মশাবাহিত প্রাণঘাতী রোগের মধ্যে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ আমাদের এখানে তুলনামূলক কম হলেও ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়া দ্বিবার্ষিক মহামারী হিসেবে রূপ নিয়েছে। এ বছর ডেঙ্গু তো পরের বছর চিকনগুনিয়া। ২০২৪ সালে শুধু ডেঙ্গুতেই আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় এক লাখ আর মারা যায় প্রায় ৬০০ জন। আর চিকনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের জীবনভর নানা উপসর্গ নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। তাই ম্যালেরিয়াসহ অন্যান্য মশাবাহিত (ভেক্টর) রোগ নির্মূলে সমন্বিত পরিকল্পনা ও কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে।

একই দিনে যখন দুইটি আন্তর্জাতিক দিবস পড়ে যায় আর তাদের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক থাকে, তখন নিবন্ধের শিরোনাম নির্বাচন করাটা একটু কঠিন হয়ে পড়ে। ২৫ এপ্রিল, ২০২৫ তারিখটি একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক ডিএনএ দিবস ও বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস। তাই প্রাণবিজ্ঞান ও স্বাস্থ্য গবেষণা খাতে দিনটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, সেজন্যই এমন শিরোনাম। প্রথমে শুরু করা যাক আন্তর্জাতিক ডিএনএ দিবস নিয়ে। সূত্রপাত ১৯৫৩ সালে হলেও দিবসটির প্রচলন খুব বেশিদিন হয়নি। বাংলাদেশে জীবপ্রযুক্তি বিভাগ বা জীবপ্রযুক্তি নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের ছাড়া এ দিবসের সঙ্গে বাকিরা খুব একটা পরিচিতও নন। ২০০৩ সালের এপ্রিলে যখন মানব জিনোম সিকোয়েন্সের স্বরূপ প্রকাশ উপযোগী হয়, তখন মার্কিন হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভস ও সিনেটের যৌথ ঘোষণায় ২৫ এপ্রিল, ২০০৩ দিনটিকে ওই বছরের জন্য ‘জাতীয় ডিএনএ দিবস’ ঘোষণা করা হয়। দিনটি বাছাই করার সবচেয়ে বড় কারণ, এটা ছিল ‘দ্বিসূত্রক ডিএনএ’ উদ্ভাবনের সুবর্ণজয়ন্তী। জেমস ওয়াটসন, ফ্রান্সিস ক্রিক ও উইলকিন্সের (ড. রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিনের সহায়তায়) আধুনিক জীববিজ্ঞান গবেষণার বাঁকপরিবর্তনকারী প্রবন্ধ ‘Molecular Structure of Nucleic Acids–A Structure for Deoxyribonucleic Acid’ ১৯৫৩ সালের ২৫ এপ্রিল বিশ্বখ্যাত ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত হয়। এ আবিষ্কারের জন্য ১৯৬২ সালে প্রথমোক্ত তিনজন নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০০৩ সালের এ দিনকে শুধু সে বছরের জন্য ডিএনএ দিবস ঘোষণা করা হলেও আমেরিকার জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধীনে National Human Genome Research Institute (NHGRI) ২০১২ সাল থেকে এ দিনকে ‘আন্তর্জাতিক ডিএনএ দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। এখন প্রায় প্রতিটি দেশের প্রাণবিজ্ঞান গবেষণাগার ও প্রতিষ্ঠানগুলোয় বিজ্ঞান মেলা, আলোচনা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও শিক্ষার্থীদের গবেষণামুখী নানা আয়োজনের মাধ্যমে দিবসটি পালিত হয়। আন্তর্জাতিক ডিএনএ দিবসের ত্রয়োদশ বার্ষিকী উপলক্ষে জাপানের নারা শহরে আয়োজিত সম্মেলনের এ বছরের মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘Unlocking the Power of Gene’ অথবা জিন ও জিনগত বৈশিষ্ট্য নিরূপণের সক্ষমতা অনেক অজানা সমস্যার সমাধান। এ সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনগণের মাঝে সাম্প্রতিক জীবপ্রযুক্তি গবেষণার অগ্রগতি তুলে ধরা ও মানবজীবনে জিনোম-বিজ্ঞানের ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো।

এবার আসা যাক ‘বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস’ প্রসঙ্গে। ২০০১ সাল থেকে আফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলো ম্যালেরিয়ার নির্মূলের অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে ২৫ এপ্রিলকে ‘আফ্রিকা ম্যালেরিয়া দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। ম্যালেরিয়ায় সবচেয়ে বেশি দুর্দশাগ্রস্ত মহাদেশ আফ্রিকা হলেও অন্যত্রও এর প্রকোপ থেমে নেই। তাই ম্যালেরিয়ার মতো জীবনঘাতী রোগ নিয়ে সারা বিশ্বে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ২০০৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৬০তম বৈশ্বিক সম্মেলনে এ দিনকে ‘বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ২০১৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সে বছরে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দুই কোটি অতিক্রম করেছিল আর মারা গিয়েছিল প্রায় সোয়া চার লাখ মানুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ম্যালেরিয়াকে জনস্বাস্থ্যের জন্য গণশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। নানামুখী গবেষণা উদ্যোগ, সরকারি-বেসরকারি প্রচেষ্টা ও নীতিমালা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের ফলে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ কমে এলেও তা একেবারে নির্মূল হয়ে যায়নি। এ বছরের বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘Malaria Ends with Us: Reinvest, Reimagine, Reignite’ অথবা সম্মিলিত প্রচেষ্টাই করবে ম্যালেরিয়া নির্মূল। যদিও বাংলাদেশে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তবে দক্ষিণ ও উত্তর-পূর্ব সীমান্তবর্তী ১৩টি জেলার ৭২টি উপজেলায় ম্যালেরিয়া রোগের প্রাদুর্ভাব রয়েছে। আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি এবং কক্সবাজার জেলা ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। তবে পার্বত্য তিনটি জেলার মধ্যে বান্দরবান জেলার তিনটি উপজেলা লামা, আলীকদম ও থানছি সবচেয়ে বেশি ম্যালেরিয়া ঝুঁকিতে রয়েছে। মশাবাহিত এ রোগে ২০২২ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৮ হাজার এবং মৃতের সংখ্যা ছিল ১৪। তবে তা পরের বছর কমে গিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ছয় এবং আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ২০ শতাংশ কমে। জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৭ সালের মধ্যে ম্যালেরিয়ায় মৃতের সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনা এবং ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ম্যালেরিয়া নির্মূলের অঙ্গীকার করা হয়।

মশাবাহিত প্রাণঘাতী রোগের মধ্যে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ আমাদের এখানে তুলনামূলক কম হলেও ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়া দ্বিবার্ষিক মহামারী হিসেবে রূপ নিয়েছে। এ বছর ডেঙ্গু তো পরের বছর চিকনগুনিয়া। ২০২৪ সালে শুধু ডেঙ্গুতেই আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় এক লাখ আর মারা যায় প্রায় ৬০০ জন। আর চিকনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের জীবনভর নানা উপসর্গ নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। তাই ম্যালেরিয়াসহ অন্যান্য মশাবাহিত (ভেক্টর) রোগ নির্মূলে সমন্বিত পরিকল্পনা ও কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে। জীবপ্রযুক্তি তথা জিনোম বিজ্ঞান এক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্য গবেষণা ও কর্মপরিকল্পনার একটি শক্তিশালী সহায়ক মাধ্যম হতে পারে। স্প্রে বা কীটনাশক ব্যবহার করেও যখন মশা দমন করা যাচ্ছে না। কেননা এরই মধ্যে স্প্রে বা রাসায়নিক কীটনাশকগুলো সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী (রেজিস্ট্যান্স) হয়ে উঠছে। কীটনাশকবিহীন পদ্ধতি যেমন স্টেরাইল মশা উদ্ভাবন আর্বোভাইরাসজনিত রোগ নিয়ন্ত্রণে কিছুটা সাফল্য দেখালেও ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠেনি। এক্ষেত্রে জেনেটিক ইমিউনাইজেশন প্রক্রিয়া খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে, যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট জীবাণুর বিরুদ্ধে বাহকের অভ্যন্তরে কার্যকরী অণু প্রবেশ করিয়ে ভেক্টরের সক্ষমতা কমানো সম্ভব। তাছাড়া জিন ড্রাইভ তথা জিনোম এডিটিং টুলস (CRISPR-Cas9) প্রযুক্তির ব্যবহার ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। বাহকের জেনেটিক মডিফিকেশন করে সংক্রমণ-অক্ষম প্রকরণ উদ্ভাবন অথবা বাহকের অভ্যন্তরে জীবাণু সংক্রমণের চক্র পূর্ণায়নে বাধা প্রদান করা যাবে। তাছাড়া নির্ভুল রোগ নির্ণয়ে RT-PCR প্রযুক্তির ভূমিকা তো আমরা করোনাকালেই অবলোকন করেছি। তাই রোগ নির্ণয়ে জীবপ্রযুক্তির জ্ঞানকে কাজে লাগাতে পারলে দ্রুত চিকিৎসা আরম্ভ করা সম্ভব হবে।

জনস্বাস্থ্য ও জীবপ্রযুক্তি একই অনুষদ ভুক্ত না হলেও বৃহৎ পরিসরে টেকসই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অর্জনের লক্ষ্যে একে অন্যের সহযোগী এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত থাকতে পারে বলে মনে হয় না। আমাদের নীতিমালাগুলোর আমূল পরিবর্তন না হলে এবং যুগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে না পারলে এখনো আমরা ধুঁকতে থাকব। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়াধীন ‘জাতীয় জীবপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউট’ এবং চিকিৎসক ও জীবপ্রযুক্তি গবেষকদের এগিয়ে আসতে হবে। ২০১৯ সালে জাতীয় জীবপ্রযুক্তি নীতি ও কর্মপরিকল্পনার খসড়া তৈরি হলেও বিভিন্ন সময়ে তিনবার চূড়ান্ত খসড়া সামনে এলেও পাঁচ বছরে তা আলোর মুখ দেখেনি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়াধীন মেডিকেল জীবপ্রযুক্তি কিংবা পরিবেশ মন্ত্রণালয়াধীন এনভায়রনমেন্টাল জীবপ্রযুক্তি নামে আলাদা আলাদা নীতিমালা না করে সামগ্রিক একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন, যেখানে জীবপ্রযুক্তি ব্যবহার করে আমাদের স্বাস্থ্য, কৃষি, পরিবেশ বিষয়ে সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারব। আন্তর্জাতিক ডিএনএ দিবস ও বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবসকে সামনে রেখে একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা শুরুর আশাবাদ ব্যক্ত করছি।

মো. মেহেদী হাসান সোহাগ: সহকারী অধ্যাপক, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র, বণিক বার্তা