কাজী মারুফুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক। শাসনব্যবস্থা, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও জননীতি তাঁর গবেষণার বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের এই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের একজন সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান, সংস্কার, নির্বাচন, রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর ইত্যাদি বিষয়ে।

প্রথম আলো: জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর হতে চলল। গত বছর এ অভ্যুত্থানের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে সেই দিনগুলোকে এখন কীভাবে স্মরণ করবেন?

কাজী মারুফুল ইসলাম: সেই সময়টা আসলে অন্য রকম ছিল। যখন সারা দেশে নিষ্ঠুরভাবে শিক্ষার্থীদের নির্যাতন-খুন করা হচ্ছিল, তখন তাদের পাশে না দাঁড়ানোর আর কোনো সুযোগ ছিল না। ওরা তো আমাদেরই সন্তান। আসলে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোই শিক্ষকের চিরায়ত ধর্ম। বাংলাদেশে অনেক উদাহরণ আছে। এ ক্ষেত্রে সম্ভবত সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে আছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামসুজ্জোহা। এই যে মাইলস্টোন দুর্ঘটনায় দুজন শিক্ষক, তাঁরা কিন্তু বেঁচে যেতে পারতেন। কিন্তু শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে গিয়ে নিজের প্রাণ দিতেও দ্বিধা করলেন না। তাঁদের কথা ভাবলে মনে হয়, আমরা আসলে কিছুই করিনি।

চব্বিশের জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর বিষয়টার তিনটি দিক আছে—একজন মানুষ হিসেবে, একজন শিক্ষক হিসেবে ও একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমার দায়িত্ব। চব্বিশের জুলাইয়ে আমি ও আমাদের যে সহকর্মীরা শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম, আমার মনে হয়, তাঁরা এই তিন বিবেচনা দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। তখন আসলে আমরা বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম।

আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, জুলাই আমার জীবনের অনন্য এক অধ্যায়। এক স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে আনতে পারার সংগ্রামের অংশ হওয়া আমার কাছে সত্যিই খুব গৌরবের।

প্রথম আলো: এক বছর পরে এসে গণ-অভ্যুত্থান কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? এর মূল চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য কী ছিল বলে মনে করেন?

কাজী মারুফুল ইসলাম: চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান একটা বহু বর্ণের, বহু মাত্রার, বহু স্বার্থের বিবিধ অংশীজনের সম্মিলনে একধরনের গণবিস্ফোরণ। এ দেশের ইতিহাসে গণ-অভ্যুত্থান নতুন নয়। তবে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এটি শুধু একটি সরকারের পতন নয়, বরং একটি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের রুখে দাঁড়ানোর ইতিহাস।

এই অভ্যুত্থান নিছক একটি ছাত্র আন্দোলনের ফল নয়, এটি ছিল দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ, বঞ্চনা ও রাজনৈতিক বন্ধ্যত্বের বিরুদ্ধে এক অভাবনীয় গণজাগরণ। এটি ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি একাধারে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে এবং বিদ্যমান শাসনকাঠামোর প্রকৃতি ও বৈধতা নিয়ে মৌলিক প্রশ্ন তুলেছে। এর বিশিষ্টতা ছিল নাগরিকের অধিকার, রাজনৈতিক নেতৃত্বের ধরন ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নতুন ব্যাখ্যা দেওয়ার ক্ষমতা।

খেয়াল করুন, এ আন্দোলনের কোনো একক নেতা ছিলেন না। কোনো একক ব্যক্তি বা সংগঠন এ অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয়নি। এ আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য দিক হলো, এর বিকেন্দ্রীকৃত নেতৃত্ব; একক নেতা বা দলনির্ভরতা নয়, বরং অনেকগুলো উদীয়মান রাজনৈতিক স্বর ও পক্ষ এই আন্দোলনে অংশ নেয়। এটি একটি বিস্তারযোগ্য, বিকেন্দ্রীকৃত, নেটওয়ার্কভিত্তিক নেতৃত্বের কাঠামো দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। শহর থেকে গ্রাম, ক্যাম্পাস থেকে কারখানা—সর্বত্র একধরনের সমান্তরাল নেতৃত্ব গড়ে উঠেছিল, যা আগের কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনে দেখা যায়নি।

