একদলীয় বাকশালি মুজিববাদের পর গুম, খুন আর আয়নাঘরের হায়েনার বিকৃত হাসিতে রক্তাক্ত হাসিনাবাদ। ঘনঘোর অন্ধকারকেই যেখানে জীবনের নিয়তি ধরে নিয়েছিল মানুষ, তার থেকে মুক্তি সহজ বিষয় নয়। ঠিক তখনই বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন এক স্বপ্নময় অধ্যায় এসেছিল, যখন গোটা দেশ যেন এক চলমান ক্যানভাসে পরিণত হয়েছিল।
গলির মোড়, শহরের ব্যস্ত রাজপথ, নিভৃত গ্রামের মাটির রাস্তা, এমনকি পাহাড়ি জনপদ কিংবা নদীবিধৌত চর—সব জায়গার দেয়ালই তখন কথা বলছিল। আর এই কথাগুলো বলা হচ্ছিল রঙে, তুলিতে ও স্প্রে ক্যানের আওয়াজে। এক অভূতপূর্ব গণআন্দোলনের আবহে বাংলাদেশের মানুষ যে গ্রাফিতির জন্ম দিয়েছিল, তা কেবল পরিমাণে নয়, ব্যঞ্জনায়ও অতুলনীয়। বিশ্ব ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত দুর্লভ, যেখানে আন্দোলনের ভাষা হয়ে উঠেছে দেয়ালের চিত্র, আর রঙিন রেখার মাঝে উচ্চারিত হয়েছে অবদমন ভাঙার স্লোগান।
এই চিত্রগুলো শুধুই শিল্প নয়, ছিল প্রতিবাদের অস্ত্র। রাজধানী থেকে প্রান্তিক গ্রাম, জেলা শহর থেকে থানা—সব স্থানেই অঙ্কিত হয়েছে এই ‘প্রতিরোধের শিল্প’। স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয়—কোনো দেয়াল বাদ যায়নি। শিল্পের এই অভাবনীয় বিস্তার শুধু ভবনের দেয়ালে সীমাবদ্ধ ছিল না; অফিস-আদালত, কারখানা, এমনকি বাসার সীমানাও হয়ে উঠেছিল প্রকাশের মাধ্যম। যেন প্রতিটি ইট আর সিমেন্টে আন্দোলনের স্পন্দন গাঁথা ছিল, যেন প্রতিটি দেয়াল হয়ে উঠেছিল একেকটি উচ্চারিত চিৎকার, যা আর চেপে রাখা সম্ভব নয়।
এসব গ্রাফিতি হয়তো ক্যানভাসের সুষম গাঁথুনি মেনে আঁকা হয়নি, হয়তো তাতে রঙের সূক্ষ্ম ছায়া-প্রক্ষেপণের কারুকাজ ছিল না; কিন্তু তাতে ছিল অকপটতার নির্মেদ শক্তি। একেকজন অজানা শিল্পী যখন গভীর রাতে রঙের ক্যান হাতে দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়েছেন, তখন তার মনে ছিল না খ্যাতি বা প্রদর্শনীর কোনো চিন্তা। বরং ছিল দেশ, প্রতিবাদ, অধিকার আর মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। এমন আন্তরিক শিল্প অন্য কোথাও দেখা গেছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। এটি ছিল একেকটি হৃদয়ের গভীর থেকে ফুটে ওঠা বর্ণিল প্রতিবাদ, যা নীরবতার বদলে বিস্ফোরণ চেয়েছিল।
ধনী কিংবা দরিদ্র, গ্রামীণ বা শহুরে—কোনো শ্রেণির সীমা মানেনি এই অভ্যুত্থানধর্মী চিত্রকলা। এটি কোনো উচ্চশিক্ষিত শ্রেণির একচেটিয়া অভিজ্ঞান ছিল না, বরং গণমানুষের শিল্প হয়ে উঠেছিল গ্রাফিতি। এখানেই এর মৌলিকতা, এখানেই বিপ্লব। এটি ‘শিল্পকলার প্রতিষ্ঠিত সংজ্ঞা’র বিপরীতে দাঁড়িয়ে এক নতুন ভাষা সৃষ্টি করেছিল, যা ক্লাসিক শিল্পরীতির মুখে চপেটাঘাত হয়ে উচ্চারণ করেছে এক নতুন দিগন্তের সম্ভাবনা।
Abu-Sayed
