বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির ও হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক

মাওলানা মামুনুল হক বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির ও হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব। একই সঙ্গে একজন ইসলামি বক্তা। আগামী নির্বাচন, জোটের রাজনীতি, জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ও মতপার্থক্য, শাপলা চত্বর, বিয়ে, সোনারগাঁয়ের ঘটনা, আওয়ামী লীগের পতন থেকে বিএনপির শিক্ষা—এমন নানা বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সেলিম জাহিদ।

প্রথম আলো: নির্বাচন করবেন?

মামুনুল হক: আমি ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচন করতে আগ্রহী না। তবে যদি দলীয় বিবেচনায় এবং জাতীয় প্রয়োজনে নির্বাচন করতে হয়, সে ক্ষেত্রে আমি নির্বাচন করব।

প্রথম আলো: কোন আসনে চিন্তা করছেন।

মামুনুল হক: আসন হিসাবে তিনটা জায়গায় সম্ভাবনা আছে। একটা হলো ঢাকার মোহাম্মদপুরে (ঢাকা-১৩), যেখানে আমার অবস্থান। আরেকটা হলো আমার জন্মস্থান লালবাগ (ঢাকা-৭) আসনে থেকে। আর ঢাকার বাইরে আরেকটা আসন আছে, সেটা হলো বাগেরহাট-১ (চিতলমারী, মোল্লাহাট ও ফকিরহাট) আসন। যেখানে আমার নানার বাড়ি, যেখানে আমার পারিবারিক নিবিড় যোগাযোগ ও সম্পর্ক আছে।

প্রথম আলো: মোহাম্মদপুর না হয় আপনাদের বাসাবাড়ি আছে, মাদ্রাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। কিন্তু একটা নির্বাচনে জেতার জন্য যে জনপ্রিয়তা প্রয়োজন, বা আপনাদের দলের যে সাংগঠনিক শক্তি অবস্থান থাকা প্রয়োজন, সেটা কি মোহাম্মদপুর, লালবাগে, বাগেরহাটে আছে?

মামুনুল হক: না, আমার একক দলীয়ভাবে সেই পর্যায়ের কর্মী বাহিনী না থাকলেও মোহাম্মদপুরে আমাদের নির্বাচন করার মতো পরিবেশ আছে। লালবাগে ও মোহাম্মদপুরে উভয় জায়গায় আমাদের দীর্ঘ কার্যক্রমের কারণে এবং আলেম সমাজের ব্যাপক একটা তৎপরতা ঐতিহ্যগতভাবেই আছে। সেই হিসাবে আমাদের রিজার্ভ ফোর্স বেশ বড়সড়, যারা নির্বাচনী মাঠে ব্যাপক কাজ করতে পারবে। সেই সঙ্গে এখানে বিভিন্ন ধর্মীয় সামাজিক ইস্যু নিয়ে আমরা নানা সময় কার্যক্রম পরিচালনা করি। সে হিসেবে একটা গণসম্পৃক্ততা বা শক্তি আমাদের আছে।

মামুনুল হক: নির্বাচন জোটবদ্ধ হতে পারে। আবার জোটবদ্ধতা ছাড়াও যদি আমরা এককভাবেও নির্বাচন করি, তাহলেও একটা ভালো ফলাফলের আশা করতে পারি।

প্রথম আলো: শোনা যাচ্ছে, বিএনপি আপনাকে মোহাম্মদপুরের আসনটি ছাড়তে পারে। এমন গুঞ্জনও আছে, সরকার এলে আপনাকে কোনো দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। এ রকম কোনো প্রস্তাব পেয়েছেন?

মামুনুল হক: না, এ ধরনের আনুষ্ঠানিক কোনো আলোচনায় আমরা বিএনপির সঙ্গে যাইনি এখনো। এমনিতে লোকমুখে এ ধরনের কথা শুনি এবং বিএনপির আগ্রহ আছে তা বুঝি যে, ব্যক্তি হিসেবে কোথাও কোনো আসনে ছাড় দেওয়ার একটা আগ্রহ বিএনপির আছে। এটা বিভিন্ন আলামতে বুঝি। তবে আনুষ্ঠানিক কোনো আলোচনা হয়নি।

প্রথম আলো: এবার জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গে আসি। আপনি জানেন, ইসলামি দলগুলোর মধ্যে একটি নির্বাচনী সমঝোতা হওয়ার বিষয়ে আলোচনা আছে। তাতে আপনার দলের নামও আছে। আসলে এমন বাস্তবতা আছে?

