২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশে যা ঘটেছিল, সেটি নিছক একটি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান নয়। এটি ছিল রাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদী কাঠামোর বিরুদ্ধে সর্বস্তরের জনগণের ঐতিহাসিক প্রতিরোধ, যা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় আরেকটি ‘মুক্তিযুদ্ধ’। এই বিপ্লব রাষ্ট্র, নাগরিক ও ভবিষ্যতের গণতন্ত্র—সবকিছু নিয়ে নতুনভাবে স্বপ্ন দেখার, নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর কল্পনা করার সুযোগ করে দেয়। কিন্তু এক বছর পর এই বিপ্লবের জন্য যে ‘ঘোষণাপত্র’ পঠিত হলো, তা কি সেই স্বপ্নের, কল্পনার যথার্থ বহিঃপ্রকাশ? এই লেখায় আমরা এই প্রশ্নকে সামনে রেখে ঘোষণা ও বিপ্লবের মধ্যকার সম্পর্ক, নেতৃত্ব, সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় এবং সুশীল সমাজের ভূমিকা সংক্ষেপে বিশ্লেষণ করব।

ঘোষণাপত্রের ভাষা কার?

ঘোষণাপত্র রাষ্ট্রের আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রথম ভাষ্য। তা নিছক দাবি বা যুক্তি নয়। বরং এটি ইতিহাস নির্মাণের এক মৌলিক প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু ৫ আগস্ট মঙ্গলবার যে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করা হলো, তার ভাষা, দৃষ্টিভঙ্গি ও রেফারেন্স কাঠামোতে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণি ও দৃষ্টিভঙ্গির আধিপত্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এটি হলো শহুরে এনজিও-সংশ্লিষ্ট সুশীল সমাজের ভাষা।

এই ভাষা মার্জিত, পরিমিত এবং আইনি-নির্বাচনি গতিপথে আবদ্ধ। বিপ্লবের বিক্ষোভ, ‘মব জাস্টিস’ বা ‘খোদায়ি সহিংসতা’র রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত এখানে অস্পষ্ট। যেন রাষ্ট্রকাঠামোর বাইরে দাঁড়িয়ে জনগণ সরকার বদলে ফেলেনি, বরং ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের সফল পরিণতিতে রাষ্ট্র নিজেই নতুন কনসেন্সাস গড়েছে। এমন একটি ‘ডিপলিটিসাইজড’ বয়ান তৈরি করা হয়েছে।

তরুণদের রক্ত, শহীদদের আত্মত্যাগ, ইসলামি-বামপন্থি, পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়-মাদরাসা, সব ধারা ও পরিচয়ের সবাই মিলে যে জনঅভ্যুত্থান, তা শহুরে বুদ্ধিজীবী ও এনজিওধারার পরিমিত বয়ানে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন জাগে, যে বিপ্লব নিজের ভাষা তৈরি করেছিল, তার ঘোষণাপত্র অন্য কেউ লিখে দেওয়ার অধিকার পায় কীভাবে?

ভাষার পাশাপাশি আন্দোলনের নেতৃত্বকেও মুছে ফেলা হয়েছে, যা এই ঘোষণাপত্রের আরেকটা বড় সীমাবদ্ধতা। আখতার-মাহফুজ-নাহিদদের নেতৃত্বে সংগঠিত যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন থেকে এই অভ্যুত্থান সূচিত হয়েছিল, সেই নেতারা শুধু ‘ঋণ স্বীকার’ পর্যায়ে স্থান পেয়েছেন। অথচ নেতৃত্বহীন বিপ্লব বলে কিছু হয় না। বিপ্লব মানে হলো নৈতিক কর্তৃত্ব, সাংগঠনিক দক্ষতা এবং রাজনৈতিক কল্পনার সংমিশ্রণ। সেই জায়গা থেকে এই ঘোষণাপত্র একটি বড় রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি করেছে, যা ভবিষ্যতে ঐতিহাসিক বিকৃতি ঘটাতে পারে।

এনজিও-সুশীল সমাজের ভাষা বরাবরই নেতৃত্বহীনতা ও দায়িত্বহীনতার মধ্য দিয়ে ‘সিস্টেম সংস্কার’ নামক আপসমূলক এবং বিরাজনীতিকরণের বয়ান তৈরির করে। কিন্তু বিপ্লব শুধু সংস্কার চায় না, এটি পুরোনো কাঠামোর ন্যায্যতাকে অস্বীকার করে এক নতুন কাঠামো দাবি করে। ঘোষণাপত্রে নেতৃত্বের স্বীকৃতি না থাকায় সেটি মূলত ক্ষমতার প্রশ্নে একটি অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে এবং পরে এটি ক্ষমতার দখলদারিত্বের দ্বার খুলে দিতে পারে, ঠিক যেমনটি হয়েছে একাত্তরের পরিপ্রেক্ষিতে শেখ পরিবারের মধ্যে নেতৃত্বের পুরো কৃতিত্ব আরোপ করে অন্যসব নেতৃত্বকে মুছে ফেলার মধ্য দিয়ে।