এই শিল্পরূপে কোনো ভান ছিল না; ছিল হৃদয়ের আবেগ, প্রতিবাদের ঔজ্জ্বল্য। স্বাধীনতার দাবি যখন দিনে দিনে আরো তীব্র হয়ে উঠছিল, তখন প্রতিটি গ্রাফিতি ছিল যেন একেকটি চিন্তার গ্রেনেড, যা কাঁপিয়ে দিয়েছে দখলদারদের ভিত। দেয়ালের লেখা, আঁকা, দাগ কেটে দেওয়া চিহ্ন—সবকিছুই তখন হয়ে উঠেছিল বারুদের মতো, শব্দের চেয়ে শক্তিশালী, গুলির চেয়েও বেশি কার্যকর।
এ এক শিল্পবিপ্লব, যা ইতিহাসে লেখা থাকবে রঙিন অক্ষরে—যেখানে ক্যানভাস ছিল দেয়াল, রঙ ছিল প্রতিবাদ, আর শিল্পী ছিল একটি জাগ্রত জাতি।
স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি—এ যেন বাংলাদেশের গণমানুষের দীর্ঘদিনের এক অমোচনীয় আকাঙ্ক্ষা। আর সেই চিরন্তন আকাঙ্ক্ষার এক অনন্য শিল্পিত প্রকাশ আমরা দেখেছি দেশের প্রতিটি দেয়ালে, অলিগলির প্রান্তে, শহরের প্রাণকেন্দ্রে, কিংবা প্রত্যন্ত গ্রামে আঁকা গ্রাফিতিগুলোয়। এই চিত্রগুলো ছিল নিছক রঙ বা রেখার খেলা নয়; বরং প্রতিটি রঙিন স্পর্শে উচ্চারিত হয়েছে আর্তনাদ, প্রতিবাদ এবং এক অনতিক্রম্য প্রত্যয়ের ধ্বনি। গণআকাঙ্ক্ষার এক তীব্র ও দৃঢ় চিত্রায়ন হয়ে উঠেছে এই গ্রাফিতিগুলো, যেখানে ফুটে উঠেছে এক নিষ্ঠুর রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকে মুক্তির আকুলতা।
এই শিল্পস্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ছিল এক দীর্ঘ সময় ধরে পুঞ্জীভূত স্বৈরশাসনের করাল ছায়া—হাসিনাবাদ। একটি নিষ্ঠুর নিষ্পেষণমুখী শাসনব্যবস্থা, যেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিপতিত, মানবাধিকার পদদলিত এবং ন্যায়বিচার প্রহসনে রূপান্তরিত। সেই নির্দয় ফ্যাসিবাদী সময় আজ ইতিহাসের পাতায় এক বিভীষিকাময় অধ্যায় হয়ে থাকবে, আর তার মুখপাত্র হয়ে থাকবে দেয়ালে আঁকা হাজারো শিল্পকর্ম, যেখানে প্রতিটি রেখা প্রতিধ্বনি তুলেছে মানুষের আর্তনাদের, প্রতিটি রঙে মিশে আছে মুক্তির প্রত্যাশা।
শিল্পীসমাজ, বিশেষ করে যারা নিজেদের পরিচয় দেন গণমানুষের শিল্পী হিসেবে, তারা কখনোই নির্লিপ্ত থাকতে পারেন না। যারা জ্যাজ বা গণচেতনার শিল্পস্রোতে নিজেদের সঁপে দিয়েছেন, তারা হৃদয়ের গভীরে বহন করেন সমাজের দুঃখ, মানুষের যন্ত্রণার ছাপ। দেশের ওপর চলমান অমানবিক নির্যাতন ও নিরবচ্ছিন্ন নিপীড়ন তাদের নিঃশেষ করে, তাদের তুলিতে ঝরে পড়ে প্রতিবাদের রঙ। সেই রঙে আঁকা হয় নিপীড়িতের মুখ, হারিয়ে যাওয়া সন্তানের অশ্রুবিন্দু, অথবা রাজপথে গুলিবিদ্ধ যুবকের রক্তরঞ্জিত স্বপ্ন।
বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম ছিল না। বাকস্বাধীনতা যখন কণ্ঠরুদ্ধ, সংবাদমাধ্যম যখন রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে, বিচারব্যবস্থা যখন শাসকের হাতের পুতুলে পরিণত, তখনো শিল্পীরা থেমে থাকেননি। তাদের কণ্ঠরোধ করা গেলেও তাদের হাত থামানো যায়নি। তারা স্টুডিও হারিয়েছেন, গ্যালারি হারিয়েছেন, কিন্তু থেমে যাননি সৃজনের যুদ্ধে। দেশের প্রতিটি দেয়াল হয়ে উঠেছে তাদের ক্যানভাস, প্রতিটি জনপদ তাদের প্রদর্শনীস্থল। এখানেই তাদের অপরাজেয়তা।
