একটি রাষ্ট্র তখনই পুনর্গঠনের পথে হাঁটে, যখন প্রশ্ন করার সাহস জন্ম নেয়। যখন শাসনযন্ত্রের ভাষ্য ও প্রযুক্তির আলোর ঝলক ভেদ করে দেখা যায় এক নিঃশব্দ নিয়ন্ত্রণ কাঠামো। যখন উন্নয়ন আর আধুনিকতার নামে নাগরিককে ভাবনা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়—ঠিক তখনই প্রয়োজন পড়ে নতুন এক রাষ্ট্রচিন্তার, প্রয়োজন পড়ে একটি ক্রিটিক্যাল বাংলাদেশের।
এই বয়ান সেই প্রয়োজন থেকে উঠে আসা একটি অন্বেষণ। একটি আহ্বান—চিন্তার, প্রশ্নের এবং এক অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের। প্রশ্ন উঠুক, রাষ্ট্রচিন্তা গড়ে উঠুক।
‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এক যুগে ধরে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রধান ন্যারেটিভ হয়ে উঠেছিল, যা পরে নতুন ব্র্যান্ডিংয়ে রূপ নেয়—‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ নামে। একে উন্নয়নের প্রতীক, গণসেবা বর্ধনের পদ্ধতি এবং নাগরিক ক্ষমতায়নের মাধ্যম হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ডিজিটাল কানেকটিভিটি মানেই প্রগতি, মোবাইল ব্যাংকিং মানেই অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি, সিসি ক্যামেরা মানেই নিরাপত্তা আর জাতীয় তথ্যভাণ্ডার মানেই প্রশাসনিক স্বচ্ছতা। কিন্তু বাস্তবে এই কাঠামো হয়ে উঠেছে একপ্রকার নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রব্যবস্থার যন্ত্র, যেখানে প্রযুক্তির ব্যবহারে জবাবদিহি নয়, বরং নিঃশব্দ আনুগত্য সৃষ্টি করা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তিকে এখানে ব্যবহার করা হয়েছে নাগরিক স্বাধীনতা রক্ষার জন্য নয়, বরং প্রশ্নহীনতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলাবদ্ধতার চর্চা নিশ্চিত করার উপায়ে।
‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এটি তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের রাষ্ট্র নির্মাণ কৌশলের অংশ ছিল। এর ভেতর দিয়ে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা হয়েছে জনগণের চোখে আধুনিকতার আলো দেখিয়ে গভীর অন্ধকারে রাখার জন্য। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন একসময় রাষ্ট্রের এমন এক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল, যার মাধ্যমে সামান্য ভিন্নমতও কঠোরভাবে দমন করা হতো; অনেক সময় বিচারবহির্ভূতভাবে জেল, গুম—এমনকি হত্যার ঘটনাও ঘটেছে।
এই ব্যবস্থাটি শুধু প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি হয়ে উঠেছে এমন এক ‘জ্ঞান-প্রশাসন’ কাঠামো, যেখানে রাষ্ট্র নাগরিকের মন ও চিন্তাকেও শাসন করে। ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো যাকে বলেন ‘ডিসিপ্লিনারি পাওয়ার’, যেখানে রাষ্ট্র বাহ্যিকভাবে নয়, বরং আত্মায় অনুপ্রবেশ করে নাগরিককে ‘শৃঙ্খলাবদ্ধ সত্তা’তে রূপান্তর করে। এই নিয়ন্ত্রিত সংস্কৃতিতে নাগরিক নিজেই বুঝে নেয় তাকে কী বলা উচিত আর কী নয়; সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কোন ক্লিক নিরাপদ বা কোন মন্তব্য বিপজ্জনক।
