বাংলাদেশের সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা একটি বিস্ময়কর দ্বৈত বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি: একদিকে কিছু দৃঢ়তা ও ইতিবাচক অগ্রগতি, অন্যদিকে প্রকট বিশৃঙ্খলা ও কাঠামোগত দুর্বলতা। দীর্ঘদিনের চিহ্নিত সমস্যা, যেমন অপ্রতুল বাজেট বরাদ্দ, ব্যাপক দুর্নীতি, কর্মস্থলে অনুপস্থিতি, অনুন্নত অবকাঠামো ও ভিড়ভাট্টা স্বাস্থ্য খাতকে কার্যকরভাবে পরিচালনার পথে বড় বাধা হিসেবে বিরাজ করছে।

এসব সমস্যার পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ ও বহিঃপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগত জটিলতা পুরো ব্যবস্থাকে আরও দুর্বল করে তুলেছে। তবে এই দৃশ্যমান বাস্তবতার আড়ালে দুটি অজানা সত্য লুকিয়ে রয়েছে, যেগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত ও নিরূপণ করা গেলে স্বাস্থ্যব্যবস্থার দক্ষতা ও জনগণের আস্থা পুনর্গঠনে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখতে পারে।

এই দুটি হলো—সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রদানকৃত স্বাস্থ্যসেবার প্রকৃত মূল্য; এবং ব্যবস্থাগত অপচয়ের আর্থিক মূল্য। এই গোপন সত্যগুলো উন্মোচন করতে পারলে স্বাস্থ্য খাতের কার্যকারিতা ও জনমনে আস্থা বাড়ানোর জন্য বাস্তবসম্মত সংস্কারের পথ খুলে যাবে।

বাংলাদেশের সরকারি স্বাস্থ্য খাত চরম সীমাবদ্ধতার মধ্যে পরিচালিত হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে স্বাস্থ্য বাজেট বরাদ্দ সবচেয়ে কম এবং মাথাপিছু স্বাস্থ্যব্যয় আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় অনেক কম।

দুর্নীতির কারণে জনগণের আস্থা নষ্ট হচ্ছে এবং সরকারি সম্পদের অপচয় ঘটছে, যার প্রতিফলন দেখা যায় যেমন কেনাকাটার অনিয়মে, তেমনি চিকিৎসকদের কর্মস্থলে অনুপস্থিতির মতো আচরণে। অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, যেমন ওষুধ সংরক্ষণের অনুপযুক্ততা, অপ্রতুল রোগনির্ণয় সুবিধা—সব মিলিয়ে রোগীরা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হন।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় একটি আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর অধীন পরিচালিত হচ্ছে, যেখানে পরিকল্পনা, অর্থ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্য খাতকে ভিন্ন মর্যাদায় দেখার পরিবর্তে অন্যান্য খাতের মতোই একই পাল্লায় দেখছে এবং মানবিক প্রয়োজনের চেয়ে আর্থিক সাশ্রয় অগ্রাধিকার পাচ্ছে।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ভেতরেও দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অসমতা বিদ্যমান, যার ফলে সচিবালয়, অধিদপ্তর ও মাঠপর্যায়ে ব্যবস্থাপনার মধ্যে একটি বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে।

বিদ্যমান পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট (পিপিএ) ও রুলস (পিপিআর) অনুযায়ী, কেনাকাটার জটিলতা ও এসেন্টিয়াল ড্রাগ কোম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল) ও সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরেজ ডিপোর (সিএমএসডি) সক্ষমতার ঘাটতির কারণে ওষুধ ও মেডিকেল ইকুইপমেন্ট সরবরাহের ব্যবস্থায়ও সংকট বিরাজমান।

আবার ন্যাশনাল ইলেকট্রো-মেডিকেল ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার (নিমিউ অ্যান্ড টিসি), ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স অর্গানাইজেশন (টেমও), স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের সীমাবদ্ধতা ও গাফিলতির চিত্র কারোর অজানা নয়। আর অ্যাকাউন্টস ও অডিট অফিসের দৈরাত্ম্যের চিত্রও আমাদের অজানা নয়।

