প্রকৌশল শিক্ষা এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লব (4IR) দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। এ বিপ্লব এমন একটি আন্তঃসংযুক্ত বিশ্ব তৈরি করছে, যা আমাদের চিন্তা, কাজ ও শেখার ধরন আমূল পরিবর্তন করে দিচ্ছে। এখন সময় এসেছে বোঝার কীভাবে 4IR প্রকৌশল শিক্ষাকে পুনঃসংজ্ঞায়িত করছে এবং কেন সমাজ প্রকৌশলীদের কাছ থেকে এক নতুন ধরনের প্রত্যাশা করছে।
ইতিহাসে এই প্রথম, একটি শিল্প বিপ্লব একযোগে ডিজিটাল, ফিজিক্যাল ও জৈবিক ব্যবস্থাগুলোর সমন্বয় ঘটাচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি), রোবোটিকস, ক্লাউড কম্পিউটিং ও ডেটা অ্যানালিটিকসের মতো প্রযুক্তি এখন শিল্প ও অর্থনীতির চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। ফলে যেসব কাজ আগে কেবল মানুষের বিচারবুদ্ধির ওপর নির্ভর করত, তা আজ মেশিননির্ভর হয়ে পড়েছে। এ রূপান্তর প্রচলিত চাকরি বিলুপ্তির পাশাপাশি ভবিষ্যতের কর্মসংস্থানের ধরনকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। এ বাস্তবতায় প্রযুক্তিগত জ্ঞান,
উদ্যোক্তা মনোভাব, বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি ও উদ্ভাবনী সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এখন প্রচলিত চাকরির চেয়েও বেশি মূল্যবান হয়ে উঠেছে।
প্রকৌশলের প্রচলিত সংজ্ঞা—প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, গণিত ও গ্রাহকের চাহিদার সমন্বয়ে মানবকল্যাণে উপযোগী ব্যবস্থা তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণ—এখনো প্রাসঙ্গিক। তবে 4IR-এর প্রেক্ষাপটে এ সংজ্ঞাকে সম্প্রসারণ করা জরুরি। আধুনিক প্রকৌশলকে এখন বিবেচনা করতে হবে এমন একটি শাস্ত্র হিসেবে, যেখানে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, গণিত, কম্পিউটেশনাল বুদ্ধিমত্তা ও আন্তঃবিষয়ক জ্ঞান একত্রে প্রয়োগ করা হয় বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন পণ্য, সেবা ও ব্যবস্থা উদ্ভাবনের জন্য—একটি স্বয়ংক্রিয় ও সংযুক্ত বিশ্বে মানবিক প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে।
আজকের প্রকৌশল অনুশীলনকে অনুধাবন করতে হলে নতুন ধারণায় ভাবতে হবে। বিজ্ঞানের মৌলিক গবেষণা ও প্রকৌশল প্রয়োগের মধ্যকার অরৈখিক সম্পর্ক, প্রযুক্তির আন্তঃবিষয়ক চরিত্র এবং সাইবারভিত্তিক অবকাঠামোর প্রভাব প্রকৌশল শিক্ষাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। তাই প্রয়োজন এমন আকৃতির পেশাজীবী, যাদের নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে গভীর দক্ষতা (T-এর উল্লম্ব অংশ) এবং একই সঙ্গে বিস্তৃত আন্তঃবিষয়ক জ্ঞান (T-এর আনুভূমিক অংশ) রয়েছে, যা তাদের একাধিক খাতে কাজের যোগ্য করে তোলে।
বিশ্বব্যাপী প্রকৌশল শিক্ষায় মূলত তিনটি প্রভাবশালী মডেল লক্ষ করা যায়—আমেরিকান, ব্রিটিশ ও অস্ট্রেলিয়ান। এর মধ্যে আমেরিকান মডেলটি বহুমাত্রিকতা ও বিষয়বৈচিত্র্যের জন্য পরিচিত। সাধারণত একটি প্রকৌশল ডিগ্রিতে ১২৮-১৩৫ ক্রেডিট ঘণ্টা থাকে, যেখানে গণিত ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান, ব্যবসা ও যোগাযোগসহ প্রকৌশলসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শাখা অন্তর্ভুক্ত থাকে। এ মডেল শিক্ষার্থীদের একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও আন্তঃবিষয়ক জ্ঞানচর্চার সুযোগ করে দেয়। অন্যদিকে ব্রিটিশ ও অস্ট্রেলিয়ান মডেল তুলনামূলকভাবে অধিকতর বিশেষজ্ঞতানির্ভর। এসব মডেলে পাঠ্যক্রম প্রধানত প্রকৌশল ও প্রযুক্তিনির্ভর বিষয়ের গভীরে মনোনিবেশ করে, যা শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করে।
আমাদের প্রকৌশল শিক্ষায় এখনো আন্তঃবিষয়ক কোর্স ও অভিযোজিত দক্ষতা—যেমন ক্রিটিক্যাল থিংকিং, প্রবলেম সলভিং, সৃজনশীলতা, প্রযুক্তিগত অভিযোজনযোগ্যতা, ডিজিটাল সাক্ষরতা, ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স ও লাইফলং লার্নিং—যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। অথচ 4IR বাস্তবতায় এগুলো অপরিহার্য।