যে মুহূর্তে জনতার বাঁধ ভেঙে পড়েছে রাজপথে, যখন মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে মানুষ মুখোমুখি হয়েছে বন্দুকধারী রাষ্ট্রযন্ত্রের, তখন শিল্পীরাও নেমে এসেছেন রঙের যুদ্ধক্ষেত্রে। ‘নিকটতার’ সেই অলিখিত সংবেদনে তারা নিজের তুলির পাশে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সাধারণ মানুষদের দিকে। যে যেমন পারে—কেউ দেয়াল রঙ করেছে, কেউ ডিজাইন এঁকেছে, কেউ খসড়া তুলে দিয়েছে, কেউ কেবল রঙ মিশিয়ে দিয়েছে। এভাবেই গড়ে উঠেছে এক সম্মিলিত সৃজনযজ্ঞ। এই সম্মিলনই শিল্পকে করেছে গণমানুষের অস্ত্র, প্রতিবাদের ভাষা, আর চেতনার গর্জন।
দেশব্যাপী তৈরি হয়েছে হাজারো দৃশ্যকাব্য। শিল্পীরা নিজেদের স্টুডিওকে ত্যাগ করে প্রতিটি রাস্তার মোড়ে, পাড়ার চায়ের দোকানের পেছনে, স্কুলের গেটের পাশে, কিংবা পুলিশ পোস্টের সামনের দেয়ালে গড়ে তুলেছেন একেকটি ক্ষণস্থায়ী কিন্তু ঐতিহাসিক শিল্পজাদুঘর। এই গণদেয়ালচিত্র সংগ্রহশালাগুলো আজও সাক্ষ্য দেয় এক সাহসী সময়ের, যখন শাসনের বিরুদ্ধে সৃষ্টি ছিল মানুষের একমাত্র প্রতিরোধ।
এ এক বিপ্লব, রঙে-রেখায় আঁকা গণতন্ত্রের ইতিহাস। আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল এক স্পষ্ট ও সীমিত দাবি ঘিরে—সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথার বৈষম্য নিরসনের জন্য। এটি ছিল একটি বাস্তবসম্মত, ন্যায্য এবং যুক্তিসংগত আহ্বান, যা দেশের উচ্চশিক্ষিত তরুণ সমাজের দীর্ঘদিনের অবহেলিত ক্ষোভকে ভাষা দিয়েছিল। তাই প্রথম দিকে আন্দোলনের চিত্রশৈলী, দেয়ালচিত্র ও গ্রাফিতিগুলোতেও প্রতিফলিত হয়েছে মূলত কোটা সংস্কার-সংক্রান্ত বক্তব্য। ‘মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ চাই’, ‘বৈষম্যের অবসান হোক’—এমন স্লোগান ও বাক্য প্রাধান্য পেয়েছিল তখন।
কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ দ্রুতই একটি মৌলিক মোড় নেয়। কারণ কোটা ছিল কেবল একটি উপলক্ষ, মূল অসন্তোষ ছিল আরো গভীরে প্রোথিত। সুদীর্ঘ দেড় দশকের বেশি সময় ধরে শাসকগোষ্ঠী যে স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী শাসন চালিয়ে আসছিল, তার বিরুদ্ধে জনমনে জমে থাকা চাপা ক্ষোভ হঠাৎই যেন বিস্ফোরিত হয়ে ওঠে। নিপীড়ন, দুর্নীতি, বিচারহীনতা, বাকস্বাধীনতা দমন এবং ক্ষমতার জবরদখলের বিরুদ্ধে দেশের তরুণ প্রজন্ম রাস্তায় নেমে আসে। আর এই প্রতিরোধের ভাষা হয়ে ওঠে গ্রাফিতি।
দেয়ালে দেয়ালে তখন আর শুধু কোটা নিয়ে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ছিল না; বরং ফুটে উঠতে থাকে স্বৈরাচারবিরোধী বার্তা, শাসকের মুখোশ উন্মোচনের প্রতিচিত্র। ‘গণতন্ত্র ফিরিয়ে দাও’, ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’, ‘তুই শুধু ভোট চুরি জানিস’—এসব গ্রাফিতি যেন হয়ে ওঠে জনতার মুখপাত্র। রঙ, আঁকিবুঁকি আর রুক্ষ শব্দে মানুষ কথা বলে উঠল শাসকের বিরুদ্ধে। জনমানসে জমে থাকা দীর্ঘ অবমাননার ক্ষরণ রঙের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীর রাজপথ থেকে প্রত্যন্ত জেলার মাটির দেয়ালেও।