মামুনুল হক: হ্যাঁ, বাস্তবতা আছে এবং যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। বিষয়টা নিয়ে ইসলামি দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া হচ্ছে। তবে সব ইসলামি দল মিলে জোট হওয়ার যে কথাটা ছিল, সেখানে দু-একটি দল মনে হচ্ছে, তারা দুই মেরুর দিকে চিন্তা করছে। কেউ বিএনপির সঙ্গে একটু বেশি চিন্তা করছে জোটবদ্ধ হওয়ার। আবার কোনো কোনো ইসলামি দল জামায়াতসহ ইসলামি ঘরানার দলগুলোর ঐক্যের জন্য একটু বেশি চেষ্টা করছে।

প্রথম আলো: কারা কোন দিকে, নামগুলো কি বলতে পারেন?

মামুনুল হক: নামগুলো এ মুহূর্তে বলতে চাই না। এখানে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে যুক্ত হচ্ছে সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর (সংখ্যানুপাতিক) পদ্ধতি, যেটা ঐকমত্য কমিশন সিদ্ধান্ত দিয়েছে। যদি এটা (উচ্চকক্ষে পিআর) বহাল থাকে, সেই ক্ষেত্রে হিসাব-নিকাশ পাল্টে যেতে পারে। কারণ, উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি থাকলে ছোট দলগুলো হিসাব করতে পারে যে বড় দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হলে হয়তো তারা দু-চারটা আসন ছাড়বে। এমন দলও আছে, যারা সারা দেশে নির্বাচন করলে ওয়ান-টু পারসেন্ট ভোট কালেক্ট করতে পারে। সে ক্ষেত্রে তারা বড় দলের ওপর ভিত্তি করে আসন পাওয়ার চেয়ে নিজস্ব শক্তির ওপর ভর করে তারা যদি কিছু আসন পেয়ে যায়, সেটাকে তারা প্রেপার করতে পারে।

প্রথম আলো: তাহলে কি পিআর পদ্ধতি জোটবদ্ধ নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে?

মামুনুল হক: নির্বাচনী হিসাব-নিকাশে একটা জটিলতা তৈরি করতে পারে।

প্রথম আলো: এটা অনেকটা প্রকাশ্য যে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন ইসলামপন্থীদের একটি নির্বাচনী সমঝোতা গড়তে জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। এই দুটি দলকে রাজনৈতিক শরিক হিসেবে ভাবছেন কি?

মামুনুল হক: আমরা এখনো চূড়ান্ত কোনো ভাবনা ভাবছি না। ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতার বিষয়ে আমাদের একাধিক বৈঠক, কথাবার্তা হয়েছে। তবে জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতার বিষয়ে এখনো কোনো অফিশিয়াল আলোচনা আমরা করিনি।

প্রথম আলো: এর কারণ কী, জামায়াত এবং আপনার দলের চিন্তা ও পথের মধ্যে মৌলিক কোনো মতপার্থক্য আছে?

মামুনুল হক: জামায়াত এবং আমাদের দলের চিন্তার মূল পার্থক্যটা তো আমি বলব, মাওলানা মওদুদি সাহেবের যে চিন্তাধারা, সেই চিন্তাধারার সঙ্গে ঐতিহ্যগতভাবেই আমাদের চিন্তাধারার কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। সেটাই মূল পার্থক্য। এ ছাড়া জামায়াতের সঙ্গে আমাদের বৃহত্তর ইসলামিক উম্মাহর চিন্তার জায়গায় পার্থক্য তো আছেই।

প্রথম আলো: আপনি মাওলানা মওদুদির চিন্তা ও বোধ-বিশ্বাসের মতপার্থক্যের কথা বলেছেন। এর সঙ্গে কওমি আলেমদের বড় ধরনের মতপার্থক্য ছিল। সেটা তো এখন নেই।

মামুনুল হক: মাওলানা মওদুদি সাহেবের চিন্তার জায়গাগুলো নিয়ে কওমি আলেমদের সঙ্গে যে মতপার্থক্য ছিল, সেটা তার আপন জায়গায় বহাল আছে। এখন বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মাহর যে অভিন্ন স্বার্থ, বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন আধিপত্যবাদী বহিঃশক্তিগুলোর প্রভাব বিস্তার করার যে মনোভাব ও পরিবেশ; সেই জায়গা থেকে দেওবন্দি ধারার দলগুলো যেভাবে দেশের পক্ষে আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে মাঠে লড়াই করছে, জামায়াতে ইসলামীও ঠিক একই শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করছে। তো সেই জায়গাটায় গিয়ে রাজনৈতিক একটা ঐক্যের পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

প্রথম আলো: আপনি কি মনে করেন, জামায়াতে ইসলামীর কোনো ভূমিকা সামগ্রিকভাবে ইসলামী আন্দোলনের জন্য ক্ষতির কারণ হয়েছে?

