গত বছর জুলাইয়ে শুরু হওয়া গণ-অভ্যুত্থানে উমামা ফাতেমা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তী সময় এই সংগঠনের মুখপাত্র হলেও সম্প্রতি সেখান থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন তিনি। গণ-অভ্যুত্থানের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি, জুলাইয়ের চেতনা ও ছাত্ররাজনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনজুরুল ইসলাম

প্রথম আলো: চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের সূচনা হয়েছিল শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। সেই আন্দোলন শুরু হয়েছিল গত বছরের জুলাইয়ে। আবার সেই জুলাই ফিরে এসেছে। আন্দোলনের সেই দিনগুলো নিয়ে ভাবলে এখন কী মনে হয়?

উমামা ফাতেমা: গত বছর জুলাইয়ের শুরু থেকেই সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আমাদের লাগাতার কর্মসূচি ছিল, প্রতিদিনই মিটিং-মিছিল হচ্ছিল। আমরা যারা আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সংগঠক ছিলাম, তারা অন্য সব কাজ বাদ দিয়ে তখন পুরো সময় আন্দোলনে নিয়োজিত হয়েছিলাম। সেই সময়ে শারীরিকভাবে যেমন আমাদের ওপর অনেক চাপ গেছে, তেমনি মানসিকভাবেও খুব উৎকণ্ঠায় ছিলাম।

গত বছরের ১৪ জুলাই দিনটার কথা মাঝেমধ্যে মনে পড়ে। ওই দিন বিকেলবেলা আমরা বঙ্গভবনের দিকে মিছিল করেছিলাম। এরপর সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ কথাটা বলেন। তাঁর এই তাচ্ছিল্য আমরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারিনি। সারা দিন মিছিল-মিটিং করে আমরা শারীরিকভাবে ক্লান্ত ছিলাম। এরপরও হাসিনার কথার প্রতিবাদ জানাতে আমরা রাত ১০টার দিকে হল থেকে বেরিয়ে এসে আবারও মিছিল করি।

১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ও বহিরাগত সন্ত্রাসীরা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালিয়েছিল। সেই হামলায় নারী শিক্ষার্থীসহ অনেকে আহত হয়েছিলেন। এরপর ১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে রংপুরে আবু সাঈদসহ দেশের অন্যান্য স্থানে বেশ কয়েকজন নিহত হন। এরপর আন্দোলনের মোড় অন্যদিকে ঘুরে যায়। গত বছর জুলাইয়ের দিকে ফিরে তাকালে দেখি, সেই সময় আমাদের মধ্যে একটা অসম্ভব সাহস ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ছিল। সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে একটা অভূতপূর্ব ঐক্য লক্ষ করা গিয়েছিল, দল-মতনির্বিশেষে সবাই এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছিল। সেই দিনগুলোর কথা ভাবলে জুলাইয়ের ওই ঐক্যের কথাই আমার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে, যে ঐক্য এখন আর আগের মতো নেই।

প্রথম আলো: আন্দোলন শুরু হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে ছাত্রদের মধ্য থেকে। এরপর তা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। শিক্ষার্থী ও জনতার মধ্যে এই যোগসূত্র কীভাবে হয়েছিল?

উমামা ফাতেমা: যত দিন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খোলা ছিল, তত দিন এটা শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আন্দোলন ছিল। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ হয়ে গেলে আন্দোলন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। রামপুরা-বাড্ডার দিকে যখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছিল, তখন তাদের সঙ্গে স্থানীয় সাধারণ মানুষ, দোকানদার বা হকাররাও ছিলেন। যাত্রাবাড়ী, মিরপুর ও মোহাম্মদপুরের দিকেও একই রকম ঘটনা ঘটেছে। গাজীপুরের দিকে অনেক শ্রমিক আন্দোলনে অংশ নেন। একটা পর্যায়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। এভাবেই আন্দোলন সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।

চব্বিশের অভ্যুত্থানে আমি আলাদা করে ছাত্রদের সিগনিফাই (চিহ্নিত) করতে চাই না, এটাকে আমি সরাসরি গণ-অভ্যুত্থানই বলি। দীর্ঘ একটি স্বৈরশাসনের কারণে বাংলাদেশের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। একের পর এক ভুয়া নির্বাচন হয়েছে, মানুষ ভোট দিতে পারেনি; দুর্নীতি, লুটপাট চলেছে অবাধে। এসবের ফলে অভ্যুত্থান হওয়ার মতো পরিস্থিতি আগে থেকেই তৈরি ছিল। ছাত্রদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এটার সূচনা হয় এবং জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এতে অংশ নেয়।

প্রথম আলো: আপনি বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্যসচিব ছিলেন। ৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেখান থেকে পদত্যাগ করে আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মুখপাত্র হয়েছিলেন। সম্প্রতি আপনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা জানিয়েছেন। কোন প্রেক্ষাপটে, কেন এই সিদ্ধান্তগুলো নিতে হলো, একটু বিস্তারিত বলবেন?

