মহররম হিজরি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। মহররম শব্দের অর্থ সম্মানিত। ইসলামে এ মাসের সঙ্গে অনেক ঘটনার স্মৃতি জড়িত। এসব স্মৃতির সম্মানার্থে এ মাসকে মহররম বা সম্মানিত বলে নামকরণ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনের সুরা তাওবার ৩৬ আয়াতে এরশাদ হয়েছে: ‘আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা ১২। এর মধ্যে চারটি মাস (মহররম, রজব, জিলকদ, জিলহজ) সম্মানিত’।
আল্লাহতায়ালা কোরআন মাজিদের সুরা বাকারার ১৮৯ আয়াতে হিজরি সময়ের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেন: লোকেরা আপনার কাছে নতুন চাঁদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। আপনি তাদের বলে দিন, এটা মানুষের বিভিন্ন কাজকর্মের হিসাব এবং হজের সময় নির্ধারণ করার জন্য।
মুসলমানদের বহু দ্বীনি বিষয়, বিশেষ করে হজের মতো মহিমান্বিত আমল নির্ভরশীল চাঁদের হিসাবের ওপর। আরবি মাস-বছর ঘিরে ইসলামের বহু বিধান আবর্তিত হয়। এই আরবি হিজরি চান্দ্রবর্ষের প্রথম মাসটিই হচ্ছে মহররম। মহররম ঘিরেও রয়েছে শরিয়তের বিধান ও আমল। ফলে ইমানি দায়িত্ববোধ থেকেই হিজরি মাস-বর্ষের গণনার হিসাবের প্রতি যত্নবান হওয়া মুমিনের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
আশুরা শব্দটি আরবি ‘আশারা’ থেকে এসেছে, যার অর্থ ১০। মহররম মাসের ১০ম দিনকে আশুরা বলে। সৃষ্টির শুরু থেকে ১০ মহররম তথা আশুরার দিনে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। সর্বশেষ ৬২ হিজরি সনে ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে আমাদের প্রিয় নবী (সা.)-এর দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসেইন (রা.)-এর শাহাদত এই দিনকে বিশ্ববাসীর কাছে স্মরণীয় ও বরণীয় করে রেখেছে।
আশুরার দিনে আল্লাহতায়ালা পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করেছেন এবং জান্নাতে স্থান দিয়েছেন। এই দিনে নূহ (আ.)-এর কিস্তি প্লাবন থেকে রক্ষা পেয়েছিল। হজরত মুসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীরা ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন।
এদিন হজরত ইব্রাহিম (আ.) জালিম বাদশাহ নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে ৪০ দিন পর নিরাপদে মুক্তি পান। এদিন হজরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি পান। আশুরার দিনে হজরত আইয়ুব (আ.) রোগমুক্তি লাভ করেন। এই দিনে হজরত সুলায়মান (আ.) তাঁর হারানো রাজত্ব ফিরে পান। হজরত ইয়াকুব (আ.) তাঁর হারানো পুত্র হজরত ইউসুফ (আ.)-কে ৪০ বছর পর ফিরে পান।
এই দিনে হজরত ঈসা (আ.) জন্মগ্রহণ করেন এবং এদিনেই তাঁকে দুনিয়া থেকে আকাশে উঠিয়ে নেওয়া হয়। আশুরার দিনে আরও বহু ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল।
পূর্বে মুসলমানদের জন্য আশুরার রোজা ফরজ ছিল। দ্বিতীয় হিজরির শাবান মাসে রমজানের রোজা ফরজ হলে আশুরার রোজা সুন্নত হয়ে যায় (আবু দাউদ)।
হাদিস শরিফে বর্ণিত, হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় আগমন করে ইয়াহুদিদের মহররম মাসের ১০ তারিখে রোজা রাখতে দেখে বললেন, এটা কীসের রোজা?
তারা জানাল, এটি একটি উত্তম দিন; এই দিনে আল্লাহতায়ালা ফেরাউনের হাত থেকে হজরত মুসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের মুক্ত করেছিলেন।
এ কথা শুনে তিনি বললেন, ‘হজরত মুসা (আ.)-এর ব্যাপারে তোমাদের চেয়ে আমিই বেশি হকদার। অতঃপর তিনি নিজে রোজা রাখলেন এবং সাহাবাদেরও রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন।’ (বুখারি)
আশুরার রোজার ফজিলত সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আশুরার দিনের রোজার ব্যাপারে আল্লাহর নিকট আমি আশাবাদী, তিনি পূর্বের এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন’ (মুসনাদে আহমাদ)।
অপর হাদিসে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আশুরার দিনে পরিবারের ব্যয় বৃদ্ধি করবে, ভালো খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করবে; আল্লাহতায়ালা সারাবছর তার প্রাচুর্য বাড়িয়ে দেবেন’ (আবু দাউদ)। আল্লাহতায়ালা মুসলিম উম্মাহকে মহররম মাসের মর্যাদা রক্ষার তাওফিক দান করুন।
ড. মো. শাহজাহান কবীর: চেয়ারম্যান, ইসলামিক
স্টাডিজ বিভাগ, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি