পৃথিবীতে আমাদের সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ সন্তান। সবাই চাই, আমাদের যেন চক্ষু শীতলকারী সন্তান হয়। কিন্তু এটা শুধু মুখে মুখে চাই, সন্তানকে সেভাবে গড়ে তুলতে আমাদের তেমন কোনো প্রচেষ্টা নেই। বরং তাদের এমনভাবে বড় করি, তারা অনেক ক্ষেত্রে উল্টো আমাদের কষ্টের কারণ হয়। রসুল (সা.) বলেছেন, প্রত্যেক সন্তান ইসলামের স্বভাবের ওপর জন্মগ্রহণ করে। অতঃপর তার মা-বাবাই তাকে ইহুদি, খ্রিস্টান কিংবা অগ্নি-উপাসক বানায় (বোখারি)। এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, বখে যাওয়ার পেছনে যতটা না দায় সন্তানের নিজের, তার চেয়ে বেশি দায় অভিভাবকদের। সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে ইমান, আত্মপরিচয়, ধর্মীয়, নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধকে আমরা উপেক্ষা করছি। সন্তানের ক্যারিয়ার, ইহজাগতিক সাফল্যই সবার কাছে হয়ে উঠছে প্রধান অর্জন। যার ফলে সন্তান আমাদের চক্ষু শীতলকারী সন্তান হয়ে উঠছে না।

কদিন আগে এসএসসি পরীক্ষার ফল বের হলো। প্রতি বছর এই রেজাল্টকে কেন্দ্র করে যে লাগামহীন উন্মাদনা দেখা যায়, সেটাও আমাদের ভোগবাদী মনোভাবের প্রমাণ। পরীক্ষায় ভালো ফল করা নিঃসন্দেহে আনন্দের। কিন্তু সেই আনন্দের উদযাপন নির্দিষ্ট মাত্রার ভিতর হওয়াই শোভন। এ দেশের মিডিয়াগুলোও এই পরীক্ষাকে ঘিরে যেভাবে সংবাদ প্রকাশ ও প্রচার করে, অন্য কোনো দেশে এর নজির আছে বলে জানা নেই।

এই অতি উন্মাদনার কারণেই পরীক্ষায় যারা ভালো করতে পারে না, তাদের ভিতর হীনম্মন্যতা তৈরি হয়, তারা ডিপ্রেশনে চলে যায়। একপর্যায়ে অনেকে আত্মহত্যার মতো ভয়ংকর সর্বনাশা পথও বেছে নেয়। শিক্ষার্থীদের এই হতাশা থেকে ঝরে পড়ার পেছনে তাদের প্রতিযোগিতার বাজারে ছেড়ে দেওয়া মা-বাবাদেরও দায় রয়েছে।

সামগ্রিক জীবনে সাফল্যের তুলনায় একটি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করা আঁচড় রেখে যাওয়ার মতো বড় কোনো ঘটনা নয়। তারপরও এই উন্মাদনা প্রমাণ করে, আমরা দিনদিন খুব বেশি ভোগবাদী, বস্তুবাদী এবং পরকাল ভোলা ইহজাগতিক মানুষ হয়ে উঠছি।

খুব কম বাবা-মাই আছেন, সন্তানের সৎ কাজকে যারা উচ্ছ্বাসভরা হৃদয়ে অভিনন্দিত করেন। বিপদের মুখেও ছেলে সত্য কথা বলেছে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে, সুযোগ থাকার পরও ঘুষ নেয়নি-এই আনন্দে বাবা-মা কখনো মিষ্টি বিতরণ করেছেন, দেশের ইতিহাসে এমন ঘটনা হয়তো একবারও ঘটেনি। অথচ জিপিএ-৫ পেলে মিষ্টির বন্যা বইয়ে দেব-এমন ঘোষণা অহরহ শুনছি। এবং ফল প্রকাশের দিন সব দোকানের মিষ্টি শেষ হয়ে যেতে দেখছি।

সততা নয় বরং পরীক্ষায় পাস করাই জীবনের প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠায় অনেক বাবা-মা প্রয়োজনে সন্তানের নকল করারও অনুমোদন দেন। পাশের ভালো ছাত্রের খাতা দেখে লিখতে না পারলে অনেক সন্তান ভর্ৎসনার শিকার হয়। কী অদ্ভুত মনোবৈকল্য!

জিপিএ-৫ সাময়িকের সাফল্য। কিন্তু মুমিনের জীবনে চূড়ান্ত সাফল্য তো তখনই আসবে, যখন সে জাহান্নাম থেকে বেঁচে চিরসুখের জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে এটাকেই আসল সফলতা বলেছেন (আলে ইমরান ১৮৫)।

আমরা প্রায় সবাই ছোটবেলায় মা-বাবার শাসনের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি। এই পরিণত বয়সে এসেও সেসব দৃশ্য যখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বাবা-মায়ের প্রতি শ্রদ্ধায় নুয়ে পড়ে হৃদয়, চক্ষু হয়ে ওঠে অশ্রুসজল। তাদের সেসব আদরমাখা শাসনই আমাদের আজকের সাফল্যের সিঁড়ি। আজ এই মুহূর্তে একটি কথা বড় বেশি মনে হচ্ছে, তাদের শাসন ছিল অন্যদের আদরের চেয়েও মূল্যবান, জীবনের পথনির্দেশক।

আজকাল যে প্রায়ই সন্তানরা স্বপ্নভঙ্গ করছে, এর দায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে মা-বাবাদেরই। পশ্চিমা সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আমরা অনেক বেশি বস্তুবাদী, ভোগবাদী, আত্মকেন্দ্রিক ও ক্যারিয়ারিস্ট হয়ে উঠছি।

ফলে একটা সময় আমাদের সন্তানরা হয়ে উঠছে স্বেচ্ছাচারী, উচ্ছৃঙ্খল, বেপরোয়া। তার চূড়ান্ত প্রকাশও ঘটছে ছেলেমেয়েদের দুই-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনায়।

এরপরও যদি আমরা না শোধরাই, পড়াশোনার পাশাপাশি সন্তানকে আত্মপরিচয় ও মূল্যবোধ না শেখাই, তবে আফসোস, হতাশা ও স্বপ্নভঙ্গের বেদনাই হবে চিরসাথি। সেই দুর্দিন আসার আগেই আসুন সচেতন হই।

জুমার মিম্বর থেকে বয়ান গ্রন্থনা : সাব্বির জাদিদ

সূত্র, বাংলাদেশ প্রতিদিন