উপযোগী আবহাওয়া ও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে মোট ইলিশের ৮৬ শতাংশই উৎপাদন হয় নদীমাতৃক বাংলাদেশে। সামুদ্রিক মাছ হলেও ডিম ছাড়তে স্রোতশীল নদীতে আসে ইলিশ। তবে এটি বেশ সংবেদনশীল মাছ। প্রতিকূল আবহাওয়ায় খুব ঘন ঘনই পরিবর্তন করে গতিপথ। সম্প্রতি বাংলাদেশেও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে ইলিশের আবাস ও জীবনাচরণ। নদ-নদীর দূষণে কমছে উৎপাদনও।

বিশেষজ্ঞরা জানান, নোনা জলের ইলিশ ডিম পাড়তে নদীর উজান ঠেলে মিঠা পানিতে উঠে আসে। ডিম ছেড়ে আবার ভাটিতে গা ভাসিয়ে ধরে সাগরের পথ। এর জন্য প্রয়োজন হয় পর্যাপ্ত পানিপ্রবাহের। বর্ষা মৌসুমে অর্থাৎ জুলাই থেকে অক্টোবরে মেঘনা নদীর নিম্নাঞ্চলের পানি স্বচ্ছ হয়ে ওঠে এবং লবণাক্ততা থাকে না। আবার প্রবল স্রোত ও জোয়ার-ভাটার কারণে ইলিশ সমুদ্র থেকে নদীতে আসতে শুরু করে। পাশাপাশি ইলিশের ডিম ছাড়ার সময় প্রচুর অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। বর্ষায় নদীর পানি তুলনামূলক উত্তাল থাকে বেশি। এ সময় পানিতে অক্সিজেনের মাত্রাও বেশি থাকে। এছাড়া মাছের বংশবিস্তারে পানির তাপমাত্রা একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এর ওপর নির্ভর করে মাছের ডিম ছাড়ার সময়। সামান্য তারতম্য হলেই মা-ইলিশ ডিম নষ্ট করে ফেলে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে নদীতে দখল-দূষণ, ডুবোচর ও অবকাঠামো নির্মাণ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইলিশের বিচরণসহ সার্বিক জীবনচক্রে ব্যাঘাত ঘটছে। হুমকিতে পড়েছে এর প্রজনন।

মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে মোট ইলিশ উৎপাদন হয়েছিল ২ লাখ ৯৮ হাজার টন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ, অর্থাৎ ৫ লাখ ১৭ হাজার টনে উন্নীত হয়। কিন্তু এর পর থেকেই ইলিশ আহরণ নানা কারণে শ্লথ হয়ে আসে। গত অর্থবছর তো উৎপাদন না বেড়ে উল্টো কমেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে ৫ লাখ ৭১ হাজার টন ইলিশ ধরা পড়লেও গত অর্থবছর তা কমে ৫ লাখ ২৯ হাজার টনে দাঁড়ায়। সে হিসাবে জনপ্রিয় মাছটির আহরণ কমেছে ৪২ হাজার টন।

ইলিশ আহরণ কমার পেছনে নদ-নদীর দূষণকে বড় কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর দূষণ শীতলক্ষ্যা হয়ে মেঘনায় যাচ্ছে, আর মেঘনা ইলিশ মাছের অন্যতম চলাচলের জায়গা। কিন্তু দিন দিন দূষণ বৃদ্ধির ফলে এখানে মাছের চলাচল কমে এসেছে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. নিয়ামুল নাসের বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দূষণের কারণে পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেলে যেকোনো মাছ তার আবাস বদলায়। একইভাবে ইলিশ যখন দেখে পদ্মা বা মেঘনায় দূষণ, তখন সে ওই এলাকায় আর ডিম পাড়তে আসে না।’

বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছে। ওয়ার্ল্ড ফিশের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বিশ্বের মোট ইলিশের ৮৬ শতাংশই উৎপাদন হয় এ দেশে।

