বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ইতিহাসের অন্যতম বড় স্ক্যামে রূপ নিয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়েও আমরা শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য জ্ঞানের বিকাশ, দক্ষতা অর্জন, মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক রূপান্তর থেকে বহু দূরে। ব্রিটিশদের ‘কেরানি তৈরির কারখানা’ এখন রূপান্তরিত হয়েছে এক অলিগার্ক কাঠামোর বাণিজ্যিক লুটপাটে, যেখানে নীতিনির্ধারক, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা নিজেদের সন্তানদের বিদেশে পাঠিয়ে সাধারণ জনগণের জন্য দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিণত করেছেন বিভ্রান্তির শিক্ষাব্যবস্থায়। ইংরেজি, বিজ্ঞান ও গণিতের প্রতি অবহেলা, মানসম্পন্ন শিক্ষক ও গবেষণার অভাব এবং কর্মমুখী শিক্ষার ঘাটতির কারণে দক্ষতা অর্জনের সুযোগ না পেয়ে লাখ-লাখ শিক্ষার্থী কেবল সার্টিফিকেটের ফাঁদে আটকে থেকে শিক্ষিত বেকারে পরিণত হচ্ছে। প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জন বেকার (ইকোনোমিস্ট), আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এ হার ৬৬ শতাংশ (বিআইডিএস)। মাধ্যমিক (২.৪২ শতাংশ) ও প্রাথমিক (১.৬৯ শতাংশ) ডিগ্রিধারীদের মধ্যে বেকারত্ব অনেক কম স্পষ্ট করছে যে, বর্তমান উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা চাকরি বাজারের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সিপিডি ও সানেমের মতো গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো ধারাবাহিকভাবে সতর্ক করছে বাংলাদেশ কর্মসংস্থানবিহীন প্রবৃদ্ধি এবং ‘মধ্যম আয়ের ফাঁদ’-এ আটকা পড়েছে। উন্নয়ন-উত্থানের এই তথাকথিত সাফল্য যদি মানুষের কর্ম ও জীবনের মান নিশ্চিত না করে, তবে তা প্রহসন ছাড়া কিছুই নয়। তাই, এখনই সময়, শিক্ষাব্যবস্থার বিভ্রান্তি দূর করে শিক্ষা ও অর্থনীতিকে কর্মসংস্থান ও বাস্তবতার ভিত্তিতে পুনর্গঠন করার।

উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা একটি দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে শিক্ষার্থীরা যখন কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে, তখন তাদের সামনে নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। কিন্তু এটি কেবল একটি আকর্ষণীয় যাত্রা নয়; বরং চ্যালেঞ্জ ও প্রতিকূলতাসম্পন্ন একটি প্রক্রিয়াও বটে। শিক্ষা সবার অধিকার কিন্তু উচ্চশিক্ষা নয়। পৃথিবীর কোনও কল্যাণ রাষ্ট্রও উচ্চশিক্ষা বাধ্যতামূলক করেনি, এমনকি উচ্চশিক্ষার ব্যয় সবার নাগালের মধ্যে রাখেনি। কারণ, যখন কোনো সমাজে উচ্চশিক্ষার হার দ্রুত বাড়তে থাকে, কিন্তু সেই অনুযায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয় না, তখন সমাজে হতাশা, অসন্তোষ, বিভ্রান্তি ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। প্রাচীন দার্শনিক প্লেটোও মনে করতেন, শিক্ষা সবার জন্য নয়, বরং এটি যোগ্য ও মেধাবী শ্রেণির জন্য বরাদ্দ হওয়া উচিত। তার মতে, সমাজে সবার জন্য আলাদা ভূমিকা আছে এবং সবার এক ধরনের শিক্ষা গ্রহণ করাটা প্রয়োজন নয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, উচ্চশিক্ষিত হওয়া মানেই ‘উঁচু মানুষ’ হয়ে যাওয়া নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেননি, তবু তার সাহিত্যকর্ম পড়েন হাজার হাজার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। অর্থাৎ, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও মানুষ সমাজে অসামান্য অবদান রাখতে পারে। উচ্চশিক্ষা এমন একটি স্তর, যেটা যারা সত্যিকারের মেধাবী, আগ্রহী এবং প্রতিশ্রুতিশীল, তাদের জন্য সংরক্ষিত থাকা উচিত। শিক্ষার মান কমিয়ে ও পাসের হার বাড়িয়ে এবং সবার জন্য একসাথে উচ্চশিক্ষার দরজা খুলে দিয়ে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা এখন এক গভীর সংকটে। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার স্টেকহোল্ডারদেরকে সাতকাহন দিয়ে প্রবন্ধের গভীরে প্রবেশ করবো। টপ-ডাউন (নীতিনির্ধারক) পদ্ধতিতে সমাধান করা সহজ হলেও সমস্যার ব্যবচ্ছেদ করতে চাই বটম-আপ (ছাত্র-অভিভাবক ও শিক্ষক-শিক্ষা উপকরণ) পদ্ধতিতে।

ছাত্ররা হচ্ছে একটি জাতির ভবিষ্যৎ এবং শিক্ষাব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু আমাদের শিক্ষার্থীরা যেন এক ভয়াবহ বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছে। তারা কোথায় যাচ্ছে, কী শিখছে এবং কেন শিখছে এই মৌলিক প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর আজ আর স্পষ্ট নয়। সারা বছর নিয়মিত ক্লাসে না গিয়েও লাখো শিক্ষার্থী গণহারে জিপিএ-৫ পাচ্ছে। সৃজনশীল প্রশ্নপত্রের উদ্দীপকের কথামালা ভুল বানানে উত্তরপত্রে উঠিয়ে দিয়েও তারা ফেল করছে না। এই ‘অতিমূল্যায়ন’ প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত এক ভ্রান্ত আত্মবিশ্বাস তৈরি করছে, যার পরিণতি দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায়। দুঃখজনক হলেও সত্য, ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী সেখানে ন্যূনতম পাস নম্বরও অর্জন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। কিন্তু এখানেই গল্প শেষ নয়। এদের বেশিরভাগই পরে নানা জেলা-উপজেলায় অবস্থিত কলেজ বা নামসর্বস্ব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই স্নাতকের শিক্ষার্থী হয়ে যাচ্ছে, কারণ তাদের ‘জিপিএ’ আছে, অথচ বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞান নেই। অভিজ্ঞতার আলোকে উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের অর্থনীতি বিভাগে ২৭০টি আসনের বিপরীতে সর্বোচ্চ ৫০ জন শিক্ষার্থী ইচ্ছা অনুযায়ী ভর্তি হয়। বাকি শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়েই অর্থনীতি বিষয়ের শিক্ষার্থী বনে যাচ্ছে যা তাদের আগ্রহের সঙ্গে সম্পূর্ণ বেমানান। এই শিক্ষার্থীদের অনেকেই হয়ত অন্য কোনো ক্ষেত্রে মেধাবী এবং সেখানেই দক্ষতা বিকাশের সুযোগ পেলে ভবিষ্যতে সফল হতে পারত। কিন্তু আমাদের সমাজে, পরিবারে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে চাপিয়ে দেওয়া এক ‘অদৃশ্য প্রতারণা’ তাদের বাধ্য করছে এমন বিষয়ের ছাত্র হতে যেখানে তাদের নেই আগ্রহ, নেই স্বপ্ন, নেই উচ্চশিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত মেধা ও প্রতিশ্রুতি। ফলে তারা প্রথম থেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করে, তাদের স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি শুধু অর্থ, সময় এবং মানসিক শ্রমের অপচয়। এ থেকেই তৈরি হয় এক গভীর হতাশা, যার ফলস্বরূপ অনেকেই চাকরির অনিশ্চয়তা, আত্মকর্মসংস্থানের অভাব এবং শেষমেশ পারিবারিক চাপ ও সামাজিক অবজ্ঞায় ভেঙে পড়ছে।

