দারুণ তার সাহসী ও সংগ্রামী জীবন। আমরা তাকে খালাম্মা ডাকতাম। দীর্ঘদিন তার সঙ্গে আমাদের জানাশোনা। ড. মাহমুদুর রহমান তার একমাত্র সন্তান। যারা মাহমুদুর রহমানের সাহস, সংকল্প ও দৃঢ়তা দেখেছেন, তারা তাকে কল্পনা করতে পারবেন, তিনি তারই জননী : তার নাম মাহমুদা বেগম। নিজের নামটাই ছেলেকে দিয়েছেন, তার মুখের আদলও এই একমাত্র সন্তান পেয়েছেন। শিক্ষকতা পেশায় থেকে ছেলেকে পড়াশোনা করিয়ে নিজে মানুষ করেছেন। যাকে বলে মানুষ করা, তার চেয়েও বেশি করেছেন। মাহমুদুর রহমান আজ যেভাবে সারা দেশে পরিচিত এবং যে পর্যায়ে আছেন, তাতে তার মায়ের অবদান শতভাগ। যেদিন থেকে তাকে একটু চিনতে পেরেছি, তখনই এই সত্য আমাদের অনেকেরই জানা হয়ে গিয়েছিল।

একটা দুঃসহ ও অবর্ণনীয় সময় পার করেছি আমরা। সে সময় মাহমুদ ভাই এবং ফিরোজা মাহমুদ (পারভীন)-এর বাসায় অন্য বন্ধুদের সঙ্গে প্রায়ই গিয়েছি। এক-এগারোর দুই বছর এবং তারপর ১৫ বছরের আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের সময়। বিভিন্ন সময় একত্র হয়েছি বন্ধু-বান্ধব মিলে মাহমুদ ভাইয়ের বাসায়। একদিক থেকে সেটা ছিল আমাদের প্রকট দুঃসময়ে সবাই মিলে বেঁচে থাকার সংগ্রাম, পাশাপাশি নানা পারিবারিক, সামাজিক ও বন্ধুত্বের গল্প ছাপিয়ে রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আড্ডা। সবাই নানাভাবে সক্রিয়।

আড্ডায় আমরা মেতে উঠতাম। ওরই মধ্যে বাসায় খালাম্মার নীরব উপস্থিতি আমরা টের পেতাম। একপর্যায়ে খালাম্মার সঙ্গে আমাদের দেখা হতো। তিনি আমাদের সঙ্গে কথা বলতে পছন্দ করতেন। কখন যে তার স্নেহের জালে জড়িয়েছি জানি না। দুঃশাসন ও স্বৈরশাসনে অতিষ্ঠ অবস্থায় সবার মধ্যেই উৎকণ্ঠ ও দুশ্চিন্তা। তিনি আমাদের রাজনৈতিক আড্ডায় পুরোপুরি শামিল না হলেও দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে ছিলেন সচেতন। সরকার দেশের মানুষের কত ক্ষতি করছে, সে বিষয়ে তিনি সবসময়ই ছিলেন সচেতন। তিনি খুবই উদ্বিগ্ন থাকতেন, কিন্তু আমাদের সাহস দিতে কার্পণ্য করতেন না।

আজ প্রিয় খালাম্মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। অনেক কথাই মনে পড়ছে এবং মনে হচ্ছে তাকে নিয়ে একটু লিখি। মাহমুদ ভাই আওয়ামী দুঃশাসনের আমলের চরম নিপীড়নের শিকার। সেই দুঃসময়ে তার সহধর্মিণী পারভীন এবং তার মাকে দেখেছি। ছেলেকে পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে, তিনি ডিবি অফিসের সামনে পারভীনের সঙ্গে সারারাত বসে থেকেছেন। মাহমুদ ভাই দীর্ঘ সময় কারাগারে ছিলেন। তখন তাকে কখনো কেঁদে-কেটে অস্থির হতে দেখিনি। অথচ জননী তিনি, মাহমুদ ভাই তার একমাত্র সন্তান। ভীষণ কষ্ট পাচ্ছেন মনের ভেতর। কীভাবে সহ্য করেছেন, আমরা বিস্মিত হয়েছি। অবাক হয়ে দেখেছি মাহমুদ ভাইয়ের কষ্টকে তিনি দেশের মানুষের কষ্ট হিসেবেই দেখেছেন। সবসময় দুঃশাসনের নিষ্ঠুরতা থেকে মানুষের মুক্তি কীভাবে হবে, সে বিষয়েই আমাদের কাছে বেশি জানতে চাইতেন। তার জানার বিষয় হতো এই ফ্যাসিবাদের শেষ কবে হবে?