দেশে রয়েছে এর চারটি প্রজনন ক্ষেত্র ও ছয়টি অভয়াশ্রম। চট্টগ্রামের মিরসরাই থেকে শুরু করে ভোলার লালমোহন উপজেলা পর্যন্ত ইলিশের সবচেয়ে বড় প্রজনন ক্ষেত্র। এর মধ্যে মনপুরা, ঢালচর, বালিরচর, মৌলভীরচর ডিম ছাড়ার সবচেয়ে বড় পয়েন্ট। চট্টগ্রাম, ভোলা, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, চাঁদপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা মিলিয়ে প্রায় সাত হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় ইলিশ সবচেয়ে বেশি ডিম ছাড়ে। এর বাইরে উপকূলের অন্যান্য নদীতেও ডিম ছাড়ে বলে জানান মৎস্য গবেষকরা। আর ইলিশের অভয়াশ্রমগুলো মূলত মেঘনা নদী ও তার অববাহিকা এবং পদ্মা ও মেঘনার সংযোগস্থলে অবস্থিত। এর মধ্যে চাঁদপুরে মেঘনার নিম্ন অববাহিকার ১০০ কিলোমিটার, ভোলায় শাহবাজপুর শাখা নদীর ৯০ কিলোমিটার ও তেঁতুলিয়া নদীর প্রায় ১০০ কিলোমিটার এলাকা অন্যতম। এছাড়া পদ্মার ২০ কিলোমিটার এলাকা, বরিশালের হিজলা, মেহেন্দীগঞ্জে মেঘনার প্রায় ৮২ কিলোমিটার এলাকাকেও ইলিশের অভয়াশ্রম হিসেবে ধরা হয়।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বঙ্গোপসাগর থেকে ইলিশ প্রবেশের মূল পথ মেঘনার বিভিন্ন স্থানে পলি জমে ডেগার চর ও ডুবোচর সৃষ্টি হয়ে আছে। ফলে মা-ইলিশ ডিম ছাড়ার জন্য মিঠা পানিতে প্রবেশে বাধা পেয়ে আবার সাগরেই ফিরে যাচ্ছে। আবার মেঘনায় ফোটা ইলিশের পোনাও বড় হওয়ার জন্য সমুদ্রে যেতে পারছে না। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আবার বর্ষায়ও বৃষ্টি কম হতে দেখা যাচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। তাতে মিঠা পানির স্তর কমে বেড়ে যাচ্ছে তাপমাত্রা। এর প্রভাব পড়ছে মেঘনায় আবদ্ধ ইলিশ ও জাটকার ওপর। এদিকে নির্দিষ্ট সময়ে মাছ ধরা নিষেধ থাকলেও অবাধে মা-ইলিশ ও জাটকা নিধন করে চলেন অসাধু জেলেরা। এ কারণেও দিন দিন মেঘনা থেকে সুস্বাদু ইলিশ হারিয়ে যাচ্ছে।

বরিশালের হিজলা উপজেলার বাসিন্দা ও মেঘনা নদীর জেলে সোলায়মান বেপারী জানান, সাগরে কিছু ইলিশ ধরা পড়লেও নদীতে একেবারেই মিলছে না। দুই-তিন বছর আগে যে ইলিশ ধরা পড়ত, তা এখন অর্ধেকে নেমে গেছে। সাগর মোহনায় ডুবোচর ও বিভিন্ন জালের মাধ্যমে মৎস্য শিকারের কারণেও নদীতে ইলিশ ভিড়তে পারছে না।

বরিশালের হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সাগর মোহনায় ডুবোচরের কারণে নদী নাব্য হারাচ্ছে। এতে জোয়ারের স্রোতের তীব্রতা কমে যাওয়ায় ইলিশ প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই তুলনামূলকভাবে নদ-নদীতে ইলিশ কমছে। সাগরের এসব মোহনায় ডুবোচর খনন করে নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনতে পারলে ইলিশ প্রবেশ এবং প্রজননে বাধা থাকবে না।’

মৎস্য গবেষকরা জানান, ইলিশের ধর্মই হচ্ছে সোজা পথে চলা। ডুবোচরে বাধা পেলে ওরা বিকল্প পথ না খুঁজে ফিরে যায় সাগরে। এ বিষয়ে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সাগর মোহনায় পলি পড়ার কারণে দেশের নদ-নদীতে ইলিশের প্রাপ্যতা কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের একটি বিরাট প্রভাব রয়েছে। ইলিশের জন্য যে তাপমাত্রা দরকার সেটা না পাওয়ার কারণেও গভীর সমুদ্রে ইলিশ চলে যাচ্ছে। আর আমাদের দেশের ফিশিং বোটগুলোয় সে ধরনের যন্ত্রপাতি নেই যে গভীর সমুদ্র থেকে মাছ আহরণ করবে। তাই সাগর মোহনায় যে ডুবোচর তৈরি হচ্ছে তা অপসারণ দরকার।’

নদীতে মাছ বিচরণের ক্ষেত্রে দূষণ সরাসরি প্রভাব ফেলে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। প্রথমত, পানিতে নির্দিষ্ট পরিমাণ পিএইচ লেভেল প্রয়োজন। পিএইচের মাত্রা সাতের নিচে নামলে পানির মান খারাপ হতে থাকে। ওই পানিতে মাছের বসবাসের উপযোগিতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। একইভাবে পানিতে যদি দ্রবণীয় অক্সিজেনর মাত্রা কম থাকে সেখানেও মাছ বসবাস করতে পারে না। বাংলাদেশের নদীতে যে ধরনের দূষণ দেখা যায়, তাতে ইলিশের মতো সামুদ্রিক মাছের জন্য টিকে থাকা কঠিন বলে জানান নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মো. মহিনুজ্জামান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে জাহাজ ভাঙা শিল্পের কারণে নদীতে ভারী ধাতুর পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। একইভাবে জাহাজের তেল, বর্জ্যসহ বিভিন্নভাবে নদী দূষিত হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, ইলিশ মাছ বিচরণের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গা প্রয়োজন হয়। নদীতে বাঁধ, অবকাঠামো নির্মাণের কারণে সে জায়গাগুলো সরু হয়ে এসেছে। কোথাও কোথাও চর জেগেছে। এসব কারণে মিঠা পানিতে ইলিশের প্রজনন যেমন কমেছে, কমেছে ইলিশ আহরণও। নদী দূষণ ও ইলিশ আহরণসহ মাছের আবাস নিয়ে যেভাবে ভাবা দরকার আমরা সেভাবে ভাবছি না।’

চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীর হাতিয়া হয়ে মেঘনা নদী গিয়ে পড়েছে বঙ্গোপসগরে। এর মধ্যে লক্ষ্মীপুরের চারটি উপজেলার ৩৭ কিলোমিটার মেঘনার মোহনা, যাকে ইলিশ প্রজনন ও উৎপাদনের মূল কেন্দ্র ধরা হয়। এখানকার ইলিশের ব্যাপক চাহিদা, যা ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়। তবে কয়েক বছর ধরে ভরা মৌসুমেও মেঘনায় কাঙ্ক্ষিত ইলিশ মিলছে না। জেলেদের জালে যেসব ইলিশ ধরা পড়ে তার ৭০-৮০ শতাংশই সামুদ্রিক।

ইলিশ গবেষক ও বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (নদী কেন্দ্র) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আনিছুর রহমান বলেন, ‘এখন চাঁদপুর অঞ্চলে ইলিশ কম পাওয়াটা স্বাভাবিক। কারণ বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা নদী দূষণ এবং পদ্মা-মেঘনায় চর ও ডুবোচরের কারণে কিছু সমস্যা হচ্ছে। আমরা শুধু নদী থেকে জাল দিয়ে ইলিশ ধরে খাচ্ছি। কিন্তু তাদের চলাচলের পথ সুগমের ব্যবস্থা নিচ্ছি না। আমরা কি ইলিশ চলাচলের পথ ঠিক রাখার জন্য ড্রেজিং করি? কোথাও যদি ফেরি আটকে যায় তাহলে সে অঞ্চলেই শুধু ড্রেজিং করা হয়।’

গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের যেসব নদীতে ইলিশ মাছ বিচরণ করে বিশেষ করে পদ্মা-মেঘনাসহ অন্যান্য নদীতীরে গড়ে উঠেছে শিল্প-কারখানা। এসব কারখানা থেকে অপরিশোধিত তরল বর্জ্য নদীতে ফেলা হয়। খালি চোখে এসব তরল বর্জ্যের কোনো ক্ষতিকারক দিক হয়তো ফুটে ওঠে না। কিন্তু পানির গুণগত মান বদলানোর কারণে প্রভাব পড়ে ইলিশসহ অন্যান্য মাছের প্রজননে।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পদ্মা-মেঘনার পাশাপাশি পশুর কিংবা বড় নদীগুলোয়ও এখন আর আগের মতো ইলিশ মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। শিল্প দূষণের কারণে পানির গুণগত মান বদলে যায়। এর ফলে কোথাও কোথাও ইলিশ আসা বন্ধ করে দিয়েছে। আবার এলেও ডিম না পেড়েই চলে যায়। কোথাও যদি ডিম পাড়েও সেটা ফুটে মাছ হবে সে গুণাগুণ তাতে থাকে না। কখনো কখনো ডিম নষ্ট হয়ে যায়। আবার কখনো মাছের লিঙ্গ ঘনত্বও বদলে যায়। সাধারণত একটি পুং ও স্ত্রী মাছ জন্মানোর নিয়ম। সেখানে দেখা গেছে এ নিয়ম খাটে না। এগুলো সবই দূষণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। নদ-নদীর দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ভবিষ্যতে মিঠা পানিতে ইলিশ পাওয়ার সম্ভাবনা আরো কমতে থাকবে।’

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার পরিবেশের ওপর গুরুত্বারোপ করে সম্প্রতি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততার প্রভাব আছে। সেই সঙ্গে বৃষ্টি হওয়া না-হওয়ার সঙ্গে ইলিশের ডিম ছাড়ার একটা সম্পর্ক আছে। কাজেই জলবায়ু পরিবর্তনে আমরা কী করতে পারি তা গবেষকরা দেখতে পারেন। ইলিশের ব্যবস্থাপনা ঠিকমতো করতে পারলে বিশ্বের কাছে তা পরিচয় করিয়ে দেয়া সম্ভব। তাই ইলিশকে আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরতে হবে।’

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন বরিশাল ও চাঁদপুর প্রতিনিধি)

সূত্র,বণিক বার্তা