দ্বিতীয়ত, এ আন্দোলনের একক লক্ষ্য বা স্পষ্টভাবে ঘোষিত কোনো চূড়ান্ত লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য ছিল না। ভিন্ন ভিন্ন স্তরে অংশগ্রহণকারীরা ভিন্ন ভিন্ন দাবি ও প্রত্যাশা নিয়ে যুক্ত হয়েছিলেন।

তৃতীয়ত, কোনো প্রচলিত রাজনৈতিক দল এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল না। এ আন্দোলন প্রমাণ করেছে, রাজনৈতিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে জনগণের আত্মশক্তি কোনো রাজনৈতিক দল ছাড়াও সংগঠিত হতে পারে।

চতুর্থত, তরুণ নেতৃত্ব এই আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি ছিল। আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের বড় অংশই বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্র–ছাত্রী, শ্রমিক ও শিক্ষিত তরুণ-তরুণী। তাঁদের বয়স ছিল মূলত বিশের কোঠার শুরুর দিকে থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত। পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা নেতৃত্বে এগিয়ে এসেছেন।

পঞ্চমত, এই বিদ্রোহ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইতিহাস ও জাতিসত্তার মেটা-ন্যারেটিভকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করেছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পরিচয় ও জাতিসত্তা নিয়ে প্রচলিত বয়ানের বাইরে এসে এই বিদ্রোহ জনগণের সার্বভৌমত্বের একটি ন্যায্য ব্যাখ্যা সামনে এনেছে। এটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই আন্দোলনে নারীদের অসাধারণ ও বৈপ্লবিক ভূমিকা। হাজার হাজার নারী শুধু উপস্থিতই থাকেননি, নেতৃত্বও দিয়েছেন। তাঁরা কৌশল নির্ধারণ, ফ্রন্টলাইনে থেকে বিক্ষোভে অংশগ্রহণ, আন্দোলনের বার্তা পৌঁছে দেওয়া থেকে শুরু করে সমন্বয় পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন।

প্রথম আলো: গণ-অভ্যুত্থানের প্রত্যাশা-প্রাপ্তি-সাফল্য-সীমাবদ্ধতাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও সংস্কৃতিতে এটা কী ধরনের প্রভাব ফেলেছে?

কাজী মারুফুল ইসলাম: গণ-অভ্যুত্থানের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে পার্থক্য তো আছেই। এখনকার পরিস্থিতি আমাকে সত্যিই বিষণ্ন করে। কিন্তু আমি এটাও মনে করি যে এই অভ্যুত্থানের ফলাফল নিয়ে শেষ কথা বলার সময় এখনো হয়নি।

এই অভ্যুত্থানের হাত ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা গুণগত পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে মাত্র। অনেক চড়াই-উতরাই পার হতে হবে। তবে এটা সামনের দিকেই এগোবে। একটা উদাহরণ দিই, আমাদের রাজনীতিতে প্রচলিত যে পরিবারতন্ত্র আছে, এটা আর বেশিদিন টিকবে না। এই অভ্যুত্থান রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করেছে।

প্রথম আলো: গণ–অভ্যুত্থানের পর অংশীজনদের মধ্যে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে বলে অনেকে দাবি করছেন। বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে এ ধারণাকে ব্যাখ্যা করছেন। এই নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের প্রায়োগিক সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক রূপ আসলে কেমন বলে আপনি মনে করেন?

