রাজনীতিতে ব্যক্তি অর্চনা বা ব্যক্তিপূজা নতুন কোনো ঘটনা নয়। বহু বছর ধরে নানা দেশে রাজনীতিতে নানাভাবে ব্যক্তিপূজা চলে আসছে, যা শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিকে দেবতার পর্যায়ে নিয়ে যায়। মধ্যযুগের রাজতন্ত্র থেকে শুরু করে আধুনিককালের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ও বাংলাদেশসহ নানা দেশে ব্যক্তিপূজা লক্ষ করা গেছে বারবার। যাকে বলা হয় কাল্টইজম বা পার্সোনালিটি কালট অর্থাৎ ব্যক্তিত্বের পূজা কিংবা ব্যক্তিত্বের সংস্কৃতি। এটি হচ্ছে একজন নেতাকে কেন্দ্র করে এমন একটি সম্প্রদায় গড়ে তোলা, যেখানে প্রশ্নাতীত তোষামোদ ও প্রশংসার মাধ্যমে নেতার বীরত্বপূর্ণ গৌরবগাথা উপস্থাপন করা হয়।
প্রথমে ধর্মীয় অন্ধত্ব থেকে এই ব্যক্তিপূজার বিষয়টি উৎসারিত হলেও পরে রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ ঘটেছে। মধ্যযুগ রাজাদের ঐশ্বরিক শক্তিতে বলীয়ান হিসেবে ভাবা হতো। রোমান সম্রাটরা এভাবেই নিজেদের উপস্থাপন করতেন। কিন্তু ইউরোপে গণতন্ত্র ও মানবিক রাষ্ট্রগঠনের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় রোমান সম্রাটদের ব্যক্তিপূজার বিষয়টি বেশিদূর এগোতে পারেনি। কারণ ব্যক্তিপূজা মূলত একনায়কতন্ত্রের মধ্য দিয়ে উত্থান ঘটে থাকে, যেটা তখন ইউরোপ পরিত্যাগ করা শুরু করেছে। কিন্তু বিশ্বের নানা দেশে একবিংশ শতাব্দীতেও আমরা ব্যক্তিপূজা দেখতে পাচ্ছি। যেমন : শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনকাল নিশ্চয়ই ইতিহাসে উল্লেখ থাকবে, যেখানে তিনি নিজেকে এবং তার বাবা শেখ মুজিবুর রহমানকে পূজনীয় করে তোলার চেষ্টা করেছেন নানাভাবে।
উইকিপিডিয়ায় বিভিন্ন দেশের যেসব কর্তৃত্ববাদী নেতাদের ব্যক্তিত্বের পূজা কিংবা ব্যক্তিত্বের সংস্কৃতির কাহিনি উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে লিপিবদ্ধ বিশাল একটি তালিকায় শেখ মুজিবুর রহমানের নামও রয়েছে। এই তালিকায় বাকিদের মধ্যে রয়েছেন, ইতালির বেনিতো মুসোলিনি, জার্মানির হিটলার, আর্জেন্টিনার একনায়ক জুয়ান পেরন, আজারবাইজানের স্বৈরশাসক হায়দার আলিয়েভ, হাইতির ফ্রাঁসোয়া দুভেলিয়ার, হাঙ্গেরির নিক্লোস হোর্থি, ফিলিপাইনের মার্কোসের পাশাপাশি কমিউনিস্ট বিশ্বের লেনিন, স্টালিন, চীনের মাও সেতুং, উত্তর কোরিয়ার কিম ইল সুং প্রমুখের নাম।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মার্ক্সবাদ, লেলিনবাদের মতো মুজিববাদ তত্ত্ব উপস্থাপন করা হয়, যার ভিত্তিতে শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্বের পূজা শুরু করা হয়, যেখানে বলা হতো—‘এক নেতা এক দেশ/বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’। আইনের শাসন বলতে বলা হতো শেখ মুজিবুর রহমানের আদেশই আইন। শেখ মনি এক সমাবেশে এভাবেই বলেছিলেন—কীসের আইনের শাসন বঙ্গবন্ধুর কথাই আইন। এই প্রক্রিয়া শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রের কবর রচনা করে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়। তখন পরিকল্পনা ছিল শেখ মুজিবুর রহমানকে আজীবন রাষ্ট্রপতি করা। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার রাজত্বের অকাল সমাপ্তির পর সে স্বপ্ন আর বাস্তবায়িত হয়নি। পরে শেখ হাসিনা বাবার ব্যক্তিত্বের পূজার জন্য এমন একটি সঙ্ঘবদ্ধ সম্প্রদায় গড়ে তোলেন, যারা চিন্তাভাবনায় বেপরোয়া ও মারমুখী। তারা বিরোধী মতকে স্তব্ধ করতে যেকোনো পন্থা অবলম্বন করতে দ্বিধা করে না।
কাল্টইজম বা ব্যক্তিত্বের অর্চনার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ওই ধরনের সম্প্রদায়ের সদস্যরা প্রশ্নাতীত আনুগত্য দ্বারা পরিচালিত হয়। তা ছাড়া কাল্টইজমের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সব সত্য ঘটনা ও বাস্তবতাকে অস্বীকার করে এমন একটি রাজনৈতিক ন্যারেটিভ তৈরি করা, যা দলের নেতাকর্মীরা অন্ধের মতো বিশ্বাস করেন। তারপর ছড়িয়ে দেওয়া হয় মিথ্যা তথ্য ও ষড়যন্ত্রতত্ত্ব রূপে।