মামুনুল হক: এটা তো অবশ্যই। আমাদের চিন্তার যে মতপার্থক্য; আমাদের পূর্বসূরিদের দৃষ্টিতে মাওলানা মওদুদি সাহেবের সেই চিন্তার ত্রুটিগুলোতে তিনি যদি সম্পৃক্ত না হতেন, জামায়াতে ইসলামীর কার্যক্রম যেভাবে শুরু হয়েছিল—সেটা কিন্তু একটা ঐক্যবদ্ধ জায়গা থেকে শুরু হয়েছিল। তার মধ্যে কোনো বিতর্ক ছিল না। পরে বিতর্কগুলো তৈরি হওয়ায় এখানে মূলধারার আলেম-সমাজ জামায়াতে ইসলামীকে সমর্থন করেনি।

প্রথম আলো: আপনি ধর্মীয় বিষয়ে মাওলানা মওদুদির বিতর্কিত চিন্তাগুলোর কথা বললেন, এটা একটি দিক। এর সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বিতর্কিত ভূমিকাকে কীভাবে দেখেন?

মামুনুল হক: হ্যাঁ, একাত্তরের ভূমিকা নিয়েও অবশ্যই একটা বিতর্ক আছে। তবে আমি মনে করি, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় শুধু জামায়াতে ইসলামী নয়, বরং আদর্শিক কারণে এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদের শঙ্কার কারণে জামায়াতে ইসলামীর বাইরে অন্য আরও ইসলামপন্থীরা ভারতীয় আধিপত্যবাদের ব্যাপারে শঙ্কিত ছিল। সেই জায়গার কারণে আমি মনে করি, মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর যে ভূমিকা, সেটার চেয়েও আদর্শিক যে জায়গাটা, সেটাই আলেম-সমাজের জন্য বড়।

প্রথম আলো: আচ্ছা, ইসলাম কিন্তু এক। রাজনৈতিক দল কিন্তু অনেক। কেন?

মামুনুল হক: ইসলাম এক, দল অনেক—প্রশ্নটা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ইসলাম এক, প্রতিষ্ঠান অনেক। ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করার বিভিন্ন অ্যাপ্রোচ থাকতে পারে, বিভিন্ন স্কুল অব থট আছে। সেই জায়গা থেকে, দলীয় জায়গা থেকে যারা ঐক্যবদ্ধভাবে একটা কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, তারাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে এক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। কাজেই আমি মনে করি, ইসলাম এক হলেই সব দল এক হতে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

প্রথম আলো: আপনি তো শরিয়াহভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার কথা বলেন। কিন্তু বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্য থেকে এটা কীভাবে সম্ভব?

মামুনুল হক: বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে যদি অধিকাংশ জনগণ চায়, তাহলে এটা ইম্পসিবল না। এটা পসিবল সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে এবং নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে দেশের আইন ও সংবিধান—সবকিছুরই ইসলামাইজেশন সম্ভব।

প্রথম আলো: ধরুন, আপনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে সংসদে গেলেন। আপনার প্রথম তিনটি আইন প্রণয়নের অগ্রাধিকারে কী থাকবে?

মামুনুল হক: প্রথম যেটা থাকবে সেটা হলো, কোরআন-সুন্নাহবিরোধী যেসব আইন, নীতিমালা আছে, মৌলিক নীতিমালার মাধ্যমে এটাকে আমরা ব্যান (বাতিল) করব। অর্থাৎ কোরআন-সুন্নাহর সাংঘর্ষিক কোনো আইন, নীতি, সিদ্ধান্ত কার্যকর থাকবে না। দ্বিতীয় হবে, কোরআন-সুন্নাহর ভিত্তিতে সংখ্যালঘুরা যে অধিকারগুলো পাওয়ার, সেই অধিকারগুলো আমরা নিশ্চিত করব। তৃতীয়ত, বিচারব্যবস্থায় কোরআনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বেশ কিছু দণ্ডবিধি আছে, সেই দণ্ডবিধিগুলোকে পরিবর্তন করে কোরআনের দণ্ডবিধি কার্যকর করব।

প্রথম আলো: আপনি তো একজন শায়খুল হাদিস। হাদিসের শিক্ষক হিসেবে আপনার একটা অবস্থান আছে। রাজনীতিতে কেন?

মামুনুল হক: ছাত্রজীবন থেকেই আমি সংগঠন এবং রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আমি রাজনীতিতে এসেছি, তা নয়, বরং শিশুকাল থেকে রাজনীতিতে আমার হাতেখড়ি। আমরা কোরআন-সুন্নাহ যেটা পড়ি, যেটা আমাদের জ্ঞান, সেই জ্ঞান আমাকে বাধ্য করে যে সেটার অ্যাপ্লিকেশনের জন্য, সেটা বাস্তবায়নের জন্য আমাকে রাজনীতি করতে হবে। কারণ, রাষ্ট্রব্যবস্থায় ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া ইসলামের পূর্ণাঙ্গ রূপ কোনোভাবেই বাস্তবায়িত হওয়া সম্ভব নয়।

প্রথম আলো: আপনি কি খেয়াল করছেন, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন যে তিনি রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থীদের উত্থান দেখছেন। এতে তিনি উদ্বিগ্ন। আপনি কি মনে করেন?

মামুনুল হক: এখানে ‘দক্ষিণপন্থী’ বলতে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে যে ধারাকে বোঝানো হয়—দক্ষিণপন্থী মানে পূর্ণ ইসলামিক—তা বোঝায় না। বরং দক্ষিণপন্থী রাজনীতির একটা ডেফিনেশন আছে। তবে দক্ষিণপন্থী রাজনীতি দিয়ে যদি তিনি ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে মিন করে থাকেন, তাহলে এটা চরম আপত্তিকর বক্তব্য আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। আমরা কোনোভাবেই এই বক্তব্যকে সমর্থন করতে পারি না বা এই বক্তব্যের সঙ্গে নমনীয়তাও প্রদর্শন করতে পারি না।

প্রথম আলো: আপনি নিজে বিএনপিকে কোন পন্থী দল মনে করেন?

মামুনুল হক: বিএনপিকে আমি সম্পূর্ণ দক্ষিণপন্থী না মনে করলেও দক্ষিণপন্থার ওপর ভিত্তি করেই বিএনপির রাজনীতির ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে মনে করি। এবং ইসলামি মূল্যবোধই হলো বিএনপির রাজনীতির অন্যতম প্রধান বনিয়াদ। কাজেই বিএনপির রাজনীতি পরিপূর্ণ দক্ষিণপন্থী না হলেও দক্ষিণপন্থার ওপর ভিত্তি করে রাজনীতি গড়ে উঠেছে।

ময়মনসিংহের নান্দাইলে খেলাফত যুব মজলিসের সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন মাওলানা মমিনুল হক। শনিবার বিকেলে শহরের চণ্ডীপাশা সরকারি উচ্চবিদ্যালয় মাঠে

প্রথম আলো: সম্প্রতি এক বক্তৃতায় আপনি বলেছেন, ইসলামি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিএনপি আবু তালেবের ভূমিকায় আর আওয়ামী লীগ আবু জাহেলের ভূমিকায়। এটি বলার কারণ কী?

মামুনুল হক: অনেকে বলেন, বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ একই, মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ বা দুই দলকে সমান্তরালভাবে চিন্তা করেন। আমরা বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের অতীত ইতিহাস থেকে এই কনক্লুশনে আসি যে ইসলামের সঙ্গে ইসলামপন্থীদের সঙ্গে আলেম-সমাজের সঙ্গে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের আচরণ একরকম না। যেটা আমি ওই বক্তব্যের মধ্যে রেফারেন্সও টেনেছি। বিএনপির নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার স্পষ্ট একটা বক্তব্য, তিনি আমাদের বলেছেন আমরা (বিএনপি) ইসলামের রাজনীতি করি না। তবে আপনারা যদি ইসলামের রাজনীতির মাধ্যমে দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেন, তাহলে আমাদের আপনাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে পাবেন না। সেই জায়গাটা থেকে আমরা সব সময় দেখি, আওয়ামী লীগের রাজনীতির একটা অন্যতম দর্শন হলো, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, ইসলামি রাজনীতির উত্থানকে তারা কখনোই সহ্য করে না। তারা কখনো কখনো ব্যক্তিগত জীবনে ধর্ম পালন বা ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের শ্রদ্ধা করা ভক্তি করা—সেটা করেন। কিন্তু রাজনৈতিক নেতা হিসেবে রাজনৈতিক নেতৃত্বের জায়গায় তারা ইসলামপন্থী বা ইসলামি আদর্শের অনুসারী কাউকে সহ্য করেন না। সেই জায়গাটা থেকেই মূলত আমার এই মন্তব্য এবং মন্তব্যটা আমার খুবই সুচিন্তিত।