কাজী মারুফুল ইসলাম: আমার কাছে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত হলো, ক্ষমতার নতুন বিন্যাস। অর্থাৎ ক্ষমতার পুরোনো কেন্দ্র যেমন রাজনৈতিক দল, সংসদ, বিচার বিভাগ, বিশ্ববিদ্যালয়, স্থানীয় সরকার, আমলাতন্ত্র, ব্যাংকিং ব্যবস্থা, গণমাধ্যম—এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দায়িত্ব ও ক্ষমতার ভারসাম্য আনা এবং একই সঙ্গে সেই দায়িত্ব পালনে উপযোগী সক্ষমতা গড়ে তোলা।

একটা উদহারণ হতে পারে যে সংসদের ক্ষমতা ভেঙে এক কেন্দ্রের জায়গায় একাধিক কেন্দ্র স্থাপন করা, যাকে আমরা ‘বাই ক্যামেরাল’ সংসদের কথা বলছি; ব্যাংকিং ব্যবস্থা পরিবর্তনে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে কোনো নির্দিষ্ট বিনিয়োগকারীদের হাত থেকে মুক্ত রাখার ব্যবস্থা করা; পুলিশের বর্তমান কাঠামো ভেঙে একটি স্বাধীন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে আনা—এগুলো হতে পারে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠার প্রায়োগিক জায়গা।

একটি গণতান্ত্রিক অর্থনীতি, অর্থাৎ সবার জন্য প্রতিযোগিতার সমান সুযোগ আছে; স্বচ্ছ, দুর্নীতি ও শোষণমুক্ত, মালিক ও শ্রমিক-—উভয়ের অধিকার আছে, এমন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সৃষ্টি নতুন বন্দোবস্তের অংশ।

প্রথম আলো: অভ্যুত্থানের পর নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বা গণতান্ত্রিক রূপান্তরের যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, তা বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

কাজী মারুফুল ইসলাম: অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর আস্থা রেখেছিলাম যে তারা গণতান্ত্রিক রূপান্তরের কাজটি ভালোভাবে করতে পারবে। কিন্তু সমস্যা হলো, অভ্যুত্থান–পরবর্তী যে ডিজঅর্ডার, তারা সেই জায়গা থেকে জোরালোভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর জন্য অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যে উপদেষ্টামণ্ডলী বেছে নিয়েছেন, তাঁদের অনেকের যোগ্যতা বা দক্ষতা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। আমরা দেখেছি, কোনো কোনো উপদেষ্টা কী বাজেভাবে ব্যর্থ হয়েছেন।

আমি একটি উদাহরণ দিই। অন্তর্বর্তী আমলে অরাজনৈতিক ব্যক্তি বলে কিছু শিক্ষককে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাঁরা যেমন অরাজনৈতিক নন, তেমনি সেই পদগুলোর জন্য যোগ্যও নন। তাঁরা নির্দিষ্ট ‍দু-একটি দলের সমর্থক। সিভিল সার্ভিসেও ডিসিপ্লিন ফেরত আনতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার।

এরপরও কিছু জায়গায় সরকারের সাফল্যের কথা স্বীকার করতে হবে। যেমন অর্থনীতিতে একটা শৃঙ্খলা এসেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রেও খুব ধীরে হলেও কিছুটা স্বস্তি ও নিয়মকানুন ফিরছে। রাষ্ট্র সংস্কার এজেন্ডা বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকার এখনো হাল ছেড়ে দেয়নি বলে মনে হচ্ছে।

প্রথম আলো: আমরা দেখেছি, জনগণের মধ্যে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা প্রবল। পুরোনো ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ফেরত না যাওয়ার ব্যাপারে সমাজে মোটাদাগের ঐকমত্য রয়েছে। কিন্তু সেই ঐকমত্যের প্রাতিষ্ঠানিক রূপান্তরে যে সংস্কারের কথাগুলো বলা হচ্ছে, সেগুলোর বিষয়ে আপনার মতামত কী?