উমামা ফাতেমা: গণ-অভ্যুত্থানের অল্প কিছুদিন পরই আমি ছাত্র ফেডারেশন ছেড়েছিলাম। আমার উপলব্ধি হয়েছিল, দেশকে নতুন করে গড়ে তোলার সময় এসেছে। তখন নির্দিষ্ট কোনো সংগঠন নয়, আমি দেশের জন্য কাজ করতে চেয়েছিলাম।

অভ্যুত্থানের কয়েক দিন পর বন্যা হয়েছিল, আমরা বন্যার ত্রাণের জন্য অর্থ সংগ্রহ ও ত্রাণ পাঠানোর কাজ করেছিলাম। সেই সময় আমরা মানুষের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পেয়েছিলাম। এ রকম আরও অনেক কাজের মাধ্যমে আমি সাধারণ মানুষের সঙ্গে বেশি বেশি সম্পৃক্ত থাকতে চেয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম, অভ্যুত্থানের পরে দেশ একটা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং আমাকে সেটার মধ্যে থাকতে হবে। দেশের জন্য আমার সর্বোচ্চটা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম।

এ রকম সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তারা আমাকে দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলে এবং আমাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়ার আশ্বাসও দেয়। বড় প্ল্যাটফর্মে দেশের জন্য কাজ করার আগ্রহ ও দায়বদ্ধতা থেকে আমি সেখানে যুক্ত হয়েছিলাম। আমার প্রত্যাশা ছিল, সেখানে গেলে অনেকগুলো জরুরি প্রশ্ন তুলে ধরতে পারব, নারীদের আরও ভালো প্রতিনিধিত্ব করতে পারব। কিন্তু যুক্ত হওয়ার পরে আমি বুঝতে পারি, ওই প্ল্যাটফর্ম খুবই অগোছালো ও ঝামেলপূর্ণভাবে চলছে। কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হলেও সংগঠনটি চলছিল দু-তিনজন নেতার কথায়, অন্যদের কথা বলার সুযোগ ছিল না।

আন্দোলন-অভ্যুত্থানের সময় অনেক ভালো ছেলেমেয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। ৫ আগস্টের পর থেকেই তাদের যুক্ত থাকার সুযোগ কমতে থাকে। অন্যদিকে সুবিধাবাদীদের ভিড় বাড়ছিল, কয়েকজন নেতার ইচ্ছেমতো একের পর এক কমিটি দেওয়া হচ্ছিল। আমি এসব দেখে কিছুটা হতাশ হয়েছিলাম। চেষ্টা করেছিলাম বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন তোলার, কিন্তু তখন সে রকম পরিবেশ ছিল না। নেতারা নানা রেটরিক বা বিপ্লবী কথাবার্তা বললেও সংগঠনের ভেতরে আসলে ক্ষমতার কামড়াকামড়ি চলছিল। মনে হচ্ছিল, ক্ষমতার কোনো একটা অংশের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে সেখানে সারভাইভ করতে হবে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যেহেতু আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম ছিল, তাই সেখান থেকে পদত্যাগ করার মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া আমার জন্য কঠিন ছিল। এ জন্য আমি একটু সময় নিয়েছি। বন্ধুবান্ধব, শুভাকাঙ্ক্ষীদের সঙ্গে কথা বলেছি। আমি চাইনি সংগঠনে কোনো বিভক্তি হোক, পারস্পরিক সম্মানের সম্পর্ক নষ্ট হোক। এ কারণে এই সংগঠনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পর্কচ্ছেদ করতে কিছুটা সময় লেগেছে।

প্রথম আলো: তাহলে কি আপনার একধরনের স্বপ্নভঙ্গ বা আশাভঙ্গ হলো?

উমামা ফাতেমা: আমি যে ধরনের পরিবর্তন চেয়েছিলাম, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্ল্যাটফর্মের মধ্য দিয়ে তা সম্ভব হয়নি; বরং এই প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করে অনেকে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিয়েছে। এ প্ল্যাটফর্মের কথা বললে অবশ্যই স্বপ্নভঙ্গের বিষয়টি স্বীকার করতে হবে। তবে অভ্যুত্থানকারী জনগণকে নিয়ে আমি আশাবাদী। এই জনগণই ভবিষ্যতে দেশের ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

প্রথম আলো: গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের একটি অংশের উদ্যোগে ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ বা এনসিপি নামে নতুন একটি দল গঠন করা হয়েছে। ছাত্রনেতাদের অনেকেই সেই দলে যোগ দিলেও আপনি সেখানে যাননি। সম্প্রতি এনসিপির পক্ষ থেকে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। এরপর আপনি বলেছেন, কোনো একটি দলের পক্ষে এককভাবে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ দেওয়া হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। আপনার এই অবস্থানকে একটু ব্যাখ্যা করবেন?

উমামা ফাতেমা: আমি মনে করি, এনসিপি বা কোনো একটি রাজনৈতিক দলের এককভাবে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ দেওয়ার এখতিয়ার নেই। এটা ঠিক যে এনসিপির কোনো কোনো নেতা অভ্যুত্থানের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, তাই বলে তাঁরাই অভ্যুত্থানের একমাত্র স্টেকহোল্ডার নন। ফেব্রুয়ারি মাসের আগপর্যন্ত এনসিপি নামে কোনো দলের অস্তিত্ব ছিল না, তাহলে জুলাই অভ্যুত্থানকে কেন এনসিপির সঙ্গে একাকার করে দেখা হবে?

কোনো দল যদি জুলাই অভ্যুত্থানকে এককভাবে নিজেদের দখলে রাখতে চায়, সেটা হবে মুক্তিযুদ্ধকে এককভাবে আওয়ামী লীগের দখলে রাখার মতো বিষয়। মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের সাধারণ জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। জুলাই অভ্যুত্থানেও একই রকম ঘটনা ঘটেছে। এককভাবে গণ-অভ্যুত্থানের কৃতিত্ব দাবি করার কোনো সুযোগ কোনো একটি দলের নেই।

জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে সামনে রেখে কোনো দল তাদের নিজস্ব রাজনীতি করতেই পারে, কিন্তু তারা এককভাবে জুলাই ঘোষণাপত্র কেন দেবে? বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটা দেওয়ার একমাত্র এখতিয়ার রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো সরকারকে চাপ দিতে পারে বা সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করতে পারে, যাতে দ্রুত জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়া হয়।

প্রথম আলো: ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে অংশ নেওয়া নারীদের ‘ম্যাডেলিন অলব্রাইট অনারারি গ্রুপ অ্যাওয়ার্ড’ দেওয়ার কথা ঘোষণা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর। আপনি ব্যক্তিগতভাবে সেই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন। এর কারণ কী ছিল?

উমামা ফাতেমা: ফিলিস্তিনে বহুদিন ধরে ইসরায়েলি আগ্রাসন চলছে এবং সম্প্রতি হামাসকে দমন করার নামে ইসরায়েল গাজায় একটা গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই আমি পুরস্কারটি প্রত্যাখ্যান করেছি। কারণ, ওই পুরস্কার একজন ইসরায়েলি নারীকেও দেওয়া হয়েছিল। এ ঘটনা থেকে বোঝা যায়, এসব পুরস্কারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে এবং যুক্তরাষ্ট্র আসলে কাদের ফেভার করতে চায়। ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন ও সংহতি প্রকাশ করতেই আমি ব্যক্তিগতভাবে পুরস্কারটি প্রত্যাখ্যান করি।

প্রথম আলো: আন্দোলন-অভ্যুত্থানে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও পরবর্তী সময় তাঁদের খুঁজে না পাওয়া বা হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টি বহুল আলোচিত। এ রকম একটি অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানের পরও কেন তাঁদের ধরে রাখা গেল না?

উমামা ফাতেমা: গণ-অভ্যুত্থানের পর একটা অংশের মেয়েরা নিজে থেকেই নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। আরেকটা অংশের মেয়েরা, যাঁরা সক্রিয় থাকতে চেয়েছিলেন, তাঁদের নানাভাবে অবজ্ঞা-অবহেলা করা হয়েছে। রাস্তাঘাটে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মেয়েরা হয়রানি-হেনস্তার শিকার হয়েছেন। তাঁরা নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কার মধ্যে পড়েছেন। এ ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে আমরা তেমন কোনো সহযোগিতা বা সহমর্মিতা দেখিনি। গণ-অভ্যুত্থানের পরও নারীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি হয়নি।

প্রথম আলো: গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে হওয়া হত্যা-সন্ত্রাসসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের অগ্রগতি নিয়ে মাঝেমধ্যে আপনাকে হতাশা প্রকাশ করতে দেখা যায়। এই হতাশা কেন?