অন্যদিকে, অভিভাবকেরাও যেন এক ধরনের দিশাহীনতার শিকার। তাঁরা শুধু সন্তানের আগ্রহ, স্বপ্ন, মেধা কিংবা প্রতিশ্রুতির যথাযথ জায়গাটি চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হচ্ছেন না; বরং তাঁদের অনেকেই সন্তানের ‘অতিমূল্যায়িত জিপিএ’-কে একমাত্র মানদ- ধরেই সমাজের চাপ ও ট্যাবু ভাঙার সাহসটুকুও দেখাতে পারছেন না। ফলে, সন্তান যদি প্রকৃত অর্থে কোনো বিষয়ের প্রতি আগ্রহী না-ও হয়, বা যদি তার মেধা অন্য কোনো নির্দিষ্ট দিকেই বেশি থাকে তবুও তাকে উচ্চশিক্ষার পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। অনেক সময় ‘ইঞ্জিনিয়ার’ বা ‘ডাক্তার’ বানানোর স্বপ্নে সন্তানকে এমন পথ দেখানো হয়, যা তার প্রকৃত ঝোঁক বা সক্ষমতার সঙ্গে সম্পূর্ণ বেমানান। এই ‘সমাজপ্রসূত উচ্চাশা’ পূরণ করতে গিয়ে বহু অভিভাবক তাঁদের কষ্টার্জিত সঞ্চয় ব্যয় করছেন, যেন ‘উচ্চশিক্ষিত সন্তান’ মানেই ভবিষ্যতের সুনিশ্চিত টিকিট। কিন্তু বাস্তবতা বলছে এই সার্টিফিকেটভিত্তিক প্রতিযোগিতার শেষে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেই কোনো কর্মসংস্থান, নেই জীবন দক্ষতা, আর নেই ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা। শুধু অর্থনৈতিক বিনিয়োগের নিশ্চিত লোকসানই নয়, এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে সময় ও মানসিক শ্রমের অপচয়, এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তায় ডুবে থাকা এক পরিবার।

এই স্তরে সমস্যা বহুমাত্রিক। রাজনৈতিক প্রভাব এবং অর্থনৈতিক স্বার্থে যত্রতত্র কলেজ স্থাপন, অনার্স-মাস্টার্সে প্রোগ্রাম চালু এবং মানহীন শিক্ষক নিয়োগের ফলে দেশের অধিকাংশ বেসরকারি কলেজ কার্যত পঙ্গু হয়ে পড়েছে। নিয়োগের ক্ষেত্রে গুণগত মান নয়, বরং ঘনিষ্ঠতা ও আর্থিক সুবিধা প্রাধান্য পেয়েছে। এসব কলেজে নিযুক্ত শিক্ষকরাও দীর্ঘদিন ধরেই চরম আর্থিক, মানসিক এবং সামাজিক অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন পার করছেন। যেসকল শিক্ষকরা এমপিওভুক্ত কলেজে চাকরি করছেন, তারাও ভালো নেই। মাসের পর মাস তাদের মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার আটকে রাখা হয়, যা সরাসরি শিক্ষার মানে বিরূপ প্রভাব ফেলে।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে চিত্র কিছুটা আলাদা হলেও, সংকট আরও গভীর। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে এসএসসি থেকে মাস্টার্সের জিপিএ নয়; বরং, পিএইচডি ডিগ্রি, পোস্টডক, গবেষণা অভিজ্ঞতা ও উচ্চমানের ইমপ্যাক্ট জার্নালে প্রকাশনা একটি মৌলিক শর্ত হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ শিক্ষক নিয়োগে ফ্রেশ পোস্ট গ্র্যাজুয়েটকেই অধিক যোগ্য হিসেবে বিবেচনা অব্যাহত রেখেছে এবং রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, স্বজনপ্রীতি ও আর্থিক লেনদেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের মূল কাজ হলো উচ্চশিক্ষা প্রদান এবং গবেষণা। সাধারণভাবে ধারণা করা হয়, একজন অধ্যাপক যেই বিষয়ে গবেষণা করেন, তিনি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে সেই বিষয়ে পাঠদান করবেন। অথচ, আমাদের অধিকাংশ অধ্যাপক গবেষণায় অনাগ্রহী। এই সংকটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় বাজেটের অভাব, যেটাতে আন্তর্জাতিক পরিম-লে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বনিম্ন। ফলাফল হিসেবে, দেশের জেলায় জেলায় স্থাপিত ৫৫টি পাবলিক ও অলিগলিতে স্থাপিত ১১৫টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় যেন পরিণত হয়েছে একেকটি শিক্ষা কারখানায়। সেখান থেকে বেরিয়ে আসা বেশিরভাগ শিক্ষার্থী কোনো গুণগত মান নয়, বরং একটি ‘সার্টিফিকেট’ নিয়ে বের হয়।