কাজী মারুফুল ইসলাম: আসলে প্রাতিষ্ঠানিক রূপান্তর রাতারাতি করা যায় না। কিন্তু আশার কথা হলো, আমাদের সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা অনেক বেড়েছে। আমাদের ১১টি সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে যেসব সংস্কার প্রস্তাব করেছে, সেগুলোর সবই গুরুত্বপূর্ণ।

আমি স্থানীয় সরকার কমিশনে কাজ করেছি। আমি দেখেছি, ১০ জন মানুষ কি অক্লান্ত পরিশ্রম করে সুপারিশগুলো তৈরি করেছেন। একই রকম অন্য কমিশনের ক্ষেত্রেও হয়েছে। এই সুপারিশগুলো গুরুত্বপূর্ণ।

সুপারিশগুলো তো কমিশনের সদস্যরা এককভাবে তাঁদের মাথা থেকে বের করেননি, বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলাপ করে দেশ-বিদেশের অভিজ্ঞতা ও গবেষণার ভিত্তিতে দিয়েছেন। যেকোনো কমিশনের রিপোর্টে দেখা যাবে, সেখানে সমস্যা ও সমাধান চিহ্নিত করা হয়েছে। এই সুপারিশের চার ভাগের একভাগও যদি বাস্তবায়ন করা যেত, তাহলে দেশের সার্বিক ব্যবস্থায় ও অবস্থায় বিরাট পরিবর্তন সম্ভব হতো।

তবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপান্তর কোনো সরলরৈখিক ব্যাপার নয়। এটা সব সময় এক দিকে এক গতিতে চলতে থাকবে, এমন নয়। এটা কখনো সামনে যেতে পারে, কখনো পেছনেও আসতে পারে। কিন্তু আশার ব্যাপার হলো, কিছু বিষয়ে জনগণের মধ্যে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। সংস্কারের দাবিগুলোকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ভবিষ্যতে এ দেশে রাজনীতি করা খুব সহজ হবে না।

প্রথম আলো: বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলোর বাছাইকৃত একটি অংশ নিয়ে ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে। আলোচনা প্রায় শেষ পর্যায়ে। এই আলোচনার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?

কাজী মারুফুল ইসলাম: আমরা ঐকমত্য কমিশনের প্রতিবেদন দেখলাম। সেখানে যে ১৯টি মৌলিক সংস্কার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেগুলো নিয়ে ভিন্নমত আছে। আমার ধারণা, আবার আলোচনায় বসলে সেগুলোতেও আরও একটু অগ্রগতি হবে বলে আশা করছি। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিবেচনায় নিলে এই অগ্রগতি সামান্য নয়।

সংস্কারের প্রস্তাব নিয়ে কোনো সমস্যা নেই, সংকট হলো বাস্তবায়নে। আর বাস্তবায়নের জন্য যেহেতু আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নির্ভরশীল, তারা যদি নাগরিকদের আকাঙ্ক্ষায় সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তারাও অচিরেই আস্তাকুঁড়ে চলে যাবে। তবে এটা তো বলতেই হবে, এই আলোচনার প্রক্রিয়াটারও একটা মূল্য আছে। এতগুলো দল প্রতিদিন একসঙ্গে বসছে, পরস্পরের যুক্তি শুনছে, নিজেদের পাল্টা যুক্তি-প্রস্তাব দিচ্ছে। আমি মনে করি, এগুলোও ইতিবাচকতার চিহ্ন।

প্রথম আলো: ঐকমত্য কমিশনে সংবিধানসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চলমান আলোচনা বা দর–কষাকষি চলছে, সেখানে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হলেও ভবিষ্যতে কি সেই ঐকমত্য বা সমঝোতাকে ধরে রাখা যাবে?