প্রথম আলো: কিন্তু দেশের মানুষ তো আওয়ামী লীগের এই দীর্ঘ শাসনামলে আল্লামা শাহ আহমদ শফিসহ কওমি ধারার বিশিষ্ট আলেমদের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দেখেছেন। তাঁরা সরকারের প্রশংসা করেছেন, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গেও অনেকবার সাক্ষাৎ করেছেন।

মামুনুল হক: ইসলামের একটা পরিভাষা আছে, মুআল্লাফাতুল কুলুব। এর অর্থ হলো, কারও মন জয় করা। তালিফুল কালবও বলে। অর্থাৎ কারও মনকে খুশি করার চেষ্টা করা। ইসলামের একটা বড় জায়গায় এটার প্রসঙ্গ আছে। সেখানে দুই ধরনের মানুষের মন জয় করার কথা ইসলামে বলা হয়। এটাকে উৎসাহিত করা হয়েছে দুই কারণে। একটা হলো, যারা ইসলামের প্রতি সফট বা আকৃষ্ট, তাদের মন জয় করার কথা বলা হয়েছে, এ জন্য যেন তারা পরিপূর্ণভাবে ইসলামের দিক ধাবিত হয়ে যায়।

আরেক শ্রেণির মানুষেরও মন জয় করার অপশন রাখা রয়েছে এবং সেটাকেও উৎসাহিত করা হয়েছে। সেটা হলো, যাঁরা প্রচণ্ড ইসলামবিরোধী, যাঁরা ইসলাম এবং মুসলমানদের প্রতি সাংঘাতিক রকমের মারমুখী, তাঁদেরও মন জয় করতে বলা হয়েছে তাঁদের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য। আমরা ঐতিহাসিকভাবে দেখতে পাই, আওয়ামী লীগ বরাবরই আলেম-সমাজের প্রতি মারমুখী থাকে। তো আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমরা যখন সখ্য গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি, তখন আমাদের এই সখ্য গড়ে তোলার চেষ্টার প্রধান কারণ ছিল তাদের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা। আর যদি মন জয় করে তাঁদের সেই কঠোর অবস্থান থেকে নমনীয় অবস্থানে নিয়ে আসা যায়, এটা আলেম-সমাজের ঐতিহ্যগত ও ধর্মীয় দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত।

প্রথম আলো: তাহলে এটা ছিল একটা কৌশল?

মামুনুল হক: অবশ্যই এটা কৌশল।

প্রথম আলো: এবার আপনার ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক জীবনের দুটি মোড় ঘোরানো ঘটনার কথা বলব। একটা হলো, ২০১৩ সালে ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে, অন্যটি ২০২১ সালের ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে সোনারগাঁওয়ে। দুটি ঘটনাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

মামুনুল হক: শাপলা চত্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে একটা অন্যতম মাইলফলক। আমরা মনে করি, এটা বাংলাদেশের নতুন বালাকোট (বালাকোট যুদ্ধ)। বালাকোট যে রকম উপমহাদেশের উপনিবেশবাদ আমলে এ দেশের স্বাধীনতা এবং দেশের ঐতিহ্য রক্ষা করার ক্ষেত্রে একটা প্রধান মাইলফলকের ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশেরও অনাগত ভবিষ্যতে এ দেশের গতিপথ নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে যে কয়েকটি ঘটনা নিয়ামকের ভূমিকা পালন করবে, তার মধ্যে অন্যতম একটা হলো শাপলা চত্বর। সেই শাপলা চত্বরে আমার একটা ভূমিকা ছিল, আমি দৃশ্যমান একটা জায়গায় ছিলাম, আল্লাহ পাক আমাকে সেখানে সেই ভূমিকা রাখার তৌফিক দিয়েছেন। শাপলা চত্বর আমার জীবনের অন্যতম একটা স্মরণীয় ঘটনা এবং এটা আমার জীবনকে পরিশীলিত করার এবং আমার ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের একটা ভিত্তি।