উমামা ফাতেমা: আমি ঠিক হতাশ নই, তবে এ বিষয়গুলো আমি একটু ক্রিটিক্যালি দেখতে চাই। জুলাই-আগস্টে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত আওয়ামী লীগের অনেক মন্ত্রী-নেতা দেশের বাইরে পালিয়ে গেছেন। স্থানীয় পর্যায়ে, জেলা-উপজেলায় যাঁরা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন, তাঁরা অনেকেই এখনো গ্রেপ্তার হননি। বিভিন্ন বাহিনীর সদস্য, যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁদের অনেকে চাকরিতে বহাল। তাঁদের বিরুদ্ধে কবে, কীভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য নেই।

এখন নির্বাচন নিয়ে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে। নির্বাচন যখন সামনে চলে আসবে, তখন বিচারের প্রসঙ্গটি পেছনে পড়ে যাবে। এ কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই বিচারের যথেষ্ট অগ্রগতি হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। এ বিচার নিয়ে কোনো ধরনের শিথিলতার সুযোগ নেই বলেই আমি বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন তোলার চেষ্টা করেছি।

প্রথম আলো: সম্প্রতি একটি বক্তৃতায় আপনি বলেছেন, জুলাই পরিবর্তনের যে স্বপ্ন দেখিয়েছিল, গণ-অভ্যুত্থানের পরও এই রাষ্ট্র সেটার ধারেকাছেও নেই। আরও বলেছেন, নতুন রাজনীতি তৈরি করতে না পারলে ‘জুলাই স্পিরিট’ বা জুলাইয়ের চেতনা টিকবে না। আপনার এসব উপলব্ধির কারণ কী?

উমামা ফাতেমা: সরকারের দায়িত্ব ছিল জুলাই অভ্যুত্থানের সব শক্তিকে সুসংহত করা, ঐক্যবদ্ধ রাখা ও দেশকে পুনর্নির্মাণ করা। এটি খুবই সৃষ্টিশীল ও জটিল একটি প্রক্রিয়া। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার প্রথম থেকেই খুব গতানুগতিক পদ্ধতিতে কাজ করেছে। তারা সচিব, পিএস, এপিএসের ওপর নির্ভর করেছে। তারা জনগণের ওপর নির্ভর না করে আমলাদের ওপর নির্ভরশীল হয়েছে। কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সুবিধা অনুযায়ী কাজ করেছে। এর ফলে সরকারের কর্মকাণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, আমলাতন্ত্র ও রাজনীতির পুরোনো ধারাই শক্তিশালী হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানের পর জনগণের কল্যাণ ও অধিকারভিত্তিক যে রাষ্ট্র ও রাজনীতির প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, তা পূরণ হয়নি।

প্রথম আলো: কিছুদিন আগে আপনি ছাত্ররাজনীতির টক্সিক পরিস্থিতি নিয়ে ফেসবুকে কিছু কথা লিখেছিলেন। কোন প্রেক্ষাপটে, কেন এমন কথা লিখতে হলো?

উমামা ফাতেমা: বিগত সরকারের আমলে নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয়েছিল, এ রকম একটি ছাত্রসংগঠন ৫ আগস্টের পরও গুপ্ত বা পরিচয় লুকিয়ে রাজনীতির ধারা অব্যাহত রেখেছে। এরাই আবার সাধারণ ছাত্রদের ব্যানারে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তুলেছিল। এটা অন্য ছাত্রসংগঠনগুলোকে চাপের মধ্যে ফেলেছে। এই কৌশলে তারা আসলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোয় একক আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। অন্যদিকে তাদের এই কৌশলের কারণে সত্যিকারের সাধারণ ছাত্রদের দাবিদাওয়াগুলো সামনে আসছে না। এ রকম অবস্থাকেই আমি ছাত্ররাজনীতির টক্সিক পরিস্থিতি হিসেবে উল্লেখ করেছি।

প্রথম আলো: আপনার নিজের বিশ্ববিদ্যালয়, অর্থাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান অবস্থা কেমন? ডাকসু নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে আপনার কোনো পরিকল্পনা আছে?

উমামা ফাতেমা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ডাকসু নির্বাচন নিয়ে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। আমরা বলছি, ডাকসু নির্বাচন হওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের বৈধ প্রতিনিধিত্ব তৈরি হবে। তবে ডাকসু নির্বাচন হওয়ার আগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে যেসব সংস্কার করা প্রয়োজন ছিল, সেগুলো এখনো করা হয়নি। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এগুলো করা সম্ভব হবে কি না, সেটা আমরা এখনো জানি না।

আমি এমন ডাকসু চাই, যা একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম ও ছাত্রছাত্রীদের এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটিজ নিয়ে যে সমস্যা-সংকট আছে, তা ডিল করতে পারবে। নির্বাচন করি বা না–করি, ডাকসু নির্বাচন হলে তাতে আমি সক্রিয় থাকব। ডাকসু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমি সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা বা জুলাই স্পিরিটকে রক্ষা করার আহ্বান জানাব।

প্রথম আলো: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

উমামা ফাতেমা: আপনাকেও ধন্যবাদ।

সূত্র, প্রথম আলো