কাজী মারুফুল ইসলাম: ভবিষ্যতের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করা দুরূহ। রাজনৈতিক সমঝোতার ব্যাপারে মন্তব্য করা তো আরও দুরূহ।

আমরা যদি খেয়াল করি তাহলে দেখব, যেকোনো সমঝোতা থাকা না–থাকা তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। এগুলো আইনগত বা প্রাতিষ্ঠানিক ইন্টিগ্রেশন, সাংস্কৃতিক অ্যাডাপশন এবং ইনসেনটিভ কাঠামোর উপস্থিতি। অর্থাৎ এই সমঝোতা আইনগত কাঠামোতে কতটা আত্তীকরণ হচ্ছে; দ্বিতীয়ত, এই সমঝোতাকে মান্য করার বিষয়টি আমাদের মূল্যবোধ-দৃষ্টিভঙ্গি-মনোজগতে কতটা প্রবেশ করছে বা কীভাবে সেখানে মূল্যায়িত হচ্ছে; আর শেষে বলতে হবে যে সমঝোতা মানলে কী লাভ বা না মানলে কী ক্ষতি হবে, তা কতটা স্পষ্টভাবে নির্ধারিত আছে তার ওপর।

এ কারণে এই সমঝোতার একটি আইনগত ভিত্তি দরকার; যদিও সেটাই যথেষ্ট নয়। একই সঙ্গে সাংস্কৃতিক দিক ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রণোদনা স্পষ্ট করা দরকার।

আমার মনে হয়, জুলাই অভ্যুত্থান আমাদের ন্যূনতম এই শিক্ষা দিয়েছে যে কোনো একটি দল যদি স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে চায়, তার পরিণতি খুব খারাপ হবে। সমঝোতাকে জায়গায় রাখার জন্য শেষ পর্যন্ত নাগরিকদের পক্ষ থেকে দেওয়া চাপই মুখ্য। নাগরিক সমাজ, মিডিয়া ও আমাদের তরুণেরা যদি তাঁদের চাপটা বজায় রাখতে পারেন, তাহলে এই সমঝোতা ভেঙে দেওয়া খুব সহজ হবে না।

প্রথম আলো: জুলাই সনদে যেসব প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে, দেখা যাচ্ছে, এর মধ্যে অনেক বিষয়েই এখনো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য রয়ে গেছে। জুলাই সনদ কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, সে বিষয়েও অনিশ্চয়তা আছে। এ রকম অবস্থায় এই সনদ কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তনে কতটুকু কাজ করবে বলে আপনি মনে করছেন?

কাজী মারুফুল ইসলাম: দেখেন, সনদ কোনো পবিত্র বাণীর সমাহার নয়, এটা একটা দলিলমাত্র। সনদ নিজে থেকে প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন করতে পারবে না। কিন্তু একটি ঐকমত্যের সনদ আমাদের এটা বলতে পারবে যে আমাদের সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষা কী, তার কতটুকু আমরা করতে পারলাম, আর কী কী করতে পারলাম না। যখন পারব না তখন প্রশ্ন উঠবে, কেন পারলাম না? কার জন্য পারলাম না?

দক্ষিণ আফ্রিকা, তিউনিসিয়া, নেপাল প্রভৃতি দেশে এ রকম সমঝোতার সনদ তৈরির উদাহরণ আছে, যা সেখানকার রাজনৈতিক দলগুলো অনেকাংশে মেনে চলার চেষ্টা করেছে। আমাদের চলমান সংস্কার সংলাপে বর্তমানে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলটি মৌলিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে অনেকগুলো বিষয়ে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে। এখানে দলটি বড় সংগঠন হওয়ার যে সুবিধা, তা নেওয়ার চেষ্টা করছে। সাধারণভাবে রাজনীতিতে এটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু বাংলাদেশ এ মুহূর্তে কোনো সাধারণ সময় পার করছে না। এখন একটা অনন্য ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ, এখানে সব কটি দলকে তাদের দলীয় খোলস থেকে বেরিয়ে এসে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা দেখাতে হবে।

প্রথম আলো: এ ধরনের সনদ বা সমঝোতা বাস্তবায়নের পদ্ধতি কী হতে পারে? সমঝোতায় পৌঁছানো দলগুলো যদি নির্বাচন বা সরকার গঠনের পর সমঝোতায় দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে আগ্রহী না হয়, তাহলে কী হবে?