সরকারি হাসপাতালে আগত রোগীরা অত্যন্ত স্বল্প খরচে যে চিকিৎসাসেবা পান, তা সাম্যভিত্তিক সেবা নিশ্চিতকরণে গুরুত্বপূর্ণ হলেও ব্যবস্থাটি সেবার প্রকৃত মূল্যকে আড়াল করে রাখে। এ কারণে রোগীরা বুঝতে পারেন না যে একটি সেবার পেছনে কী পরিমাণ জনবল, প্রযুক্তি ও অবকাঠামোগত সম্পদ নিয়োজিত থাকে। অনেক সময় তাঁরা এই সেবার মূল্য ও গুরুত্ব যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারেন না এবং সেবাকে অবমূল্যায়ন করেন।

হাসপাতাল কিংবা স্বাস্থ্যকর্মীরাও তাঁদের প্রদত্ত সেবার প্রকৃত সংযোজিত মূল্য সম্পর্কে প্রায়ই সচেতন নন। একটি সেবা প্রদানে যে পরিমাণ মানবসম্পদ, অর্থ ও উপকরণ ব্যয় হয়, তা নিরূপণের জন্য অধিকাংশ হাসপাতালে কোনো কাঠামোগত বা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নেই। এর ফলে অপচয়, ওষুধের অপব্যবহার ও দায়িত্বহীনতার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।

সরকার কেবল স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ ও ব্যয়ের হিসাব রাখে, কিন্তু এই ব্যয়ে যে সেবাগুলো প্রদান করা হয়, সেগুলোর আর্থিক বা গুণগত মূল্য নিরূপণ করা হয় না। ফলে বাজেট বরাদ্দে অগ্রাধিকার নির্ধারণ বা বাজেট বৃদ্ধির যৌক্তিকতা তুলে ধরাও কঠিন হয়ে পড়ে। এ কারণে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বৃদ্ধির পেছনে রাজনৈতিক আকর্ষণও দুর্বল হয়ে যায়।

যেহেতু বেসরকারি খাতে একই ধরনের সেবা প্রদান করা হয়ে থাকে, সরকার চাইলে ডায়াগনোসিস রিলেটেড গ্রুপভিত্তিক (ডিআরজি) ক্লাস্টার পদ্ধতির মাধ্যমে সেবাগুলোর মূল্য নির্ধারণ করতে পারে, যেখানে গুণগত মানের সমন্বয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে সরকার একদিকে সেবার প্রকৃত অর্থমূল্য জনগণের সামনে উপস্থাপন করতে পারবে, অন্যদিকে তথ্যভিত্তিক নীতি প্রণয়নে সহায়ক হবে এবং সর্বোপরি, জনগণের আস্থা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত এখন একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। সমস্যাগুলো জটিল, কিন্তু সম্ভাবনাগুলো আরও বিস্তৃত। সেবার প্রকৃত মূল্য ও অপচয়ের আর্থিক বোঝাপড়া নিশ্চিত করতে পারলে সবার জন্য মানসম্মত ও ন্যায্য সেবা নিশ্চিত করা যাবে। এ জন্য প্রয়োজন স্বচ্ছতা, তথ্যনির্ভর সিদ্ধান্ত ও সাহসী রাজনৈতিক উদ্যোগ।

দ্বিতীয় গোপন সত্য হলো, স্বাস্থ্য খাতে বিদ্যমান অপচয়ের আর্থিক মূল্য নিরূপণ। দুর্নীতি, অনুপস্থিতি, সরবরাহব্যবস্থার জটিলতা ও অদক্ষ সম্পদ ব্যবহারের মতো অপচয় স্বীকৃত হলেও এসবের আর্থিক ক্ষতির সুনির্দিষ্ট হিসাব নেই।