এই আত্মনিয়ন্ত্রণের সংস্কৃতিকে আরো টেকসই করার জন্য একটি বড় কৌশল হয়েছে তথাকথিত ‘উন্নয়ন মিথ’—যেখানে বলা হয়, ‘উন্নয়ন হচ্ছে, তাই স্বাধীনতা নয়, কৃতজ্ঞতা দেখাও’। এর ফলে প্রশ্ন, মতপ্রকাশ, ন্যায্যতা, এমনকি মানবাধিকার—সবকিছুই হয়ে পড়ে গৌণ। ‘উন্নয়ন’ হয়ে উঠে এক মহাশব্দ, যার অন্তরালে লুকিয়ে থাকে দমন, দুর্নীতি ও গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি।
এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ প্রকল্প আসলে গড়ে তুলেছে এক তথ্যগ্রাহী কিন্তু চিন্তাহীন নাগরিকগোষ্ঠী। যে স্মার্টকার্ড গ্রহণ করে, ফর্ম পূরণ করে, ক্যামেরার সামনে দাঁড়ায়, অথচ রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করে না। তারা উদ্বিগ্ন থাকে ‘সার্ভার আপডেট’ নিয়ে, কিন্তু নিরুত্তাপ থাকে ‘গণতন্ত্র’ শব্দটির সামনে।
এই একমুখী নীরবতার প্রতিরোধে ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব এক মোড়বদলের আভাস দেয়। এটি শুধু রাজপথের উত্তাপ নয়, বরং ডিজিটাল পরিসরেও বিকল্প বয়ান নির্মাণের সূচনা। তরুণদের একাংশ ভিডিও, ইনফোগ্রাফিক, প্রামাণ্যচিত্র, অনুবাদ ও সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে তৈরি করে চিন্তাশীল ডিজিটাল প্রতিবাদ।
তারা দেখিয়ে দেয়, তথ্যপ্রযুক্তি শুধু রাষ্ট্রীয় নজরদারির বাহন নয়—বরং তা হয়ে উঠতে পারে বিকল্প সংগঠনের হাতিয়ার। গ্রামশির ভাষায়, তারা হয়ে ওঠে ‘অর্গানিক ইন্টেলেকচুয়াল’—যারা বিদ্যমান বাস্তবতার মুখস্থ ভাষা নয়, বরং নতুন প্রতিরোধী ভাষ্য নির্মাণে পারদর্শী।
এই তরুণদের চিন্তায় স্পষ্ট হয়—‘স্মার্টফোন’ মানেই টিকটক নয়, বরং রাষ্ট্রচিন্তার জন্য এক মোবাইল মঞ্চও হতে পারে। ফেসবুক পোস্ট হতে পারে ইতিহাসের দলিল। টেলিগ্রাম চ্যানেল হতে পারে গোপন বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রামের মাধ্যম। তাদের মধ্যে অনেকে শুধু প্রযুক্তিতে দক্ষ নয়, বরং নৈতিকভাবে দৃঢ় এবং রাজনৈতিকভাবে জাগ্রত।
এই অভিজ্ঞতাই আমাদের সামনে খুলে দেয় এক বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তার পথ—যাকে আমরা বলি ক্রিটিক্যাল বাংলাদেশ, অর্থাৎ এক চিন্তাশীল, নৈতিক এবং জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রের কল্পনা, যা প্রচলিত উন্নয়ন-মিথের বাইরে বিকল্প বাস্তবতা নির্মাণে উৎসাহী। এটি কোনো সরকারি প্রকল্প নয়—এটি চিন্তাশীল, জবাবদিহিমূলক, নৈতিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে মুক্ত একটি রাষ্ট্রের স্বপ্ন। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় মানে শুধু স্লাইড নয়—বরং বিতর্ক ও মতপার্থক্যের চর্চা। মিডিয়া হবে প্রোপাগান্ডার যন্ত্র নয়—সত্য অনুসন্ধানের পাটাতন। তরুণরা হবে ভোটার নয়—চিন্তার সহনির্মাতা, প্রযুক্তি হতে পারে নাগরিকের সহযোগী কিন্তু নিয়ন্ত্রণের মাধ্যম হলে তা গণতন্ত্রের ঘাতক। প্রশ্নহীন উন্নয়ন হয়ে ওঠে আধুনিক দাসত্ব।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে—আমরা কেমন বাংলাদেশ চাই? যেখানে নাগরিককে এক ক্লিকেই চুপ করিয়ে দেওয়া যায়, না কি এমন এক বাংলাদেশ, যেখানে একটি প্রশ্নই সিস্টেমকে জবাবদিহির মুখে ফেলে দিতে পারে?