কাজী মারুফুল ইসলাম: সনদ কতটুকু মান্য করা হবে, তা নির্ভর করছে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো তথা রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। দলগুলোকে সনদ প্রতিপালনে একধরনের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করার জন্য তাকে আইনগত ভিত্তি দিতে হবে। সেটা সংবিধানের সঙ্গে ইন্টিগ্রেট করা বা আইনে রূপান্তরিত করা যেতে পারে। আইনগত ভিত্তি থাকলে সেটাকে নিয়ে দেনদরবার করা সহজ হয়।

যেহেতু এনসিসি বা জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল নিয়ে সমঝোতা তৈরি হলো না, সে কারণে আমি বরং একটা ‘সিটিজেনস কাউন্সিল অন কনস্টিটিউশনাল অ্যাফেয়ার্স’ গঠন করার প্রস্তাব করতে চাই। এখানে সাবেক বিচারপতি, আইনজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটা কাউন্সিল রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের বাইরে থেকেও পরামর্শমূলক ও নজরদারির ভূমিকা পালন করতে পারে।

তবে শেষ কথা হলো, দেশের নাগরিকদেরও তার যে রাজনৈতিক কর্তাস্বত্বার বিকাশ ও প্রয়োগ করার ব্যাপার আছে। অর্থাৎ এসব নাগরিকের একটা রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে গড়ে ওঠা দরকার, যেখানে তাঁর নাগরিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন হওয়ার প্রক্রিয়াকে ধরতে পারবে বা চ্যালেঞ্জ করতে পারবে।

রাজনৈতিক দলগুলো যেহেতু দিন শেষে জনগণের কাছে যেতে বাধ্য, সেই কারণে একটা ফাংশনাল নির্বাচনী গণতন্ত্র যেকোনো সনদ বা সমঝোতা বাস্তবায়নের প্রাথমিক শর্ত হিসেবে কাজ করে, যা একই সঙ্গে ডিটারেন্ট হিসেবেও কাজ করতে পারে।

প্রথম আলো: নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন কথাবার্তা হচ্ছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে আপনি কী ধরনের চ্যালেঞ্জ বা ঝুঁকি দেখছেন?

কাজী মারুফুল ইসলাম: অন্তর্বর্তী সরকার অনেকগুলো কারণে নিজেদের কর্তৃত্বের কার্যকর ব্যবহার করতে পারেনি। এ কারণে বর্তমান পরিস্থিতিতে একটা জাতীয় নির্বাচন অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হতে গেলে যে পরিস্থিতি থাকা দরকার, তা এই মুহূর্তে ঠিক কতটা আছে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

এর মূল কারণ, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এত আলোচনার পরও পরস্পরের প্রতি আস্থার জায়গা যথেষ্ট শক্ত নয়। এখনো মাঠপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ আছে। তৃণমূল পর্যায়ে প্রচুর অস্ত্র ও অবৈধ টাকার উপস্থিতি রয়ে গেছে, যা নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে ব্যবহৃত হতে পারে।

আমার মতে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্রিয় ভূমিকা, সিভিল প্রশাসনের সহযোগিতা, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ন্যূনতম ঐকমত্য, নির্বাচন কমিশন ও অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষ ও শক্ত ভূমিকা দরকার। এর যেকোনো একটির অনুপস্থিতি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

প্রথম আলো: সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছে জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি। এই দলে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া অনেক তরুণ রয়েছেন। কিন্তু নানা কারণে দলটি সমালোচিত ও বিতর্কিত হচ্ছে। এই দলের কর্মকাণ্ড ও সাম্প্রতিক অবস্থানের মধ্যে গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন কতটা দেখছেন?