বিশ্বে প্রচলিত শিক্ষা মডেলগুলোর প্রতিটির নিজস্ব মাননিয়ন্ত্রণ কাঠামো রয়েছে, যা বিভিন্ন দিক থেকে পার্থক্যপূর্ণ। তবে বিশ্বায়নের এ যুগে এসব কাঠামোকে একটি সর্বজনীন মাননিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার আওতায় আনার লক্ষ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো ওয়াশিংটন অ্যাকর্ড, যা ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর মধ্যে প্রকৌশল ডিগ্রির পারস্পরিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করে এবং নির্দিষ্ট গুণগত মান বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়।
বাংলাদেশেও প্রকৌশল শিক্ষাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ারস, বাংলাদেশের (আইইবি) অধীনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বোর্ড অব অ্যাক্রেডিটেশন ফর ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনিক্যাল এডুকেশন (BAETE)। এটি বর্তমানে ওয়াশিংটন অ্যাকর্ডের স্বাক্ষরকারী সদস্য এবং বাংলাদেশের প্রকৌশল শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। BAETE-এর মানদণ্ডে রয়েছে আধুনিক শিক্ষাপদ্ধতি, শিক্ষার্থীর সক্রিয় অংশগ্রহণ ও শিল্প খাতের প্রয়োজন অনুযায়ী পাঠক্রম উন্নয়ন।
ওয়াশিংটন অ্যাকর্ডের গুরুত্বপূর্ণ একটি শর্ত হলো আউটকাম বেজড এডুকেশন (ওবিই)। এটি একটি আধুনিক, শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক ব্যবস্থা, যেখানে পাঠ্যক্রম পূর্বনির্ধারিত প্রোগ্রাম আউটকামস (POs) অনুযায়ী প্রণয়ন করা হয় এবং প্রতিটি কোর্সের জন্য নির্ধারিত থাকে পরিমাপযোগ্য কোর্স আউটকামস (COs)। শিক্ষার্থীর শেখা মূল্যায়ন করা হয় কুইজ, অ্যাসাইনমেন্ট, প্রকল্প, এবং ফরম্যাটিভ ও সামেটিভ অ্যাসেসমেন্টের মাধ্যমে। ফরম্যাটিভ অ্যাসেসমেন্টকে এখানে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়, কারণ এটি শিক্ষার্থীর শেখার অগ্রগতি প্রতিনিয়ত মূল্যায়ন করে।
OBE বাস্তবায়নে ব্যবহৃত হয় ফ্লিপড ক্লাসরুম, প্রজেক্ট ও প্রবলেম বেজড লার্নিং, এক্সপেরিয়েন্সিয়াল লার্নিং ও কেস স্টাডির মতো পদ্ধতি। এগুলোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবনী চিন্তা, দলগত কাজ এবং বাস্তব সমস্যার সমাধানদক্ষতা বাড়ে। এর সঙ্গে যুক্ত থাকে কন্টিনিউয়াস কোয়ালিটি ইমপ্রুভমেন্ট (সিকিউআই) প্রক্রিয়া—যেখানে রুব্রিকস, আত্মমূল্যায়ন, সহপাঠী পর্যালোচনা এবং শিল্প-প্রয়োগযোগ্য বাস্তব সমস্যা অন্তর্ভুক্ত থাকে। সিকিউআই কেবল একটি পরিমাপক নয়; এটি একটি ধারাবাহিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া, যা পাঠ্যক্রমকে প্রাসঙ্গিক ও সময়োপযোগী রাখে।
আমরা এমন এক যুগে বাস করছি, যেখানে জ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের গতি আমাদের শিল্প, অর্থনীতি ও জীবনধারা প্রতিনিয়ত রূপান্তর করছে। অতীতে অর্থনীতি শ্রম ও মূলধনের ওপর নির্ভরশীল ছিল। আজকের অর্থনীতি জ্ঞান, উদ্ভাবন ও প্রয়োগযোগ্য দক্ষতার ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
তাই বাংলাদেশে প্রকৌশল শিক্ষার পাঠ্যক্রম ও শিক্ষানীতিতে সময়োপযোগী রূপান্তর জরুরি—শুধু আন্তর্জাতিক মানে উত্তরণের জন্য নয়, বরং একটি টেকসই ও জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি গঠনের লক্ষ্যে। ওবিই ও সিকিউআই-এর কার্যকর বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষার্থীদের এমনভাবে প্রস্তুত করতে হবে, যাতে তারা ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা ও জটিল চ্যালেঞ্জ দক্ষতার সঙ্গে মোকাবেলা করতে পারে।
এখনই সময়—আমরা প্রথাগত কাঠামোর গণ্ডি ছাড়িয়ে ভবিষ্যৎমুখী, অভিযোজিত ও মানবিক প্রকৌশল শিক্ষার পথ খুঁজি।
এমএম শহিদুল হাসান: ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ও প্রফেসর (অব.) বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়