বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর যে পরিমাণ সমালোচনা করেছিল ব্যাংক খাত নিয়ে, যে পরিমাণ আশার বাণী শুনিয়েছিল, বাস্তবে হচ্ছে ঠিক যেন তার উল্টো। বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের পথেই হাঁটছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কারণ তারা ক্ষমতায় এসেই লোন প্রভিশনিং নিয়ে বিআরপিডি সার্কুলার ১৫ জারি করে। আর এ কারণে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের সময়ের শেষ পাঁচ বছরে যে পরিমাণ লোন প্রভিশনিং এবং লোন রিশিডিউল নিয়ে পরিপত্র ও সার্কুলার জারি করা হয়েছে, আওয়ামী সরকারের পুরো শাসনামলেও তা করা হয়নি। বিগত সরকারের শেষ সময়ে এসে যত সার্কুলার ও পরিপত্র জারি করা হয়েছে, তার পুরোটাই রাজনৈতিক বিবেচনায়, যা ব্যাংক খাতগুলোকে আরো বেশি ধ্বংসের দিকে নিয়ে গেছে। একজন ব্যবসায়ী যখন রাজনীতিবিদ হন এবং নীতিনির্ধারণে প্রভাব বিস্তার করতে পারেন, তখন তার মধ্যে এক ধরনের প্রভুত্বমূলক আচরণ লক্ষ করা যায়। বিগত সরকারের সময়ে বিশেষ করে জুনের শেষ সপ্তাহ এবং ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে যে পরিমাণ পরিপত্র জারি করে ব্যবসায়ীদের ফায়দা দেওয়া হয়েছে, তা কখনোই কোনো সরকারের সময় দেওয়া হয়নি।
বর্তমান সরকারের সময় লোন প্রভিশনিং ও রিশিডিউলিং করার জন্য তিন-তিনটি পরিপত্র ও সার্কুলার জারি করা হয় ব্যাংক খাতকে স্বস্তি দেওয়ার জন্য। সর্বশেষ এ বছর ১৬ সেপ্টেম্বর বিআরপিডির এক সার্কুলার মাধ্যমে বলা হয়, দুই শতাংশ জামানতে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করা যাবে। এর উদ্দেশ্য হলো ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ব্যবসা করতে গিয়ে সমস্যায় পড়েছে বা মার্কিন ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এমন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু ও চাঙ্গা করা। সার্কুলারে বলা হয়, দুই শতাংশ নগদ অর্থ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ পাবে, ওই ঋণটি পরিশোধের জন্য ১০ বছর সময় দেওয়া হবে এবং ঋণটি পরিশোধের জন্য আরো দুই বছর গ্রেস পিরিয়ড বা ঋণ পরিশোধে বিরতি সুবিধা পাবেন। যারাই সুবিধা নিতে চান তারা ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে আবেদন করবেন।
এখানে দুটি বিষয় সমালোচনা করতেই হয়—এক. ডলারের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এমন ব্যবসায়ী, অর্থাৎ আমদানি ও রপ্তানিকারকের জন্যই বিশেষ সুবিধা; কিন্তু ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পায় ২০২২ সাল থেকে এবং সরকার পতন হয় ২০২৪ সালের আগস্টে। দ্বিতীয় যে বিষয়টি তা হলো বিগত সরকারের সময়ে জামায়াত বা বিএনপিপন্থি ব্যবসায়ীরা কতটুকুই বা ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পেরেছেন? সুতরাং এর সুবিধাটা কার জন্য দেওয়া হলো এবং এর ভবিষ্যৎই বা কী?
এবারের সার্কুলারে যা পরিবর্তন এসেছে তা হলো, ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণ পুনঃতফসিলের আবেদন পাওয়ার পর ছয় মাসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে তা নিষ্পত্তি করতে হবে। ঋণ পুনঃতফসিলের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। আবার কেউ যদি এককালীন বা অ্যামিকেবল সেটেলমেন্ট করে, তাহলে আরো এক বছর সময় পাবে।
এখানেও দুটি বিষয় সামনে আসে—এক. কেউ যদি মনে করেন দুই শতাংশ নগদ অর্থ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করবেন, তাহলে তিনি করতে পারবেন। এর জন্য সবমিলিয়ে তিনি ১২ বছর সময় পাচ্ছেন। কিন্তু এর ভবিষ্যৎটা কী, এর আগে ২০১৯ সালের ১৬ মে একই ধরনের সুবিধা দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক, যা বিআরপিডি সার্কুলার ০৫। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, অ্যামিকেবল সেটেলমেন্ট বা এককালীন ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে এক বছর সময় দেওয়া হবে। অর্থাৎ এখানে ঋণগ্রহীতার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি, যা ব্যাংকের কাছে মর্টগেজ ছিল, তা মুক্ত করে দেওয়া হলো। এখন ঋণগ্রহীতা হয়তো ঋণটি পূর্ণ পরিশোধ করে দেবেন, যা ব্যাংকে কখনোই খেলাপি হিসেবে ফিরে আসবে না।
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, পূর্বের অভিজ্ঞতা যেহেতু ভালো নয়, তাই বর্তমান অভিজ্ঞতা সুখকর নাও হতে পারে।
লেখক : ব্যাংকার