কাজী মারুফুল ইসলাম: তরুণদের কাছে আমার প্রত্যাশা অনেক। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে তরুণেরা নেতৃত্ব দিয়েছেন আর পুরো জাতি তাঁদের অনুসরণ করেছে। আর এ কারণেই তাঁদের কাছে প্রত্যাশা বেড়ে গেছে। কিন্তু তরুণদের যে নতুন দল আত্মপ্রকাশ করেছে, সেই দলটি এরই মধ্যে এমন কিছু অবস্থান নিয়েছে, যার ফলে শুরুতেই তাদের প্রতি আস্থায় চিড় ধরার উপক্রম হয়েছে।

বিশেষ করে আমি চাঁদাবাজির প্রসঙ্গ তুলব। আর একই সঙ্গে এটাও বলতে হবে যে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি নারী, ট্রান্সজেন্ডার এবং বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষেরা অংশ নিয়েছিলেন। এই বৈচিত্র্যময় অংশগ্রহণ সত্ত্বেও তাঁদের ইস্যুগুলোতে এনসিপি যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে বা যে অবস্থান নিয়েছে, তা অনেককে হতাশ করেছে। কিন্তু আমি মনে করি, এনসিপিই তরুণদের একমাত্র প্ল্যাটফর্ম নয়। আরও তরুণেরাও নিশ্চয় এগিয়ে আসবেন তাঁদের অংশীদারত্ব নিশ্চিত করার জন্য।

প্রথম আলো: দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এই দলের একটি কার্যকর বিকল্প হিসেবে গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখছেন কতটুকু?

কাজী মারুফুল ইসলাম: আমাদের মুশকিল হচ্ছে, বর্তমান রাজনৈতিক পরিসরে বিকল্পের সংখ্যা অনেক কম। আদর্শের জায়গা থেকে দেখলে দেখা যাবে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি, এরা সবাই মোটাদাগে ডানপন্থী রাজনীতিকে প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ বরাবর মধ্যপন্থী দল বা আদর্শ পছন্দ করে। এ দেশে এখনো মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে, নারী প্রশ্নে, মানুষের বাক্‌স্বাধীনতার প্রশ্নে, জীবনযাপনের স্বাধীনতার প্রশ্নে একটা বিশাল মধ্যপন্থী লিবারেল ভোটার গোষ্ঠী রয়েছে। কিন্তু তাদের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে, এমন রাজনৈতিক দল দেখা যাচ্ছে না।

নতুন গড়ে ওঠা দলটি যদি তাদের প্রাথমিক ভুলগুলো শুধরে দেশের একটি উদার মধ্যপন্থী দল হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে যথাযথ সম্মান দেখিয়ে জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষাকে লক্ষ্য হিসেবে নিয়ে নিজেদের গুছিয়ে নিতে পারে, তাহলে তাদের পক্ষে প্রচলিত রাজনৈতিক বাইনারির বাইরে একটা কার্যকর বিকল্প হিসেবে গড়ে ওঠার সম্ভাবনা আছে।

প্রথম আলো: বাংলাদেশে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় বাধাগুলো আসলে কী?

কাজী মারুফুল ইসলাম: এই সময়ের প্রধান সমস্যা হলো রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় শিকড় গেড়ে থাকা গোষ্ঠীতন্ত্র। অলিগার্কদের চক্র এখনো অনেক শক্তিশালী। এই সময়ে আমাদের অন্যতম কাজ হলো এই গোষ্ঠীতন্ত্র গড়ে ওঠার সংস্কৃতির বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, চ্যালেঞ্জ করা।

আমাদের এখানে একটা বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক কাঠামো কাজ করছে। এটা ভাঙা খুব জরুরি। এটা অক্ষত রেখে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গণতান্ত্রিক সমাজ গঠন প্রায় অসম্ভব।

সূত্র, প্রথম আলো