সকালে ফোনটা হাতে নিয়ে আমি যে খবরটা পড়লাম, সেটা আমি আগেই কিছুটা আন্দাজ করেছিলাম—‘যুদ্ধবিরতির আলোচনা ভেস্তে গেছে অথবা যাচ্ছে।’

সেই পুরোনো অনুভূতিটা আবার ফিরে এলো। হৃৎস্পন্দন বাড়ে, পেটের ভেতর মোচড় দেয়, এরপর যন্ত্রণায় দেহ-মন অবশ হয়ে আসে।

ফিলিস্তিনি লেখক ও বিপ্লবী ঘাসান কানাফানির কথা মনে পড়ে গেল। তিনি একবার বলেছিলেন, ‘তলোয়ার আর গর্দানের মধ্যে কি সংলাপ সম্ভব?’ ক্ষমতা ও নিপীড়নের প্রশ্ন যতদিন প্রাসঙ্গিক থাকবে, কানাফানির এই কথাটাও ততদিন প্রাসঙ্গিক থাকবে।

ঘাতকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কোনোদিন কোনো গণহত্যা বন্ধ হয়েছে বলে আমার জানা নেই। ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটেওনি আসলে। আমার বিশ্বাস, ভবিষ্যতেও ঘটবে না।

ভুল বুঝবেন না, আমিও চাই যেকোনোভাবে শান্তি ফিরুক। শান্তির জন্য আমি আমার সবকিছু দিতে রাজি আছি। আমি এমন এক পৃথিবী চাই, যেখানে আমার ভাগনি জুরির মতো আর কেউ ইসরাইলি বোমার আঘাতে মারা পড়বে না। যেখানে ওর বোনকে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে জুরির নাম ধরে চিৎকার করতে হবে না। যেখানে আমার বাবাকে নিজের নাতনিদের খণ্ড খণ্ড দেহ কবর দিতে হবে না।

একদিকে গাজার মানুষদের না খাইয়ে মারা হচ্ছে, বোমায় উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, জীবন্ত কবর দেওয়া হচ্ছে, শিশুদের রক্তে সিক্ত হচ্ছে গাজার ভূখণ্ড—সেই একই সময়ে খুনিরা মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাসে, বক্তৃতা দেয়।

শুধু ৭ অক্টোবরের পরেই প্রায় ৬০ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে হাজার হাজার শিশু। গাজা ২০০৭ সাল থেকেই বর্বর ইসরাইলি অবরোধের শিকার। অনিয়মিত কিছু মানবিক সাহায্যের ওপর ভর করে ২০ লাখ মানুষ সেখানে টিকে আছে। এদিকে যারা তথাকথিত আলোচনার ডাক দেয়, তারাই আবার ইসরাইলকে বোমা সরবরাহ করে।

আন্তর্জাতিক বিশ্ব ‘আলোচনা’ নামের একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে আছে। সেইসঙ্গে কূটনৈতিক শিষ্টাচারের দোহাই আর রাজনৈতিক সুবিধাবাদ তো আছেই। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানসিকভাবেও গণহত্যা অস্বীকার করার প্রবণতা আছে।

‘আলোচনা’ শব্দটা আমাদের জন্য বেশ স্বস্তিদায়ক, কিন্তু এতে কাজের কাজ কিছুই হয় না। এর মধ্য দিয়ে প্রকৃত নৈতিক দায়িত্বকেই কেবল পেছনে ঠেলে দেওয়া হয়।

ইতিহাস আমাদের ভিন্ন কথা বলে। গণহত্যা কোনো ভুল বোঝাবুঝি নয়, যা আলোচনার টেবিলে বসে মিটিয়ে ফেলা যায়। গণহত্যা আসলে পরিকল্পিত নির্মূল প্রক্রিয়া।

গণহত্যার ইতিহাসে ‘আলোচনা’

১৯৯৫ সালে বসনিয়ার স্রেব্রেনিকায় যে গণহত্যা হয়েছিল, তা কোনো কূটনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে থামেনি।

মাত্র ক’দিনেই সেখানে আট হাজারের বেশি মুসলিম বসনিয়াক পুরুষ ও কিশোরকে হত্যা করা হয়। জাতিসংঘ ঘোষিত ‘নিরাপদ অঞ্চল’-এর ভেতরেই সার্বরা এই বীভৎস হত্যাযজ্ঞ চালায়। আন্তর্জাতিক বাহিনীগুলো তখন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছিল। শুধু বাইরের সামরিক হস্তক্ষেপের পরেই এই হত্যাকাণ্ড থেমেছিল।