বাংলাদেশে সরকারি কলেজের শিক্ষকদের চিত্র অনেক ক্ষেত্রে আরও শোচনীয় ও হৃদয়বিদারক; এ যেন যোগ্যতা দিয়ে চাকুরিতে প্রবেশ করে বঞ্চনা দিয়ে বিদ্ধ হওয়া। বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার জন্য একজন প্রতিযোগীকে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের অন্যান্য ক্যাডারের মতোই পিএসসির অভিন্ন তীব্র প্রতিযোগিতার কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। প্রায় অর্ধ-মিলিয়ন আবেদনকারীর মধ্য থেকে তুলনামূলক স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় কয়েকশ সর্বোৎকৃষ্ট প্রার্থীকে বেছে নেওয়া হয়, যারা দীর্ঘ সময়, মানসিক শ্রম ও বেশি বেতনের অন্য চাকরি ত্যাগের বিনিময়ে সরকারি কলেজের প্রভাষক হিসেবে পদায়িত হন। অথচ, তাদের সামনে অপেক্ষা করে বেতন-ভাতা, প্রমোশন, বদলি, প্রশিক্ষণ ও প্রশাসনিক সুযোগ-সুবিধায় চরম বৈষম্যের এক করুণ বাস্তবতা। উচ্চশিক্ষায় গবেষণা একটি অপরিহার্য শর্ত। অথচ, সরকারি কলেজগুলোতে গবেষণার জন্য বাজেট কার্যত শূন্য। পদোন্নতিতে গবেষণার কোনো গুরুত্ব না থাকা স্বত্বেও কেউ কেউ ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করছেন, কিন্তু তারপরও শিক্ষা ছুটি শেষে তাদের বেশিরভাগের ভাগ্যে জুটে প্রান্তিক এলাকায় দীর্ঘদিন আটকে থাকার দুর্ভাগ্য। অনার্স-মাস্টার্স কলেজে পাঠদানের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও উচ্চতর ডিগ্রিধারী ও গবেষণায় আগ্রহী শিক্ষককে ইন্টারমিডিয়েট কলেজে পাঠানো হচ্ছে, যেখানে নেই পর্যাপ্ত অবকাঠামো, নেই গবেষণার পরিবেশ এবং নেই উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী ও প্রতিশ্রুতিশীল শিক্ষার্থী। ফলে, অধ্যাপকদের প্রান্তিক উৎপাদন ক্ষমতা অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে, যা শিক্ষার্থী, প্রতিষ্ঠান ও জাতি তিনটিরই ক্ষতি। উপজেলা পর্যায়ের সরকারি কলেজগুলোতে শিক্ষক সংকট চরম পর্যায়ে, অনেক বিভাগে বছরের পর বছর শিক্ষকবিহীন অথবা একজন মাত্র শিক্ষক পুরো বিভাগের ভার বহন করছেন। উপজেলা পর্যায়ের সরকারি কলেজগুলোতে পদায়ন নিতে একদিকে শিক্ষক অনুৎসাহী, অন্যদিকে শিক্ষার্থীও থাকে না ক্লাসে। পাঠদান ও শিক্ষার সামগ্রিক পরিবেশ এই দুই চাপে প্রায় অচল হয়ে পড়েছে।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে শুরু হওয়া অটোপাস, শর্ট সিলেবাস, উচ্চতর গণিত ও বিজ্ঞানে অবহেলা এবং নকলনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা গত দেড় দশকে পৌঁছে গেছে চূড়ান্ত ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। ৮০’র দশকে ‘এসো নিজে করি’ পদ্ধতির নামে ল্যাব ও দক্ষ শিক্ষক ছাড়াই বিজ্ঞানের ভেতরকার প্রাণশক্তি নিঃশেষ করে ৯০’র দশকে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়। এরপর ক্রমান্বয়ে প্রশ্ন ব্যাংক, এমসিকিউ, শিথিল মূল্যায়ন, জিপিএ পদ্ধতি, পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষা, প্রশ্নফাঁস ও নকল, সৃজনশীল প্রশ্নপত্র এবং ভর্তি পরীক্ষায় লটারি শিক্ষাব্যবস্থাকে উপহাসে পরিণত করেছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো পাঠ্যক্রম নিয়ে একের পর এক অপরিকল্পিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অথচ শিক্ষার্থীর প্রয়োজনীয় বাস্তব দক্ষতা, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা ও কর্মসংস্থানের যোগ্যতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেই। এরই ফল, শিক্ষিত বেকার, উপযুক্ততা-বিচ্যুতি ও সামাজিক হতাশা।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক (অর্থনীতি), শহীদ বুদ্ধিজীবী সরকারি কলেজ, রাজশাহী।

সূত্র, ইনকিলাব