অবেদনবিদ না থাকায় বা অপারেশন থিয়েটার অকার্যকর থাকায় কোনো সার্জন অস্ত্রোপচার না করতে পারলে তাঁকে প্রদত্ত বেতন-ভাতার অর্থ একটি পরিষ্কার অপচয়। একইভাবে, রোগনির্ণয় যন্ত্রপাতি নষ্ট থাকলে সংশ্লিষ্ট টেকনোলজিস্টের বেতন-ভাতাও অপচয় হিসেবে বিবেচিত হয়। আবার টেকনোলজিস্ট না থাকার কারণে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি থাকা সত্ত্বেও রোগনির্ণয় ল্যাব চালু না থাকলে যন্ত্রপাতি ক্রয়ের বিপুল ব্যয়ও অর্থহীন হয়ে পড়ে। এমনকি অ্যাম্বুলেন্স বিদ্যমান থাকলেও চালকের অভাবে তা সচল না থাকলে, ক্রয় বাবদ ব্যয়কৃত অর্থও কার্যত অপচয় হিসেবেই গণ্য হয়।

এই অপচয়গুলোর পরিমাণ নিরূপণ করা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। যেমন কর্মচারীদের অনুপস্থিতির কারণে সরকারের প্রদত্ত বেতনের আর্থিক ক্ষতি হিসাব করা সম্ভব; সরবরাহব্যবস্থায় অপচয় চিহ্নিত করা যেতে পারে নষ্ট হওয়া ওষুধের পরিমাণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে; আবার দুর্নীতির প্রভাব বোঝা যেতে পারে বাজারদর ও চুক্তিমূল্যের ব্যবধান মূল্যায়ন করে। এ ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে সরকার একটি সামগ্রিক আর্থিক চিত্র প্রণয়ন করতে পারবে, যা সুনির্দিষ্ট ও লক্ষ্যভিত্তিক সংস্কারের জন্য শক্তিশালী ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে।

এই দুই অজানা বাস্তবতা—সেবার মূল্য ও অপচয়ের পরিমাণ উন্মোচন করলে স্বাস্থ্য খাতের রূপান্তর সম্ভব। ফলে রোগীরা সেবার প্রকৃত মূল্য বুঝতে পারবেন, সেবা প্রদানকারীরা দক্ষতা ও মানোন্নয়নে আগ্রহী হবেন এবং স্বাস্থ্য খাত অধিক বাজেট দাবি করার যৌক্তিক ভিত্তি অর্জন করবে। সেবার প্রকৃত মূল্য ও অপচয়ের আর্থিক পরিমাণ—এই দুই বাস্তবতা একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। সেবার মূল্য নির্ধারণ তখনই বাস্তবসম্মত হবে, যখন অপচয় নিয়ন্ত্রণে আসবে। আবার অপচয় কমাতে পারলে সেবার প্রকৃত মূল্য আরও স্বচ্ছভাবে নিরূপণ করা যাবে।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত এখন একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। সমস্যাগুলো জটিল, কিন্তু সম্ভাবনাগুলো আরও বিস্তৃত। সেবার প্রকৃত মূল্য ও অপচয়ের আর্থিক বোঝাপড়া নিশ্চিত করতে পারলে সবার জন্য মানসম্মত ও ন্যায্য সেবা নিশ্চিত করা যাবে। এ জন্য প্রয়োজন স্বচ্ছতা, তথ্যনির্ভর সিদ্ধান্ত ও সাহসী রাজনৈতিক উদ্যোগ।

একটি দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ তার জনগণের স্বাস্থ্য। এই উপলব্ধিকে সামনে রেখে এখনই সময় এই গোপন সত্যগুলো প্রকাশ, পরিমাপ ও কার্যকর সংস্কার বাস্তবায়নের। আশা করা যায়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো এসব গোপন সত্য প্রকাশে এগিয়ে আসবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট এ কাজে সরকারকে পূর্ণ সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছে।

সৈয়দ আব্দুল হামিদ অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মতামত লেখকের নিজস্ব

সূত্র, প্রথম আলো