বাংলাদেশের অনেক তরুণ এখনো রাজনীতিবিমুখ, কারণ তাদের শৈশব কেটেছে ভয়, নজরদারি ও অপপ্রচারের ভেতর দিয়ে। সরকারি মিডিয়া তাদের সামনে হাজির করেছে এমন এক আদর্শ—যেখানে বিরোধিতা মানে দেশদ্রোহী, প্রশ্ন মানেই ষড়যন্ত্র এবং সমালোচনা মানে বিদেশি এজেন্ডা। এভাবে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ পরিণত হয়েছে এক নিয়ন্ত্রিত তথ্যব্যবস্থায়, যেখানে বাইরের আলোর ঝলক থাকলেও ভেতরে জ্ঞানের ঘন অন্ধকার।
তবু এখনো এমন তরুণ আছেন, যারা শুধু ‘ডিজিটাল স্কিল’ নয়, বরং ‘চিন্তার স্কিল’ অর্জন করছেন। যারা জানেন কীভাবে তথ্য বিশ্লেষণ করতে হয়, কীভাবে ফ্যাক্ট চেক করতে হয় এবং কীভাবে নিজের ভাষা ও দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে হয়।
এই তরুণদের হাত ধরেই তৈরি হতে পারে নতুন নাগরিক সমাজ, যা আর কাগজে-কলমে নয়, বরং নৈতিক সাহস, বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি ও রাজনৈতিক জবাবদিহির ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। আমরা এমন একটি বাংলাদেশ চাই, যেখানে প্রযুক্তি বিচ্ছিন্নতার হাতিয়ার নয়—বরং সংযুক্তির মাধ্যম। যেখানে প্রতিটি মোবাইল ফোন শুধু সেলফির যন্ত্র নয়—বরং সত্যের সাক্ষ্য।
এবং এখানে ক্রিটিক্যাল বাংলাদেশ শুধু রাজনৈতিক প্রতিবাদ নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক ও নৈতিক পুনর্গঠন। এটি বলে : রাষ্ট্রের বয়ানকে প্রশ্ন করো, মিডিয়ার ভাষ্যকে যাচাই করো এবং নিজের জায়গা থেকে নতুন বয়ান তৈরি করো, যা প্রতিক্রিয়াশীল নয়, বরং মুক্তিকামী, ভবিষ্যৎমুখী ও সৃজনশীল।
ছাত্র-জনতা বিশ্বাস করে—নতুন বাংলাদেশের দুয়ার খুলেছে আর সেই আশার কেন্দ্রে আছে এই চিন্তাবিপ্লবী প্রজন্ম। যদি রাষ্ট্রচিন্তার ভার এই প্রজন্মের হাতে আসে, তবে সেখানে উন্নয়ন হবে অংশগ্রহণমূলক, গণতন্ত্র হবে প্রশ্ননির্ভর আর প্রযুক্তি হবে মুক্তির পথ।
নতুন প্রজন্মের প্রতি একটাই অনুরোধ—চুপ থেকো না। কারণ, নীরবতা অন্যায়ের এক ধরনের অংশীদারত্ব। প্রশ্ন করো—কারণ প্রশ্নহীন উন্নয়ন মানেই এক ধরনের নিঃশব্দ মৃত্যু। আর একমাত্র প্রশ্নই পারে, সেই মৃত্যুকে প্রতিহত করতে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান
ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি