গত বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দীন ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচের মধ্যে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের ষষ্ঠ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রায় ১৫ বছর পর বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের এই বৈঠক হয়। সর্বশেষ বৈঠক হয়েছিল, ২০১০ সালে। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জসীম উদ্দিন জানান, পাকিস্তানের সঙ্গে বিদ্যমান ঐতিহাসিক অমীমাংসিত বিষয়গুলো বৈঠকে উত্থাপন করা হয়েছে। তিনি জানান, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের যোগাযোগের মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্ক একটা পর্যায়ে এসেছে। এই সম্পর্ককে মজবুত ভিত্তি দিতে হলে একাত্তরে বাংলাদেশে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর গণহত্যার জন্য দেশটির আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়াসহ অমীমাংসিত তিনটি সমস্যার আশু সমাধান প্রয়োজন। অন্য দুটি সমস্যার মধ্যে রয়েছে, আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ন্যায্য হিস্যা প্রদান ও ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য পাওয়া বিদেশি সাহায্যের অর্থ হস্তান্তর। বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনা ৪.৩২ বিলিয়ন ডলার পাওয়ার বিষয়টি উত্থাপন করা হয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে বর্তমানে ১৪ জেলায় ৭৯টি ক্যাম্পে ৩ লাখ ২৪ হাজার ১৪৭ জন আটকে পড়া পাকিস্তানি রয়েছে। এর আগে ১ লাখ ২৬ হাজার ৯৪১ জন পাকিস্তানি ফিরে গেছে। বাংলাদেশের উত্থাপিত দাবিগুলোর ব্যাপারে পাকিস্তানের থেকে ইতিবাচক মনোভাব দেখানো হয়েছে। বলা হয়েছে, এ বিষয়ে ইতিবাচক আলোচনা অব্যাহত রাখতে ইসলামাবাদ প্রস্তুত।

একাত্তর সালে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। স্বাধীনতাকামী মানুষকে দমন করতেই এই হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। প্রায় ৯ মাস দেশের সর্বস্তরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করে। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের প্রতি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে বৈষম্যমূলক আচরণ করে। তার অন্যায্য আচরণে মানুষ ক্ষুব্ধ ছিল। তবে তার কোনো তোয়াক্কা না করে মানুষের ওপর জুলুম, নিপীড়ন ও নির্যাতন চালিয়ে যায়। পশ্চিম পাকিস্তানের এই বৈষম্যমূলক আচরণের পরিপ্রেক্ষিতেই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ দেশ স্বাধীন করতে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে অগ্রগতি হলেও কিছু অমিমাংসীত বিষয় এ সম্পর্ক আরও উন্নত হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়ে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখিত বিষয়গুলো উল্লেখযোগ্য। এসব বিষয় মীমাংসার জন্য উভয় পক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। তবে সুরাহা হয়নি। ফলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও গভীর হওয়ার ক্ষেত্রে ইস্যুগুলো ডুবন্ত আইস বার্গ হয়ে রয়েছে। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভারতের প্ররোচনায় এই সম্পর্ক উন্নয়নে কোনো উদ্যোগ তো নেনইনি, উল্টো সম্পর্ককে খারাপ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার যতরকম ব্যবস্থা রয়েছে, তা অবলম্বন করেছে। অথচ বিশ্বে বহু দেশ যুদ্ধ করে স্বাধীন হলেও বৈশ্বিক বাস্তবতার নিরিখে তাদের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়ন হয়েছে। পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়সহ বন্ধুত্বপূর্ণ সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় জাপান চীন দখল করে যে হত্যা-নির্যাতন চালিয়েছে, পরবর্তীতে জাপান চীনের কাছে ক্ষমা চেয়ে সম্পর্ক উন্নয়ন করেছে। এরকম আরও অনেক নজির রয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এক দেশের সাথে অন্যদেশের সম্পর্কের যেমন অবনতি হয়েছে, তেমনি বাস্তব পরিস্থিতি পারস্পরিক স্বার্থ বিবেচনায় সম্পর্কের উন্নয়নও হয়েছে। স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের সাথে যে শীতল সম্পর্ক ছিল, তা কাটানোর জন্য উভয় দেশই চেষ্টা চালিয়েছে এবং ধীরে ধীরে সম্পর্কের উন্নয়নও হয়েছে। একেবারে বৈরি রাষ্ট্র হিসেবে কেউ কাউকে বিবেচনা করেনি। পর্যবেক্ষক মহলের মতে, পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক প্রত্যাশিত পর্যায়ে পৌঁছাতো, যদি আওয়ামী সরকার ও ভারত বাধা হয়ে না দাঁড়াত। এখনই উপযুক্ত সময় বিষয়গুলো মীমাংসা করার।

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনামলে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কন্নোয়নের কোনো প্রচেষ্টাই নেয়া হয়নি। এমনকি, সম্পর্কন্নোয়নের ক্ষেত্রে যে বাধাগুলো ছিল, সেগুলো তুলে ধরে সমাধানেরও উদ্যোগ নেয়নি। উল্টো সম্পর্ক অবনতি করার নানা নেতিবাচক বক্তব্য দেয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কন্নোয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। দুই দেশের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের পারস্পরিক সফর শুরু হয়েছে। পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার আগামী ২৭ ও ২৮ এপ্রিল বাংলাদেশ সফরে আসবেন। পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কন্নোয়নের ক্ষেত্রে মূল যে তিনটি সমস্যা রয়েছে, সেগুলো তুলে ধরে অন্তর্বর্তী সরকার আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে সাধুবাদযোগ্য। পাকিস্তানের উচিৎ, বাংলাদেশের ন্যায্য এ দাবির ব্যাপারে উদ্যোগী হওয়া। এ দাবির ন্যায্যতা রয়েছে। মনে রাখা দরকার, দ্বিপাক্ষিক কোনো বিষয় বা সমস্যাই অসমাধানযোগ্য নয়। প্রয়োজন কেবল সদিচ্ছার। গণহত্যার জন্য ক্ষমা প্রার্থনায় অসম্মানিত হওয়ার কিছু নেই। পাওনা দেয়ার প্রশ্নে আপত্তিও থাকতে পারে না। আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফেরত নেয়া পাকিস্তানের অপরিহার্য কর্তব্য। পাকিস্তান দ্রুত এগুলোর ফয়সালা করতে পারলে তার সুনাম-সুখ্যাতি বরং আরো বাড়বে। দুই দেশের সম্পর্ক মজবুত হবে। বৈশ্বিক মেরুকরণ ও ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের বিষয়টি আমলে নিয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্পর্কন্নোয়ন দুই দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।

সূত্র, ইনকিলাব