সোনারগাঁওয়ের ঘটনা আমার জীবনের একটা অবশ্যই দুঃখজনক ঘটনা। এটা কখনোই কল্পনা করিনি। এ ঘটনার ভালো-মন্দ দুটো দিক আছে। মন্দ দিকটা হলো এই, এখানে ব্যক্তিগতভাবে আমাকে ঘায়েল করার, চরিত্র হনন করার একটা বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন আমি হয়েছি। তবে এ ঘটনার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভালো দিক হলো আমি এবং দেশবাসী আমরা অনুভব করলাম যে ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনা ও ইসলামবিদ্বেষী বিদেশি শক্তি আমাদের গুরুত্ব দেয়। আমাকে তারা ভয় পায়, আমার নেতৃত্বকে তারা ভয় পায়। আমার কাছে মনে হয়েছে আমি সেই আক্রমণের জায়গা থেকে আমার ব্যক্তিসত্তাকে, আমার নেতৃত্বসত্তাকে আবিষ্কার করতে পেরেছি।

প্রথম আলো: অনেকেরই জানার কৌতূহল যে যাঁকে নিয়ে এ ঘটনা, যাঁকে আপনি স্ত্রীর পরিচয় দিয়েছিলেন, তিনি আপনার সঙ্গে আছেন কি না?

মামুনুল হক: আছেন, এখনো আমার সঙ্গে আছেন। ওই ঘটনায় তাঁর কিছু ভূমিকা নিয়ে কিছু দুর্বলতা, মানে আমি যে রকমের চাপ উপেক্ষা করেছি, তিনি সে রকম শক্তিমত্তার সঙ্গে ফেস করতে পারেননি। সেটা নিয়ে কিছু টানাপোড়েন আছে।

প্রথম আলো: সোনারগাঁয়ের ঘটনার পর আরও অনেক আলেমের বিরুদ্ধে স্ত্রীর অমতে একাধিক বিয়ের বিষয়টি সামনে আসে। যেমন আপনার, জুনায়েদ আল হাবীবসহ আরও অনেকের বিরুদ্ধে। যদিও এক ব্যক্তির চার বিয়ে ইসলাম ধর্মে অনুমোদিত। তবু বাংলাদেশের সামাজিক পটভূমিতে বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন?

মামুনুল হক: বাংলাদেশের সামাজিক পটভূমি একাধিক বিয়েকে ভালো দৃষ্টিতে দেখে না। আমরা ইসলামি শরিয়াহর আলোকে এই সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিকে খুব আপত্তিকর মনে করি। কারণ, ইসলামে যেটা বৈধ এবং যার ব্যাপারে কোনো ধরনের কোনো নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার কোনো সুযোগ নেই, যে কাজটা একটা পবিত্র কাজ এবং প্রয়োজনীয় কাজ। সেটাকে সামাজিকভাবে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রাখা অথবা সেটাকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখাকে আমি কুসংস্কার মনে করি। অবশ্যই এই কুসংস্কারকে নির্মূল করা ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ধর্মীয় নেতাদের, আলেম-সমাজের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এই কুসংস্কারকে রোধ করার জন্য আলেম-সমাজকে অবশ্যই সাহসী ভূমিকা রাখতে হবে। এবং যাঁরা ইসলামকে প্রশ্নহীনভাবে মানেন, তাঁদের সবাইকে এই কুসংস্কার রোধ করার জন্য যাঁর যাঁর জায়গা থেকে ভূমিকা রাখা জরুরি।

মাওলানা মামুনুল হক

প্রথম আলো: একজন স্বামী কি একসঙ্গে দুই-তিন-চার স্ত্রীর সর্বক্ষেত্রে সম-অধিকার, মর্যাদা নিশ্চিত করতে পারেন?

মামুনুল হক: এই প্রশ্নটা খুবই আপত্তিকর। কারণ, যদি এটা না-ই সম্ভব হতো, তাহলে কোনোভাবেই আল্লাহ পাক এই বিধান দিতেন না। আল্লাহ কোরআনে জায়গায় জায়গায় বলেছেন, তিনি এমন কোনো বিধান মানুষকে দেন না, যেটা মানুষের পক্ষে পালন করা সম্ভব না।

প্রথম আলো: ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর কিছু কিছু ঘটনায় নাগরিক সমাজের অনেকে মনে করছেন, সমাজে একটা উগ্র শ্রেণির মানুষের প্রকাশ ঘটেছে। আপনার কী মনে হয়?