মাহমুদ ভাই একপর্যায়ে দেশান্তরী হলেন। তুরস্কের ইস্তাম্বুলে তিনি ছিলেন প্রায় ছয় বছর। খালাম্মা ছিলেন ঢাকায় তাদের গুলশানের বাসায়। তাকে দেখার মানুষ ছিল, কিন্তু একা ঘরে তিনি যেন পাহারাদার হয়ে থাকতেন। সময় পেলেই তাকে মাঝেমধ্যে দেখতে গিয়েছিলাম। তিনি বলতেন, জানো মা, এখনো পুলিশ এসে বুলবুলের (মাহমুদ ভাইয়ের ডাক নাম) খোঁজ নেয়, গ্রেপ্তার করার জন্য ওত পেতে থাকে তারা। খালাম্মা এই কথা বলার সময় তার ক্ষোভ প্রকাশ পেত, কিন্তু কখনো তাকে কারো কাছে করুণা চাওয়া বা কারো কাছে মাথানত করে ছেলেকে রক্ষা করার চেষ্টা দেখিনি। এত কষ্টের মধ্যেও তার দৃঢ়তা চোখে পড়ার মতো ছিল। তিনি তো জানতেন না, মাহমুদ ভাই আর কখনো তার জীবদ্দশায় দেশে আসতে পারবেন কি না। তার পক্ষেও নানা কারণে তুরস্ক চলে যাওয়া সম্ভব ছিল না। দুই দেশে মা ও ছেলে টেলিফোনের মাধ্যমে কথাবার্তা বলতেন। নিজে অনেক অসুস্থ থাকলেও প্রকাশ করতেন না।

আসন বনাম আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থাআসন বনাম আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা

আমরা (আমি আর কবি ফরহাদ মজহার) ২০২২ সালে ইস্তাম্বুল গিয়েছিলাম। যাওয়ার আগে খালাম্মার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তিনি অনেক গল্প করলেন। দেখে মনে হচ্ছিল তিনি খুব সুস্থ নন, কিন্তু আমাকে বলে দিলেন বুলবুলকে এতসব বলো না, চিন্তা করবে। তার পক্ষে তো আসা সম্ভব না। তিনি রান্না করা মাছ-মাংস দিলেন। ফেরার পর আবার যখন দেখা করতে গেলাম, তখন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইলেন মাহমুদ ভাই আর পারভীন কেমন আছে। তাদের কষ্ট হচ্ছে কি না, যা দেখেছি তার বর্ণনা দেওয়ার পরও মনে হচ্ছিল তিনি আরো শুনতে চাচ্ছেন। আমরা নিজের চোখে দেখে এসেছি, দেখেছি তারা ভালো আছেন, এটাই যেন তিনি নিশ্চিত হতে চাচ্ছেন। অথচ মাহমুদ ভাই তুরস্কে থাকাকালে অনেকেই গেছেন এবং ফিরে এসে তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। নিশ্চয়ই সবাই এসে মাহমুদ ভাইয়ের কথা বলেছেন। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল তিনি যেন আমাদের কাছ থেকেই বিস্তারিত শুনতে চাচ্ছেন। ভালো আছেন শুনে তার মুখে একটু হাসি ফুটে উঠেছিল, সেটা এখন চোখে ভাসছে।

একটাই সান্ত্বনা, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর তার অসুস্থতার কারণে মাহমুদ ভাই দেশে ফিরলেন। তাকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলাম, প্রায় অচেতন ছিলেন; তবু খালাম্মা ডাকতেই যেন সাড়া দিলেন। তিনি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন বেশ কিছুদিন। এরই মধ্যে মাহমুদ ভাই দেশে ফিরে এলেন। আবার নতুন করে আমার দেশ প্রকাশ করলেন। মাহমুদ ভাই কিছুদিন মাকে আবার কাছে পেলেন। এইটুকু আমাদের জন্য সান্ত্বনা।

আমি তার হাসিমাখা মুখ দেখি। নিজের সন্তানের জন্য মায়ের ভালোবাসা-আকুতির বেদনা বুঝতাম। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে এক ধরনের দৃঢ় প্রশান্তি ছিল তার। সন্তান আর দেশকে তিনি আলাদা ভাবতেনÑআমাদের কখনো মনে হয়নি।

ধন্য তিনি। আল্লাহ তাকে ভালো রাখুন এই দোয়া করি।

সূত্র, আমার দেশ