বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জনে মূল ভূমিকায় রয়েছে পাবলিক হেলথ। জনস্বাস্থ্যের সফলতা বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত। দেশে বিভিন্ন সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ, টিকাদান কর্মসূচি, মা ও শিশুস্বাস্থ্য উন্নয়ন, পুষ্টি কার্যক্রম এবং সম্প্রতি করোনা মহামারির মতো সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের সক্ষমতা প্রমাণিত হয়েছে। তবে এসব অর্জনের পাশাপাশি দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এখনো বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তন, নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স, মানবসম্পদের ঘাটতি, শহুরে স্বাস্থ্য সমস্যাসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ এখন জাতীয় ও বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় টেকসই হস্তক্ষেপের জন্য জনস্বাস্থ্য নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। এজন্য বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা, নীতিনির্ধারণ এবং দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী তৈরির জন্য একটি স্বতন্ত্র পাবলিক হেলথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের দাবি।
বাংলাদেশে পাবলিক হেলথের উল্লেখযোগ্য অর্জন
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ধীরে ধীরে স্বাস্থ্য খাতের পরিকাঠামো গড়ে তোলে। ১৯৭৮ সালে আলমা আতা প্রাইমারি হেলথকেয়ার ঘোষণার পর বাংলাদেশ প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়। এতে মা ও শিশুমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। ১৯৭৯ সালে ইপিআই (Expanded Programme on Immunization) কর্মসূচির মাধ্যমে শিশুদের টিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে এ কর্মসূচির আওতায় ১২টি রোগের বিরুদ্ধে টিকা দেয়া হয় এবং টিকাদানের পরিসর প্রায় ৯৭ শতাংশ। এর ফলে নিউমোনিয়া, হুপিং কাশি, ডিপথেরিয়া, হেপাটাইটিস-বি, টিটেনাস প্রভৃতি রোগের প্রকোপ কমেছে। এসব সফলতার মূল কারণ ছিল বিজ্ঞানভিত্তিক হস্তক্ষেপ, মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মী, স্বাস্থ্যশিক্ষা কার্যক্রম ও উন্নত টিকা কর্মসূচি। আর এসবই পাবলিক হেলথ বা জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পদক্ষেপ ও কর্মকাণ্ড।
সংক্রামক রোগ নির্মূল কার্যক্রম
২০২৩ সালের ৩১ অক্টোবর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশকে কালাজ্বরমুক্ত ঘোষণা করেছে। এটি বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য ইতিহাসে এক অনন্য অর্জন। কালাজ্বর একসময় দেশের ৪০টি জেলার স্থানীয় রোগ ছিল। ২০০৫ সালে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপাল মিলে এ ভাইরাস নির্মূল কার্যক্রম গ্রহণ করে। বাংলাদেশে রোগের বাহক বালুমাছি নিয়ন্ত্রণ, রোগীদের দ্রুত শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্যশিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে সফলভাবে এ রোগ নির্মূল করা সম্ভব হয়। পাশাপাশি পোলিও নির্মূল কার্যক্রমে বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রশংসা পেয়েছে। এছাড়া ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়া, ব্রুসেলোসিস, এনডেমিক রোগ এবং কোভিড-১৯ মোকাবিলায় দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা কার্যকরভাবে দায়িত্ব পালন করেছে। সফলতা আছে গোদরোগ নির্মূলেও। এটি একসময় দেশের উপকূলীয় ও দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত ছিল।
বাংলাদেশে পাবলিক হেলথ শিক্ষার বর্তমান অবস্থা ও সীমাবদ্ধতা
বর্তমানে বাংলাদেশে পূর্ণাঙ্গ কোনো পাবলিক হেলথ বিশ্ববিদ্যালয় নেই। ঢাকার জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম), ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্ট স্কুল, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি ও কিছু প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে পাবলিক হেলথে মাস্টার্স ও গবেষণা চালু থাকলেও এসব প্রতিষ্ঠান মেডিকেল বা বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়। ফলে এপিডেমিওলজি, হেলথ ইকোনমিক্স, এনভায়রনমেন্টাল হেলথ, ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট, পেশাগত স্বাস্থ্যসহ সব শাখায় সমন্বিত শিক্ষা ও গবেষণা সম্ভব হচ্ছে না। অধিকাংশ গবেষণাদাতা-নির্ভর হওয়ায় দীর্ঘমেয়াদি ও প্রমাণভিত্তিক গবেষণার সুযোগও সীমিত।
বর্তমানে দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো অসংক্রামক রোগ, যেমন হৃদরোগ, ক্যানসার, ডায়াবেটিস ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, যা মোট মৃত্যুর প্রায় ৭০ শতাংশ দায়ী। পাশাপাশি জনবল ঘাটতিও বড় সমস্যা। প্রতি ১০ হাজার জনে মাত্র ৫ দশমিক ৮ জন চিকিৎসক ও ২ দশমিক ৮ জন নার্স বিদ্যমান, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত মানের নিচে। দক্ষ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ, তথ্য বিশ্লেষক ও ওয়ান হেলথ এক্সপার্ট তৈরি করতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। এ ঘাটতি পূরণে একটি স্বতন্ত্র ও গবেষণাভিত্তিক পাবলিক হেলথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এখন অত্যন্ত জরুরি।
পাবলিক হেলথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অপরিহার্যতা
বাংলাদেশে একটি স্বতন্ত্র পাবলিক হেলথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলে দেশের স্বাস্থ্য খাতে বহুমাত্রিক পরিবর্তন আসবে। যেমন—
বহুমাত্রিক জনস্বাস্থ্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মেডিকেল, নন-মেডিকেল, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, পরিবেশবিদ, নীতিনির্ধারক—সবাইকে এক ছাতার নিচে এনে সমন্বিত শিক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে।
স্বাস্থ্য অর্থনীতির উপকরণ ও পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করে দেশের সীমিত স্বাস্থ্যসম্পদ যৌক্তিকভাবে ব্যবহার করে জনগণের অসীম স্বাস্থ্যচাহিদা মেটানো সম্ভব হবে।
ডেঙ্গু, করোনা, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স, পেশাগত স্বাস্থ্যঝুঁকি, জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগ মোকাবিলা প্রভৃতি নিয়ে প্রমাণভিত্তিক ও টেকসই গবেষণা হবে।
সরকার ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নীতিমালায় বাস্তবভিত্তিক ও তথ্যনির্ভর পরামর্শ প্রদান করা সম্ভব হবে।
দক্ষ এপিডেমিওলোজিস্ট, হেলথ ইকোনমিস্ট, হেলথ পলিসি মেকার, এনভায়রনমেন্টাল হেলথ এক্সপার্ট, স্বাস্থ্যতথ্য ব্যবস্থাপক ও ডিজিটাল হেলথ বিশেষজ্ঞ তৈরি হবে।
বিশ্বব্যাপী পাবলিক হেলথ নেটওয়ার্কে অংশগ্রহণ ও যৌথ গবেষণা কার্যক্রমের সুযোগ বাড়বে।
ডিজিটাল হেলথ, স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থাপনা, টেলিমেডিসিন ও আচরণগত হেলথ গবেষণায় একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী অবকাঠামো গড়ে উঠবে।
আন্তর্জাতিক উদাহরণ ও অনুপ্রেরণা
বিশ্বের অনেক উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে স্বতন্ত্র পাবলিক হেলথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভারতের PHFI ও IIPH জনস্বাস্থ্য গবেষণা, নীতি উন্নয়ন ও মানবসম্পদ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। নেপালের Tribhuvan University Public Health Institute ও শ্রীলঙ্কার University of Colombo জনস্বাস্থ্য শিক্ষায় উৎকর্ষ অর্জন করেছে। থাইল্যান্ডের Mahidol University, যুক্তরাষ্ট্রের Johns Hopkins University-সহ মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াতেও শক্তিশালী পাবলিক হেলথ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যা স্থানীয় স্বাস্থ্যনীতি নির্ধারণে ও চাহিদাভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশের জন্য এ উদাহরণগুলো অনুপ্রেরণাদায়ক। একটি পূর্ণাঙ্গ পাবলিক হেলথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন গবেষণা ও নীতিনির্ধারণ সম্ভব হবে। এটি জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে এবং ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে ‘স্বাস্থ্য সবার জন্য’ লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হবে।
লেখক : পরিচালক, নিপসম, মহাখালী, ঢাকা