মামুনুল হক: আমি মনে করি না, ৫ আগস্টের পরে নতুন করে কোনো উগ্র শ্রেণির আবির্ভাব ঘটেছে। বরং মনে করি, ৫ আগস্টের ঘটনার মধ্য দিয়ে দেশ, রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ইয়াং জেনারেশনের মধ্যে নতুন কিছু স্টেকহোল্ডার তৈরি হয়েছে। যারা অতীতে মনে করত, যারা প্রচলিত রাজনীতির লাঠিয়াল, রাজনীতি করে, সন্ত্রাস করে—তারাই শুধু রাষ্ট্র ও রাজনীতি নিয়ে ভাববে। এটা ছিল বাংলাদেশের ৫ আগস্ট-পূর্ববর্তী রাজনৈতিক কালচার। ৫ আগস্ট যে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে, তার মধ্যে এটা একটা যে এখন ভালো মানুষ, ছাত্ররা—যারা সৃষ্টিশীল চিন্তা করে, ইতিবাচক চিন্তা করে, জনকল্যাণের চিন্তা করে। তারা এখন ভাবতে শুরু করেছে যে রাষ্ট্র নিয়ে আমরাও ভাবতে পারি এবং আমাদের ভাবনাটা রাষ্ট্রে কার্যকর হওয়া সম্ভব।

প্রথম আলো: তাহলে মবের ঘটনাগুলোকে কী বলবেন?

মামুনুল হক: মবের ঘটনাগুলো কিছুটা স্যাবোটাজ এবং কিছু মানুষের আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা। এর পেছনে চলমান রাষ্ট্রকাঠামো ও আইনশৃঙ্খলাব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থাহীনতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।

প্রথম আলো: আপনি তো হেফাজতের ইসলামের বড় নেতা। আগামী নির্বাচনে হেফাজতের ভূমিকা কী হবে?

মামুনুল হক: হেফাজতে ইসলাম যেহেতু অরাজনৈতিক সংগঠন, সে কারণে হেফাজতে ইসলাম প্রত্যক্ষভাবে কোনো ভূমিকা পালন করবে না। এটা হেফাজতের ঘোষিত চূড়ান্ত নীতি। তবে হেফাজতে ইসলামের মধ্যে যেহেতু অনেকগুলো সংগঠন আছে বা রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সব ধরনের নেতা এখানে সমবেত আছেন, সেই ক্ষেত্রে আমার মনে হয় যদি ইসলামি দলগুলো দ্বিধাবিভক্ত হয়, তাহলে হেফাজতও ঐক্যবদ্ধ কোনো দৃষ্টিভঙ্গির ওপর থাকতে পারবে না।

প্রথম আলো: আপনি খেয়াল করেছেন নিশ্চয়ই, বিএনপির দুজন শীর্ষস্থানীয় নেতা হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ও চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার পরিচালকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এটা কী ইঙ্গিত দেয়?

মামুনুল হক: এটা ইঙ্গিত দেয় যে বিএনপি হেফাজতের সঙ্গে সখ্য এবং আনুকূল্য চাইছে এবং সেটা প্রদর্শন করতে চাইছে। তবে আমি মনে করি, সবার জন্যই হাটহাজারী এবং হেফাজতের দুয়ার উন্মুক্ত আছে।

প্রথম আলো: আপনারা সব সময় বলেন, হেফাজত একটা অরাজনৈতিক সংগঠন। কিন্তু এই সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা রাজনীতি করেন, অনেকে সংসদ সদস্য হওয়ার প্রতিযোগিতায় আছেন, কেউ কেউ বড় দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতার চেষ্টাতেও আছেন। এটাকে কী বলবেন?

মামুনুল হক: একটা মানুষের একাধিক পরিচয় থাকতে পারে। একটা মানুষ একই সঙ্গে সে রাজনৈতিক দলের সদস্য, আবার একই সঙ্গে সে কোনো সামাজিক সংগঠনের সদস্য অথবা আরও বিভিন্ন ধরনের সংগঠনের সদস্য থাকতে পারেন। তো ব্যক্তির একাধিক পরিচয় থাকে। সেই ক্ষেত্রে আমি মনে করি যে আমরা যারা রাজনীতি করি, আমাদের রাজনীতির ভিন্ন প্ল্যাটফর্ম আছে, সেখানে থেকে আমরা আমাদের রাজনীতি করি।

প্রথম আলো: তাহলে তো হেফাজতের প্ল্যাটফর্মটা আপনাদের সুবিধাই করে দিল। যখন ধর্মীয় বিষয় আসে, তখন আপনারা ধর্মীয় নেতা, যখন নির্বাচন আসে, তখন রাজনীতিক।

মামুনুল হক: যদি কেউ এটাকে (হেফাজতের প্ল্যাটফর্ম) বেনিফিট বিবেচনা করে, তাহলে বেনিফিট। কিন্তু আমরা এটাকে দায়দায়িত্বের জায়গা থেকে বিবেচনা করি। আমরা ধর্মীয় ইস্যুগুলোতে দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে মোকাবিলা করতে চাই।

প্রথম আলো: সংসদের ৩০০ আসনে মোট প্রার্থীর ৫ থেকে ৭ শতাংশ নারী প্রার্থী দেওয়ার কথা বলেছে ঐকমত্য কমিশন। এ ক্ষেত্রে আপনাদের অবস্থান কী? আপনার দলে এতসংখ্যক নারী প্রার্থী আছেন?