বাঙালি মুসলমান সত্তার অস্বীকৃতি : ইতিহাসের এক বিপজ্জনক মুছে ফেলা

এটি আরো গুরুতর সীমাবদ্ধতা এই যে, ঘোষণাপত্রে ১৯৪৭ সালের বাঙালি মুসলমানের পাকিস্তান আন্দোলন, তথা রাজনৈতিক আত্মপ্রতিষ্ঠার ইতিহাস কোনোভাবে উল্লিখিত হয়নি। সবকিছুর শুরু ধরা হয়েছে পাকিস্তান রাষ্ট্রে বঞ্চনার অভিজ্ঞতা থেকে। অথচ ১৯৪৭-এর আগে জমিদারতন্ত্রবিরোধী চেতনা, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, বঙ্গীয় মুসলিম মধ্যবিত্তের উত্থান এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, পাকিস্তান আন্দোলনে বাংলার নেতৃত্ব এসবকেই সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে।

বাঙালি মুসলমান পরিচয়কে রাজনৈতিকভাবে ‘অস্বস্তিকর’ মনে করে যে সুশীল শ্রেণি বা এনজিওকেন্দ্রিক দর্শন, তার প্রতিফলন ঘটেছে এই ঘোষণার ন্যারেটিভ নির্মাণে। কিন্তু ২০২৪ সালের আন্দোলন ছিল এই উপেক্ষিত সত্তার এক পুনরাবিষ্কার। এখানে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ও অজেয় হয়ে পথে নেমেছিল বাঙালি মুসলমানের ধর্মবিশ্বাসী সন্তানরা। ‘ফেরাউনবিরোধী’ ইশতেহার, ‘ইনকিলাব’ এবং ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না’ ধরনের স্লোগান যে গভীর সাংস্কৃতিক একতা নির্মাণ করেছিল, তা ঘোষণাপত্রে অনুপস্থিত।

শুধু ইসলাম নয়, বাঙালি মুসলমানের ইতিহাস, ভাষা ও আত্মপরিচয়—সবই যেন এখানে ‘অদৃশ্য’। আর এই অদৃশ্যতা শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং সাংস্কৃতিক নির্মমতা।

শাপলাহীন ঘোষণাপত্র?

এই ঘোষণাপত্র থেকে যেসব প্রতীকবাদ অনুপস্থিত, তার মধ্যে সবচেয়ে স্পষ্ট ‘শাপলা’। ২০১৩ সালে ধর্মভিত্তিক এক শান্তিপূর্ণ আন্দোলন, যেটির বিরুদ্ধে ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় সহিংসতা হয়েছিল এবং যা একটি বৃহৎ রাজনৈতিক বোধ তৈরির পথ খুলে দিয়েছিল। শাপলার রক্ত ছিল জুলাইয়ের বীজ।

কিন্তু এনজিও ও দাতানির্ভর পরজীবী সুশীল দৃষ্টিভঙ্গি এ ঘটনার স্বীকৃতি দিতে চায় না। তাদের কাছে শাপলা একটি বিব্রত স্মৃতি, যা তাদের ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র কমফোর্ট জোনকে অস্থির করে। ফলত, ঘোষণাপত্রে শাপলার কোনো উল্লেখ নেই। এই নিঃশব্দতাই প্রমাণ করে, ঘোষণাপত্রটি সমগ্র আন্দোলনের প্রতিফলন নয়, বরং একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির বয়ান মাত্র।

তাহলে করণীয় কী?

এই ঘোষণাপত্র অবশ্যই বাতিলযোগ্য নয়। বরং একে একটি খসড়া হিসেবে বিবেচনা করে, জনগণের ভাষা, নেতৃত্ব এবং বাঙালি মুসলমানের সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে সংযুক্ত করে পুনর্লিখন জরুরি। ঘোষণাপত্রের ভাষাকে রাষ্ট্রীয় সংবিধানের অংশ করতে হলে অবশ্যই পরিপূর্ণ ঐতিহাসিকতা এবং রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বহন করতে হবে।

সুশীল সমাজ রাজনৈতিক নেতৃত্ব নয়। এনজিও কোনো বিপ্লবের উত্তরাধিকার বহন করতে পারে না। আর রাষ্ট্রকে পুনর্গঠনের ঘোষণাপত্র শুধু কাগুজে শুদ্ধতার দলিল নয়। এটি হতে হবে রক্তাক্ত ইতিহাসের নৈতিক উত্থান এবং বিপ্লবী সত্তাকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্র ও সমাজ পুনর্গঠনের মূলমন্ত্র।

ঘোষণাপত্রের দিকনির্দেশ ও ভাষ্যকে ইতিহাসের দাবি পূরণ করতে হলে, আমাদের প্রয়োজন নেতৃত্বের স্বীকৃতি, সাংস্কৃতিক সত্তার স্বীকৃতি এবং ইসলামি-জাতীয়তাবাদী জনমানসের সঙ্গে আর সব দল-মতের সম্মিলন। না হলে, এই বিপ্লব আরেকটি ‘প্যাসিভ রেভোলুশন’ হিসেবে রূপান্তরিত হবে, যা কাঠামো ভাঙে না, শুধু মানিয়ে নেয়।

‘জুলাই বিপ্লব’ ছিল এক ঐতিহাসিক ক্ষণ, যেখানে জনগণ শুধু ভোট চায়নি; তারা চেয়েছিল রাষ্ট্র ও সমাজের পুনর্গঠন। ঘোষণার ভাষাও তাই পুনর্গঠন করতে হবে। না হলে, ইতিহাস থেকে আমরা শুধু বিপ্লব নেব আর বিপ্লবীদের ভুলে যাব।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয় (কাতার)

সূত্র, আমার দেশ