কিছুদিন আগে আরো সাতজন নিহতের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। ৩০ বছর আগে তাদের হত্যা করা হয়েছিল। যারা বেঁচে আছেন এখনো, তারা সেই ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। প্রায় প্রতি বছর নতুনভাবে চিহ্নিত হওয়া দেহাবশেষ তারা কবর দেন।

স্রেব্রেনিকার গণহত্যা সাবেক জুগোস্লাভিয়ার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটিওয়াই) দ্বারা স্বীকৃত। গাজার অবস্থা বর্ণনার ক্ষেত্রেও সঠিক শব্দ ব্যবহার করা জরুরি। গাজাতেও গণকবর আছে। এই জনগোষ্ঠীকেও প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে গণহত্যার ট্রমা বয়ে বেড়াতে হবে।

রুয়ান্ডায় তুতসি গণহত্যাও আমাদের একই বার্তা দেয়। ১৯৯৩ সালের ‘আরুশা চুক্তি’কে বিরাট অগ্রগতি বিবেচনা করে কূটনৈতিক পাড়ায় উৎসবের আমেজ বিরাজ করছিল। কিন্তু ওই চুক্তির আড়ালে এগিয়ে চলেছিল গণহত্যার পরিকল্পনা।

১৯৯৪ সালে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো শান্তিরক্ষীদের সরিয়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গণহত্যা শুরু হয়ে যায়। মাত্র ১০০ দিনে প্রায় আট লাখ তুতসি ও উদারপন্থি হুতুকে হত্যা করা হয়।

সেখানে আলোচনার কোনো স্থান ছিল না; ছিল শুধু চাপাতি, রেডিওতে ঘৃণার প্রচার, ভুক্তভোগীদের ‘তেলাপোকা’ বলা, আর ছিল গণকবর। এই নির্মূল অভিযান থেমেছিল শুধু সামরিক অভ্যুত্থানের পরেই।

হলোকাস্টও কোনো কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে থামেনি। হিটলারের সঙ্গে কোনো সমঝোতা হয়নি। হিটলারের সঙ্গে কোনো যুদ্ধবিরতি হয়নি। শুধু নাজি জার্মানির ধ্বংসের মধ্য দিয়েই এই গণহত্যা বন্ধ হয়েছিল।

ওয়ানসি কনফারেন্সের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা বুঝতে পারব, খুনির দল কখনো শান্তি চায় না; ওরা শুধু অধিকতর দক্ষতার সঙ্গে খুনের কৌশল রপ্ত করতে চায়।

একইভাবে কম্বোডিয়াতেও খেমার রুজ বাহিনীর গণহত্যা থেমেছিল ভিয়েতনামের সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে; কোনো আলোচনা বা সমঝোতার মাধ্যমে নয়। আজকের নামিবিয়াতে হেরেরো ও নামা জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল।

এই ঘটনাগুলোর কোনোটার ক্ষেত্রেই গণহত্যাকারীরা হঠাৎ একদিন ভালো হয়ে যায়নি। ভুক্তভোগীরা তাদের খুনিদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে গণহত্যা থামিয়ে দিয়েছে, এমনটা কোথাও ঘটেনি।

যাদের মানুষই মনে করা হয় না, তারা কীভাবে আলোচনা করবে?

এটাই আসল ব্যাপার। গণহত্যা শুধু একসঙ্গে অনেক মানুষ খুন করার ব্যাপার নয়, এর সঙ্গে মতাদর্শ জড়িত থাকে।

গণহত্যাকারীরা শুধু আপনার মৃত্যু চায় না। এরা চায় আপনার স্মৃতি নিশ্চিহ্ন হোক, আপনার ভাষা বিলুপ্ত হোক, আপনার কোনো উত্তর প্রজন্ম না থাকুক এবং সর্বোপরি পৃথিবীর বুক থেকে আপনার অস্তিত্বও যেন মুছে যায়।

আলোচনা করতে হলে পরস্পরকে মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হয়। কিন্তু গণহত্যা তো সেটাই অস্বীকার করে।

একেই বলে গণহত্যা। এটা কেবল গণহারে খুন নয়, একটা সামগ্রিক বিশ্বাসের প্রতিফলন। এর অর্থ হচ্ছে আপনি, আপনার সন্তান, আপনার স্মৃতি, ভূমি ও ইতিহাসকে যেকোনো মূল্যে নিশ্চিহ্ন করতেই হবে।

নাৎসিরা ইহুদিদের বলত পোকামাকড়। রুয়ান্ডায় তুতসিদের বলা হতো তেলাপোকা। আজকের দিনে ইসরাইলি কর্মকর্তারা ফিলিস্তিনিদের বলে ‘মানবপশু’। ফিলিস্তিনিদের তারা ‘আমালেক’ নামেও ডাকে, বাইবেলে যাদের সম্পূর্ণ নির্মূল করতে বলা হয়েছে।

এত কিছুর পরও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো ফিলিস্তিনিদের ‘ভারসাম্য’ রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে জ্ঞান দেয়। আর এদিকে বোমা হামলা করে তাদের ঘরবাড়ি উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

আসলে ন্যায়বিচার ছাড়া কোনো শান্তি হয় না, কেবল নীরবতা হয়।

গণহত্যা বিরতি দেওয়ার বিষয় নয়, বন্ধ করার বিষয়। ‘যুদ্ধবিরতি’ একটা পোশাকি শব্দ হয়ে গেছে। বিরতি তো গণহত্যা থামায় না, শুধু ম্যানেজ করে। প্রতিবার বিরতি মানে কেবল নতুন করে হত্যাকাণ্ড শুরু হওয়ার অপেক্ষা। ২০০৯, ২০১৪ ও ২০২১ সালে আমরা এসব অনেক দেখেছি।

কত আলোচনাই তো হলো। গাজা এখনো অবরুদ্ধ। মানুষও মারা যাচ্ছে। আসলে আলোচনা দিয়ে তো গণকবর মুছে ফেলা যায় না।

যারা বারবার বলে, ‘ইসরাইলের সঙ্গে গাজা নিয়ে আলোচনা করো’, তাদের প্রশ্ন করি, কীসের ভিত্তিতে এই আলোচনা হবে? ইসরাইলের মন্ত্রীরা প্রকাশ্যে জাতিগত নিধনের কথা বলেন। তারা গর্ব করে গাজার নাম দিয়েছেন ‘তাঁবুর শহর’।

তাদের সেনাবাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে হাসপাতাল, বেকারি, স্কুল, গির্জা ও মসজিদে বোমা হামলা করছে। কিন্তু একদিন তারা হঠাৎ উঠে বলবে, ‘এবার যথেষ্ট হয়েছে’—এটা কি বিশ্বাস করার মতো? না। তারা থামবে কেবল তখনই, যখন বাধ্য করা হবে; আলোচনার মাধ্যমে নয়, চাপে। নিষেধাজ্ঞা, বাণিজ্য অবরোধ, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও কূটনৈতিক সমর্থন প্রত্যাহার-জাতীয় বাস্তব পদক্ষেপই তাদের থামাতে পারে।

একদিকে গাজা অনাহারে ভুগবে, অপরদিকে বিলাসবহুল হোটেলে করমর্দন ও আলোচনা চলবে। এভাবে হয় না।

ভান ধরা বন্ধ করতে হবে

১৯৪৮ সালের জাতিসংঘের গণহত্যা সনদে পরিষ্কার সংজ্ঞা দেওয়া আছে—‘কোনো জনগোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা করা, গুরুতর শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি করা এবং জীবনধারণের ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা, যাতে তারা অবধারিতভাবে ধ্বংস হয়ে যায়।’

এই সবকটি মানদণ্ডে গাজা গণহত্যার আওতায় পড়ে। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতও এর স্বীকৃতি দিয়েছে। তারপরও হত্যা বন্ধ হয়নি। এটা কোনো ভৌগোলিক যুদ্ধ নয়, এটা অস্তিত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ।

গত শুক্রবার স্রেব্রেনিকার গণহত্যার ৩০ বছর পূর্ণ হলো। কিন্তু সেই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিলাম কই। গণহত্যা চলছেই। লাগামহীন।

এদিকে ইথারে ভাসছে ইতিহাসের আর্তনাদ। গণহত্যা যারা চালাচ্ছে, তাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তা থামে না; গণহত্যা থামাতে হয়। তারপর এমন এক বিশ্ব গড়ে তুলতে হয় যেন এ ধরনের অপরাধ আর না ঘটতে পারে।

যতক্ষণ না অস্ত্র সংবরণ করা হচ্ছে, অবরোধ তুলে নেওয়া হচ্ছে, হত্যার আদর্শকে ধ্বংস করা হচ্ছে, ততক্ষণ কোনো যুদ্ধবিরতি, কোনো রাজনৈতিক চুক্তি, জাতিসংঘের কোনো প্রেস বিজ্ঞপ্তি—কোনোকিছুই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারবে না।

ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারে কেবল সত্য। আর সত্য হচ্ছে, গাজাকে ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হচ্ছে এবং যারা এই নারকীয় তাণ্ডব চালাচ্ছে, তাদের সঙ্গে চুক্তি করে গাজাকে রক্ষা করা যাবে না।

তলোয়ার আর গর্দানের মধ্যে কি আলোচনা সম্ভব?

টিআরটি গ্লোবাল থেকে ভাষান্তর : এইচ এম নাজমুল হুদা

সূত্র, আমার দেশ