বছরের ৬ আগস্ট মঙ্গলবার নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। একে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছে। এখন দেশের এই নতুন কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব হবে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হওয়া।
ফ্রান্সের বিখ্যাত দৈনিক লা মঁদে প্রতিবেদনটি
প্রকাশিত হয় ৭ আগস্ট