মামুনুল হক: আমরা মনে করি, এ-জাতীয় চিন্তা, নারীর জন্য আলাদা করে কোটা নির্ধারণ—একটা বৈষম্যমূলক চিন্তা। নারীর জন্য তো সব ধরনের পথই খোলা আছে বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায়। ৩৫ বছর ধরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আসনে নারীই পরিচালনা করেছেন, দীর্ঘ একটা সময় বিরোধীদলীয় নেতার আসনেও নারী ছিলেন, সংসদে স্পিকারের দায়িত্বও নারীরা পালন করলেন। তাতে যেই যুক্তিতে নারীর জন্য আসন সংরক্ষণের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এই কার্যক্রম শুরু হয়েছিল, যে নারীরা পিছিয়ে আছেন তাঁদের একটু স্পিড (গতি) তৈরি করে দেওয়া দরকার। ৩৫ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকার পরেও যদি নারীর জন্য সেই স্পিড তৈরি হয়নি বলে যদি কেউ দাবি করেন, আমি মনে করি, এটা নারীর জন্য অবমাননাকর। কাজেই নারীর জন্য কোনো কিছুরই সংরক্ষণের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। বরং তারা এখানে কোয়ালিফিকেশন করে, প্রতিযোগিতা করে সর্বোচ্চ জায়গায় যাচ্ছে, যেতে পারে। তাদের জন্য আসন সংরক্ষণ করাটাকে আমরা অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক মনে করি।

প্রথম আলো: আগামী নির্বাচন দেশের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান আনবে, নাকি সংকট আরও ঘনীভূত করবে?

মামুনুল হক: আগামী নির্বাচনে বাংলাদেশের রাজনীতির সব সংকট সমাধান হয়ে যাবে, এতটা আশাবাদী আমি নই। তবে মনে করি, বিগত ৫৪ বছরের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সেই সংস্কৃতির ওপর বড় ধরনের একটা আঘাত হানবে। কারণ, একটা পরিবর্তনের ভিত তৈরি হবে এবং নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য এই নির্বাচনটা অন্যতম একটা গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলকের ভূমিকা পালন করবে।

প্রথম আলো: আওয়ামী লীগের (রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ) নির্বাচন করার সুযোগ নেই। এতে বড় দল বিএনপিরই ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা বেশি। রাজনীতিতে বিএনপি কতটা পরিবর্তন আনতে পারবে বলে মনে করেন?

মামুনুল হক: আমরা মনে করি, বিএনপি কোনোভাবেই আওয়ামী লীগের মতো ফ্যাসিবাদী আচরণ করবে না। দলীয়ভাবে আদর্শগতভাবেও বিএনপির মধ্যে সেই ধরনের দমন-পীড়নের মানসিকতা নেই, এটা ঐতিহ্যগতভাবে মনে করি আমরা। আর আসলে বিএনপির মধ্যে সেই ধরনের দমন-পীড়নের সামর্থ্যও নেই। আর আমি মনে করি, চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান থেকেও বিএনপি শিক্ষা নেবে। শেখ হাসিনার মতো ‘আয়রন লেডিও’ কিন্তু জনপ্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে তাসের ঘরের মতো ভেসে গেছেন। কাজেই আমরা আশঙ্কা করি না যে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে আবার এই রকম একটা ফ্যাসিবাদের জন্ম হবে। সেই ক্ষেত্রে বিএনপির থেকে আমরা ভালোই আশা করি।

আমি মনে করি, বিএনপির জন্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্থায়িত্বের যে জায়গা, সেটা হলো তাকে ইসলামপন্থীদের সঙ্গে, ইসলামপন্থীদের আনুকূল্য নিয়েই বিএনপিকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অবস্থান করতে হবে। অন্যথা হলে সেটা বিএনপির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হবে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

মামুনুল হক: আপনাকেও ধন্যবাদ।

সূত্র, প্রথম আলো