এসব প্রতিচিত্রে অনিবার্যভাবে যুক্ত হয়ে পড়ে ছাত্র আন্দোলনের দ্রোহ। তরুণ ছাত্রসমাজ, যারা যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের গণআন্দোলনের প্রেরণার উৎস, তারা নিজেদের ঐতিহাসিক ভূমিকা আবার দৃপ্তভাবে পালন করে। রাজপথের প্রতিবাদে তাদের গর্জন যুক্ত হলে আন্দোলন পায় নতুন মাত্রা, নতুন গতি। তারা শুধু বক্তৃতা কিংবা মিছিলেই সীমাবদ্ধ থাকে না, তারা দেয়ালের চিত্রেও শানিত করে তিরস্কার।
রাস্তাগুলো তখন হয়ে ওঠে একেকটি জীবন্ত পাঠশালা, যেখানে গ্রাফিতিই ছিল পাঠ্যবই, আর জনগণ ছিল শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ই। জনতার অপ্রতিরোধ্য স্রোতের সঙ্গে এই চিত্র-প্রতিবাদ মিলেমিশে এমন এক উল্লম্ফন তৈরি করে, যা স্বৈরাচারের থরথর করে কাঁপানো মসনদও ছিন্নভিন্ন করে দেয়। এ যেন রঙ ও কণ্ঠের সম্মিলিত বিদ্রোহ, যা ইতিহাসে গেঁথে থাকবে চিরকাল।
বাংলাদেশের সমকালীন ইতিহাসে গণআন্দোলনের এক অনন্য অধ্যায় রচিত হয়েছিল দেয়ালের ভাষায়—গ্রাফিতির প্রতিটি রেখা, প্রতিটি শব্দবন্ধে। সেই ভাষা ছিল নিপীড়নের বিরুদ্ধে ধিক্কার, স্বাধীনতার আকুতি এবং একটি নতুন, ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রকাঠামোর দাবি। প্রথাগত প্রচারমাধ্যম যখন রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের শিকার হয়ে মৌনতা অবলম্বন করেছিল, তখনই দেয়াল হয়ে উঠেছিল সত্য উচ্চারণের সাহসী মঞ্চ এবং সেই মঞ্চে প্রতিটি স্লোগান ছিল নতুন দিনের অগ্রদূত।
শুরুটা হয়েছিল সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটা ব্যবস্থার সংস্কার দাবি থেকে। ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’, ‘কোটা প্রথা নিপাত যাক, মেধাবীরা মুক্তির পাক’, কিংবা ‘আমার সোনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’—এসব স্লোগান প্রথম দিকে দৃশ্যমান ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই ক্ষোভ ও দাবি বিস্তৃত হলো একটি বৃহত্তর সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরে। আন্দোলনের ভাষা ও প্রতিবাদের ভাষা একত্র হয়ে রূপ নিল এক নতুন চেতনায়, যার কেন্দ্রে ছিল মুক্তি, গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার।
দেয়ালের প্রতিটি চিত্র আর বাক্য যেন রাষ্ট্র মেরামতের পরিকল্পনাচিত্র হয়ে উঠেছিল। ভবিষ্যতের অভিযোজনের জন্য জনগণের দাবি স্পষ্ট হয়ে উঠল—‘স্বৈরাচারের পতন চাই’, ‘বুকের ভিতর দারুণ ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’, কিংবা ‘দেয়ালে যখন ঠেকলো পিঠ, লড়াই তখন সুনিশ্চিত’—এসব উচ্চারণ নিছক আবেগের প্রকাশ ছিল না, বরং ছিল রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা এবং ঐতিহাসিক প্রতিজ্ঞার বহিঃপ্রকাশ। ‘জাগো বাঙালি জাগো’, ‘বাকস্বাধীনতা ফিরিয়ে দাও’, কিংবা ‘হাসিনা, তোকে রক্তের হিসাব দিতে হবে’—এসব স্লোগান সরাসরি রাষ্ট্রের হৃদয়ে আঘাত করেছিল।