এই রাজনৈতিক সম্প্রদায় এমনভাবে কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠে, দলের নেতারা ক্ষমতায় যাওয়া ও রাষ্ট্রের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে যেকোনো উগ্রপন্থা অবলম্বন করতে দ্বিধা করে না। রাষ্ট্রের ওপর কঠিন নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য প্রতিবাদী সব কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়। সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয় মিডিয়ার ওপর। বিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শ নিস্তব্ধ করতে শক্তি প্রয়োগের পথ বেছে নেওয়া নয়। যেটি আমরা দেখেছি শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে।
পৃথিবীর সব ফ্যাসিস্ট সরকারের বৈশিষ্ট্য প্রায় একই ধরনের। ব্যক্তিত্বের পূজাও একই ধরনের। যেমন : আর্জেন্টিনার একনায়ক জুয়ান পেরনের শাসনের সঙ্গে শেখ হাসিনার শাসনকালের অদ্ভুত মিল খুঁজে পাওয়া যায়, যা আমাদের অবাক করে দেয়। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, জুয়ান পেরন ভিন্নমত পোষণকারীদের এবং সম্ভাব্য রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর তীব্র নির্যাতন চালাতেন। ক্ষমতায় থাকার জন্য তিনি দেশের প্রজাতন্ত্রের নীতিগুলো ধ্বংস এবং বেশির ভাগ মিডিয়ার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি নিজের এবং তার স্ত্রীর চারপাশে একটি ব্যক্তিত্বের সম্প্রদায় তৈরি করেছিলেন, যা তার ক্ষমতাচ্যুতির পরও বিরাজমান ছিল। যেমনটা বাংলাদেশে আছে।
পেরনের শাসনামলে ছাত্রদের বাধ্য করা হয়েছিল তার স্ত্রী ইভা পেরনের জীবনী গ্রন্থ পড়তে। এই গ্রন্থ দেওয়া হতো ইউনিয়ন ও সরকারি চাকরিজীবীদের, যাতে তারা এটি পড়ে নিজেদের একটা উগ্র পেরোনিস্ট হিসেবে প্রমাণ করতে পারে। যেমনটা শেখ হাসিনা তার শাসনকালে ছাত্রদের তার বাবা শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী পড়তে বাধ্য করেছিলেন, যাতে তারা খাঁটি মুজিববাদী হয়ে বড় হতে পারে।
জুয়ান পেরন প্রায়ই যেকোনো বিরোধী নেতার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করতেন এবং নিয়মিত তাদের বিশ্বাসঘাতক ও বিদেশি শক্তির এজেন্ট হিসেবে চিহ্নিত করতেন। যারা পেরনের রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিলেন না বা যাদের হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হতো, তারা চাকরি হারানো থেকে শুরু করে সহিংসতা ও নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতো। যেমন : শেখ হাসিনা তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের পাকিস্তানপন্থি ও রাজাকার হিসেবে অভিহিত করতেন। আর যাদের তিনি তার ক্ষমতার জন্য হুমকি মনে করতেন, তারা হয় আয়না ঘরে, না হয় গুম-খুনের শিকার হতেন।
পেরন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ২০ হাজারের অধিক শিক্ষককে বরখাস্ত করেছিলেন। হাজার হাজার শিল্পী, বিজ্ঞানী, লেখক, শিক্ষাবিদ দেশ ছেড়ে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ইউনিয়ন নেতা ও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের গ্রেপ্তার নির্যাতন চালানো হতো নির্মমভাবে। তার ক্ষমতাচ্যুতির পর সব বন্দি মুক্তি লাভ করেন। যে দৃশ্যটা আমরা শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে প্রত্যক্ষ করেছি।
ওই স্বৈরশাসকদের যতই সমালোচনা করা হোক না কেন কিংবা তারা জনগণের মন থেকে মুছে গেলেও ইতিহাসের পাতা থেকে তাদের নাম কেউ কখনোই মুছে ফেলতে পারবে না। এসব ছাড়াও এমন সব বীরপুরুষের কথা আমরা জানি, যারা প্রথম জীবনে জননন্দিত তারকায় পরিণত হলেও পরবর্তী সময়ে ভিলেন হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। এ ব্যাপারে আমরা ফরাসি এক জেনারেলের কথা জানি, যার নাম ফিলিপ প্যাটেন। তিনি প্রথম মহাযুদ্ধে ফ্রান্সকে বিজয়ী করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার জন্য ফরাসি জনগণের নয়নের মণিতে পরিণত হয়েছিলন। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মানির খাড়া করা পুতুল সরকারের নেতৃত্ব দিয়ে ফরাসি জনগণের কাছে একজন ঘৃণ্য ভিলেনে পরিণত হন। যুদ্ধের পর এক ট্রাইব্যুনালে প্রথমে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু পরে তার অতীত গৌরবজনক ভূমিকা থাকার কারণে ওই শাস্তি স্থগিত করে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। সেই কারাগারেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক