editorialbd-logo

মতামত

প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোয়ানের দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) টানা ক্ষমতায় থাকার দুই যুগ পূর্ণ করেছে গত ১৪ আগস্ট। দলটির নেতাকর্মীরা এদিন ক্ষমতায় একেপির আসার ২৪তম বার্ষিকী আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্‌যাপন করেছেন। আধুনিক তুরস্কের গত ১০০ বছরের ইতিহাসে এটি একেপির অনন্য একটি রেকর্ড। এর আগে আর কোনো দল একটানা দুই যুগ ক্ষমতায় ছিল না, বা থাকতে পারেনি। কিন্তু নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে একেপি ক্ষমতায় টিকে আছে এবং আরো দীর্ঘ সময় দলটি জনগণের ম্যানডেট নিয়ে ক্ষমতায় থাকার ব্যাপারে আশাবাদী। একেপির এই সাফল্যের মূল কৃতিত্ব প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের। তার ক্যারিশমেটিক নেতৃত্বের গুণেই দলটি তুরস্কের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠেছে এবং জনগণের মধ্যে জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। আগামী দিনে এই জনসমর্থন ধরে রাখতে সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারলে একেপি’কে ক্ষমতা থেকে সরানো সহজ হবে না।

২০০১ সালে জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) গঠনের পর দেওয়া প্রথম ভাষণে এরদোয়ান বলেছিলেন, ‘তুরস্কের রাজনীতিসহ কোনো কিছুই আর আগের মতো থাকবে না।’ এরপর কেটে গেছে ২৪টি বছর। এই দীর্ঘ সময়ে এরদোয়ান তার দলের মাধ্যমে তুরস্কের অনেক কিছুই বদলে দিয়েছেন। কিন্তু দলটির নেতা হিসেবে এরদোয়ান এখনো বহাল রয়েছেন। তার দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণেই একেপি তুরস্কের রাজনীতিতে ইতিহাস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে।

তুরস্ক এমন একটি দেশ যেখানে কোয়ালিশন বা জোট সরকারের স্থায়িত্ব হয় স্বল্পমেয়াদি। দলগুলো প্রায় সময়ই জনসমর্থন হারিয়ে ফেলে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়। অথবা ক্ষমতাসীন জোটের মধ্যে ভাঙনের কারণে সরকারের পতন ঘটে। এরপর ক্ষমতার বাইরে থাকার কারণে অনেক বড় দলেরও ধীরে ধীরে বিলুপ্তি ঘটেছে।

তুরস্কে প্রথম সত্যিকারের গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫০ সালে। কিন্তু এর পর থেকে পরবর্তী দশকগুলোয় দেশটির গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বারবার বাধাগ্রস্ত হয় সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে। কোনো দল বা জোটই বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের কারণে। সেদিক থেকে একেপি ক্ষমতায় টিকে থাকার বিরল এক রেকর্ড গড়েছে। দলটি ২০০১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার পর থেকে জনপ্রিয়তা ধরে রেখে টানা দুই যুগ ধরে ক্ষমতায় টিকে আছে।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, একেপির এই সাফল্যের চাবিকাঠি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব এবং ভোটারদের মধ্যে তার ও একেপি’র ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা। জনপ্রিয়তার দিক থেকে একেপির ধারেকাছে নেই কোনো দল। প্রধান বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টি (সিএইচপি) জনসমর্থনের দিক থেকে একেপির চেয়ে অনেক পেছনে পড়ে আছে। দলটি নির্বাচনী জোট গঠন করেও একেপিকে হারাতে পারছে না। অবশ্য বিরোধীদের মোকাবিলা করতে একেপিও জোট গঠন করে নির্বাচন ও সরকার গঠন করেছে। কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে, এরদোয়ান রাজনীতি থেকে অবসর নিলে একেপি ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

১৯২৩ সালে উসমানীয় সাম্রাজ্যের তুর্কিভাষী এলাকা আনাতোলিয়া ও পূর্ব থ্রাস নিয়ে মুস্তাফা কামালের (পরে কামাল আতাতুর্ক) নেতৃত্বে আধুনিক তুরস্ক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং তিনি হন প্রজাতন্ত্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট। ১৯৩৮ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলেন। ১৯৪৫ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি দেশটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয়। মূলত উদ্ভূত কিছু পরিস্থিতি মোকাবিলায় এর কোনো বিকল্প ছিল না দেশটির সামনে। যুদ্ধের পর দেশটি জাতিসংঘ ও ন্যাটোতে যোগ দেয়। এ সময় থেকে তুরস্কে বহুদলীয় রাজনীতির প্রবর্তন হয়।

১৯৬০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করে। ফলে ১৯৬০, ১৯৭১ ও ১৯৮০ সালে তুরস্কে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। এরপর সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয় ১৯৯৭ সালে। কিন্তু পরে আবার দেশটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে আসে।

সর্বশেষ ২০১৬ সালে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করা হয়। তবে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তুর্কি জনগণ ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এতে ব্যর্থ হয় সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা। ২০১৭ সালের গণভোটের পর থেকে প্রেসিডেন্টও জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হচ্ছেন। ২০১৮ সালে দেশটিতে প্রেসিডেন্টশাসিত সরকার ব্যবস্থা শুরু হয়।

২০২৩ সালের ১৪ মে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এরদোয়ানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিরোধী জোটের প্রার্থী ও প্রধান বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টির নেতা কামাল কিলিচদারোগলু। কিন্তু এই নির্বাচনে কোনো প্রার্থীই প্রদত্ত ভোটের ৫০ শতাংশ না পাওয়ায় নির্বাচন দ্বিতীয় দফায় গড়ায়, যা ছিল তুরস্কের শত বছরের ইতিহাসে প্রথম ঘটনা। এরদোয়ান অল্পের জন্য ৫০ শতাংশের বাধা পার হতে পারেননি। এরদোয়ান পেয়েছেন ৪৯ দশমিক ৫ শতাংশ ভোট। তার প্রধান কামাল কিলিচদারোগলু পেয়েছেন ৪৩ দশমিক ১২ শতাংশ ভোট। তবে দ্বিতীয় দফায় এরদোয়ান খুব সহজেই তার প্রতিদ্বন্দ্বী কিলিচদারোগলুকে হারিয়ে নিজের ক্ষমতা ধরে রাখেন।

১৪ মে’র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিন পার্লামেন্টের ৬০০ আসনেও ভোট গ্রহণ করা হয়। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হয় এরদোয়ানের দল একে পার্টি নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন জোট পিপলস অ্যালায়েন্স। এই জোট পায় ৩২৩টি আসন। এর মধ্যে একে পার্টি একাই ২৬৭টি আসনে জয়ী হয়। ক্ষমতাসীন জোটের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স পায় ২১১ আসন। তবে ২০২৪ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে রাজধানী আঙ্কারা ও বৃহত্তম নগরী ইস্তাম্বুলের মেয়র পদে বিরোধী প্রার্থীদের বিজয় ক্ষমতাসীন একেপির জন্য একটি সতর্কবার্তা বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

অনেক বিশ্লেষকের মতে, ২০০১ সালে একেপি গঠনের পর ২০০২ সালেই দলটির ক্ষমতায় আসার একটি বড় কারণ ছিল সমাজের অবহেলিত ভোটারদেরকে কাছে টানা। এছাড়া ডানপন্থি বা রক্ষণশীল মনোভাবের মুসলিম ভোটার, যারা কামাল আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিকে পছন্দ করতেন না, তাদের সমর্থনও পায় একেপি। দলটির নেতাকর্মীরা ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের কাছে একেপির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ব্যাখ্যা করে তাদের মন জয় করার চেষ্টা করেছিল। এছাড়া একেপি কট্টর ডান বা বাম রাজনীতি বর্জন করে মধ্যপন্থার ধর্মীয় রাজনীতি অনুসরণ করায় দলটির প্রতি সাধারণ মানুষের আকর্ষণ তৈরি হয়।

এতে যথেষ্টই কাজ হয়েছিল ২০০২ সালের ওই নির্বাচনে। সমাজের সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে সব সময়ই যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিল একেপির নেতাকর্মীরা। দলটির নারী কর্মীরা প্রতিটি ঘরে গিয়ে নারী ভোটারদেরকে একেপির পক্ষে টানার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। দেশের অবকাঠামো ও সরকারি সেবার উন্নয়ন, শাসন ব্যবস্থার সংস্কার, নতুন ও আধুনিক সড়ক, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিমানবন্দর নির্মাণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

এই কৌশলে প্রথম নির্বাচনেই বাজিমাত করেছিল একেপি, যা এর আগে দেশটির আর কোনো দল করতে পারেনি। কারণ এসব দল তাদের পুরোনো নির্বাচনী কৌশল নিয়েই পড়েছিল। এছাড়া এরদোয়ান ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ইস্তাম্বুলের মেয়র হিসেবে যথেষ্ট সফলতার পরিচয় দেন, যা পরবর্তী সময়ে তার রাজনৈতিক দল গঠন এবং ২০০২ সালের নির্বাচনে জয়লাভে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

তুরস্কে ১৯৮৪ সালের পর প্রথম দল হিসেবে একেপি ২০০২, ২০০৭, ২০১১ ও ২০১৪ সালে পার্লামেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে এককভাবে সরকার গঠন করে। এরদোয়ান ২০০৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর প্রেসিডেন্ট হন এবং ২০১৭ সালে দেশে প্রেসিডেন্টশাসিত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। ফলে আগে এমপিদের ভোটে নির্বাচিত হলেও এখন জনগণের সরাসরি ভোটে প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতায় আসতে হয়।

সময়ের পরিক্রমায় একেপি তার নিজস্ব একটি আদর্শিক রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তি ও দর্শন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। আধুনিক তুরস্ক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ পূর্তি উদ্‌যাপন উপলক্ষে ২০২৩ সালে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ‘সেঞ্চুরি অব দ্য টার্কি’ নামে যে ভিশন তুলে ধরেছেন, সেটাকেই বর্তমানে দলটির নেতাকর্মীরা তাদের প্রচারণার হাতিয়ার করেছেন। এই প্রচারণায় তরুণসমাজকে টানার চেষ্টা করছে একেপি।

২০২৮ সালের নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতা ধরে রাখার লক্ষ্যে মাঠে নেমেছে একেপি। তবে এরদোয়ান বলেছেন, তিনি এরপর আর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবেন না। তার কথা যদি সত্য হয়, তাহলে এরদোয়ানবিহীন একেপির ভবিষ্যৎ কী হবে, দলটি ক্ষমতায় কত দিন টিকে থাকতে পারবে, তা নিয়েও তুর্কি জনগণের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে এরই মধ্যে।

ডেইলি সাবাহ থেকে ভাষান্তর : মোতালেব জামালী

সূত্র, আমার দেশ