উল্লেখযোগ্যভাবে, এই গ্রাফিতিগুলো কেবল প্রতিবাদ নয়, বরং একটি গঠনমূলক আদর্শেরও বাহক হয়ে উঠেছিল। ‘দেশ স্বাধীন করেছি, দেশ সংস্কার করব’, ‘আমিই বাংলাদেশ’, ‘লাখো শহীদের রক্তে কেনা দেশটা কারো বাপের নয়’, ‘স্বাধীনতা এনেছি, স্বাধিকার আনব’—এসব বাক্যবন্ধে প্রতিফলিত হয় জনগণের অটুট প্রত্যয়। রাষ্ট্র শুধু ভোট ও ক্ষমতার একটি গাঠনিক কাঠামো নয়, বরং এটি এক সজীব, প্রাণবন্ত চেতনা এবং সেই চেতনার মালিক জনগণ।
এই গ্রাফিতি-ভাষায় ফুটে উঠেছে এক নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন। ‘বাংলাদেশ নতুন স্বপ্ন দেখে’, ‘দেশসংস্কারের কাজ চলছে’, ‘আমাদের নতুন সেক্যুলার বাংলাদেশ’—এসব উচ্চারণ কেবল প্রতিবাদের প্রতিধ্বনি ছিল না, বরং ছিল বিকল্প রাষ্ট্র-চিন্তার বীজ। ‘তুমি কে? আমি কে? বিকল্প, বিকল্প’, ‘এখন দরকার জনতার সরকার’—এগুলোর মাঝে গড়ে উঠেছে গণতান্ত্রিক কাঠামোর পুনর্নির্মাণের নকশা।
শুধু দেয়ালে আঁকা ছবি বা লেখা হিসেবে এই গ্রাফিতিকে দেখলে তার গভীরতা অগ্রাহ্য করা হবে। এটি ছিল একটি যুগবদলের ডাক, জনগণের চেতনায় উন্মেষ ঘটানোর প্রয়াস। দেয়াল হয়ে উঠেছিল আয়না, যেখানে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা যেমন প্রতিফলিত হয়েছে, তেমনি প্রতিফলিত হয়েছে জনগণের আশা, সংগ্রাম ও পরিবর্তনের স্পৃহা।
এসব দেয়ালচিত্র একদিন বিলীন হয়ে যাবে রঙের ক্ষয়ে, সময়ের ধুলায়; কিন্তু ইতিহাসে তারা থেকে যাবে সাক্ষ্য হয়ে—কীভাবে একটি জাতি দেয়ালের ভাষায় লিখেছিল তার মুক্তির মহাকাব্য।
অতঃপর দেশ আবারো স্বাধীনতা পেয়েছে। শিল্পীরা একক ও যৌথ প্রদর্শনীতে অংশ নিচ্ছেন এখন। এবার ‘মুক্তি’ ধরে রাখার পালা। ফ্যাসিবাদের ডালপালা এখনো উঁকি দেয় মাঝেমধ্যেই! তাদের এই অসৎ উদ্দেশ্য প্রতিহত করার জন্য শিল্পীদের আরো ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার বিকল্প নেই। যে শিল্পকলা একসময় হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদের হাতিয়ার, এবারে তা হয়ে উঠুক দেশ গড়ার পাথেয়।
বাংলাদেশের মৃতপ্রায় গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবনের জন্য হলেও শিল্পচর্চার বিকল্প নেই। পাশাপাশি আমাদের মনে রাখতে হবে—শিল্পীর স্বাধীনতা রাষ্ট্রের স্বাধীনতাকে সমুন্নত করে। প্রতিটি দেয়ালে লিখে রাখা জুলাইয়ের এই শিল্পচেতনা সদা জাগরূক থাক আমাদের হৃদয়, মন ও মননে। এদিকে দেয়ালে দেয়ালে আঁকা এসব গ্রাফিতি যেন হররোজ আমাদের দিকে চেয়ে চিৎকার করে বলছে—‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ।’
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়