সমুদ্র উপকূলবর্তী সংরক্ষিত বনের ওই জমিটি বন্দর কর্তৃপক্ষকে না দিয়ে সেখানে ম্যানগ্রোভ বনায়ন করতে চাইছে তারা। এ নিয়ে সরকারের দুই সংস্থার মধ্যে চলছে চিঠি চালাচালি।
জানা গেছে, বে-টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের নকশায় মধ্যম হালিশহর মৌজায় ৫১ দশমিক শূন্য ৮৫ একর এবং দক্ষিণ কাট্টলী মৌজায় দুটি দাগে ৬৬ ও ১৫০ একরসহ মোট ২৬৭ দশমিক শূন্য ৮৫ একর জমিকেও ধরেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। সংরক্ষিত বনভূমি হিসেবে গেজেটভুক্ত জমিটি নিজেদের করে নিতে তারা ২০১৯ সাল থেকেই চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে বন বিভাগ উপকূলীয় এ সংরক্ষিত বন হাতছাড়া করতে চায় না। বে-টার্মিনাল নির্মাণের জন্য বনের জমি না দেয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিয়েছে বন বিভাগ।
এ-সংক্রান্ত নথিপত্র থেকে জানা গেছে, বে-টার্মিনালের জন্য চাওয়া বন বিভাগের এসব জমিতে ১৯৭৮-৭৯, ২০০৫-০৬ ও ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ম্যানগ্রোভ বন সৃজন করা হয়। সেগুলো ২০১৭ সালের ২৫ জুলাই সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল, যা ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঘূর্ণিঝড়সহ বঙ্গোপসাগরের তীরে বালুচর জমে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবার বন্দর কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে বালি ভরাট করায় বাগানের আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন বিভাগ ওই জমিটি নিজেদের হাতে রাখতে দ্রুত ম্যানগ্রোভ বন সৃজনের কাজ শুরু করতে চাইছে।
বনভূমির কিছু অংশে বন বিভাগের বাগান থাকলেও বালুচরের অংশে কোনো গাছপালা নেই। এ অংশে উপকূলীয় অঞ্চলের লোকজনের জানমাল রক্ষায় ম্যানগ্রোভ ও ঝাউবাগান সৃজনের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছে বন বিভাগ। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সিভিল পিটিশন ফর লিভ টু আপিল নং-১৪৫৭ এবং ১৪৫৮ অনুযায়ীও এসব বনের শ্রেণী পরিবর্তনে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
বন বিভাগ বলছে, দেশে প্রয়োজনের তুলনায় এমনিতেই বনভূমির পরিমাণ খুবই কম। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নির্মাণকাজের জন্য নিয়মিতভাবে বনভূমি ব্যবহার করা হলে বনের পরিমাণ আরো সংকুচিত হয়ে পড়বে। এতে পরিবেশ তার ভারসাম্য হারিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধিসহ তীব্র আকার ধারণ করতে পারে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব।
সীতাকুণ্ড উপজেলার পাশে বন বিভাগের মিরসরাই রেঞ্জের ২২ হাজার ৩৩৫ একর বনভূমি বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) কাছে বরাদ্দ দেয়ায় ওই রেঞ্জে বর্তমানে বনভূমি নেই বললেই চলে। এখন সংরক্ষিত বনভূমি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত বা হস্তান্তর করা হলে জেলার সবুজ বেষ্টনীর (মিরসরাই থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত) ওপর বিরূপ প্রভাবসহ চট্টগ্রাম শহরকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতি থেকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করে বন বিভাগ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের প্রধান বন সংরক্ষক মোল্যা রেজাউল করিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বে-টার্মিনাল নির্মাণে আমাদের কাছে ২৬৭ একর জমি চেয়েছে। এ বনভূমি চট্টগ্রাম শহরসহ চট্টগ্রামের উপকূলীয় সুরক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মিরসরাইয়ে এরই মধ্যে অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য বিপুল পরিমাণ বন দেয়া হয়েছে। এভাবে উপকূলীয় বন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দেয়া হলে উপকূল অরক্ষিত হয়ে পড়বে। তাই বন বিভাগ এরই মধ্যে বন্দরকে সংরক্ষিত বন বে-টার্মিনাল প্রকল্পের জন্য না দেয়ার বিষয়ে জানিয়ে দিয়েছে। আমরা এ বনভূমিতে আরো বেশি ম্যানগ্রোভ বন সৃজন করে চট্টগ্রাম বন্দর, চট্টগ্রাম শহরসহ উপকূলীয় ভূমি, মানুষ ও সম্পদ রক্ষায় কাজ করছি।’
জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বে-টার্মিনাল প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়েছে। সর্বশেষ ২০ এপ্রিল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ১৪ হাজার ৯০৯ কোটি টাকার বে-টার্মিনাল মেরিন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট অনুমোদন হয়। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে ২০৩১ সালের জুন নাগাদ তা বাস্তবায়ন করবে। এ প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক দেবে ১০ হাজার ২৭২ কোটি এবং সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন ৪ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকা।
এর আগে ২০১৭ সালে বে-টার্মিনাল নির্মাণের কারিগরি, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সম্ভাব্যতা নিয়ে সমীক্ষা করে জার্মানির পরামর্শক প্রতিষ্ঠান শেল হর্ন। সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে প্রাথমিকভাবে ৩০০ মিটার লম্বা এবং ১২ মিটার ড্রাফটের (জাহাজের পানির নিচের অংশের দৈর্ঘ্য) জাহাজ বে-টার্মিনালে ভেড়ানো সম্ভব হবে।
তথ্যমতে, বে-টার্মিনাল প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ভূমির প্রয়োজন হচ্ছে প্রায় আড়াই হাজার একর। এর মধ্যে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে প্রতীকীমূল্যে সরকারি খাস জমি পাওয়া গেছে ৫০০ দশমিক ৭ একর। ব্যক্তি মালিকানাধীন ৬৬ দশমিক ৮৫ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। আর ব্যক্তি মালিকানাধীন ১৮৮ একর জমি অধিগ্রহণ নিয়ে চলছে মামলা। এছাড়া ১ হাজার ৬২০ একর জমি সমুদ্র থেকে রি-ক্লেইম করে উদ্ধার করবে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে বন বিভাগের ২৬৭ দশমিক শূন্য ৮৫ একর জমি বন বিভাগ থেকে বন্দোবস্ত নিতে চেষ্টা করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন,»‘বন বিভাগ যে জায়গা নিয়ে আপত্তি তুলেছে, এটা তাদের বোঝাপড়ায়ও গ্যাপ আছে। ওই জায়গাটুকু পানির নিচেই থাকে, যেটা ভাটার সময় দৃশ্যমান হয়। এছাড়া বে-টার্মিনাল সরকারের প্রায়োরিটি প্রজেক্ট। এটার সঙ্গে বিদেশী বিনিয়োগ ও দেশের আগামীর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড জড়িত। তাই বন বিভাগ এ সবকিছুই বিবেচনায় রাখবে বলে আশা করছি।’
বন কর্মকর্তারা বলছেন, রাজনৈতিক সরকারের সুবিধা নিয়ে ৫ আগস্টের আগে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা নানাভাবে বনের জমি ব্যবহার করেছে। এসব ক্ষেত্রে বন বিভাগের মতামতকে উপেক্ষা করা হয়েছে। সর্বশেষ ১৭ মার্চ ইকোট্যুরিজম পার্কের জন্য ২০১৭ সালে নেয়া প্রকল্পের অধীনে বেজার অনুকূলে যাওয়া ৯ হাজার ৪৬৭ একর জমি ফেরত নেয়া হয়েছে। এসব জমিকে বন বিভাগ আবারো রক্ষিত ঘোষণা করবে। একইভাবে মিরসরাই জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য বরাদ্দ দেয়া ২২ হাজার ৩৩৫ একর জমির মধ্যে ৪ হাজার ১০০ একর জমি ফেরত চেয়েছে বন বিভাগ। বর্তমানে নিজ নিজ সংস্থার নিজস্ব কর্মপরিধির সঙ্গে সমন্বয় করেই প্রকল্প বাস্তবায়ন, ভূমি বরাদ্দ কিংবা হস্তান্তরের প্রক্রিয়ায় হাঁটছে সরকার। তারই অংশ হিসেবে বন বিভাগ প্রাণ-প্রকৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক ইস্যুগুলোয় হস্তান্তর করা বনও ফেরত নিতে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন তারা।