নির্বাচন কমিশন আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ বা পথনকশা ঘোষণা করেছে। বৃহস্পতিবার ইসি সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ জানিয়েছেন, ‘নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী সংসদ নির্বাচন হবে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে এবং তফসিল ঘোষণা হবে ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে।’
নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে সংসদ নির্বাচন আয়োজনের এটি আরেক ধাপ অগ্রগতি। অনেক দিন ধরেই বিভিন্ন মহল থেকে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানানো হয়েছিল। আমরা ইসির এ ঘোষণাকে স্বাগত জানাই। এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নির্বাচনের পথে যাত্রা শুরু করল।
নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে নির্বাচন কমিশনকে তফসিলের আগেও অনেকগুলো কাজ করতে হয়। রোডম্যাপে সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ, ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করা, রাজনৈতিক দল নিবন্ধন ও দেশীয় পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন চূড়ান্ত করাসহ ২৪টি কার্যকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। ইসির রোডম্যাপ অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে অংশীজনের সঙ্গে সংলাপ করবে ইসি। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সুশীল সমাজ, নারী প্রতিনিধি, পর্যবেক্ষক, গণমাধ্যমকর্মীরা এই সংলাপে অংশ নেবেন।
রোডম্যাপে বলা হয়, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২, সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা-২০২৫, নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা (সংশোধন), নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন-১৯৯১ এবং নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন, ২০০৯—এই পাঁচ আইনের কাজ ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে শেষ করা হবে।
নির্বাচন কমিশন প্রবাসী ভোটাররা যাতে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন, সে জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে। এটাও ইতিবাচক বলে মনে করি। তবে তাদের উচিত হবে সেপ্টেম্বরের মধ্যে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও সীমানা নির্ধারণের কাজটি শেষ করা। জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) অনেক নতুন দল নিবন্ধনের আবেদন করে প্রাথমিক যাচাইয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। এ কাজ সেপ্টেম্বরের মধ্যে চূড়ান্ত করা প্রয়োজন বলে মনে করি।
অতীতের তিনটি নির্বাচনে জনগণের রায়ের প্রতিফলন ঘটেনি। এগুলোর কোনোটি বিনা ভোটের নির্বাচন ছিল, কোনোটিতে দিনের ভোট রাতে হওয়ার গুরুতর অভিযোগ আছে। এ অবস্থায় একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন করা কমিশনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। আর সেই চ্যালেঞ্জ তারা তখনই করতে পারবে, যখন প্রশাসন, সশস্ত্র বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সার্বিক সমর্থন ও সহযোগিতা পাবে।
আগের তিনটি নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে হওয়ায় কমিশনের প্রতি ক্ষমতাসীনদের চাপ ছিল। বর্তমানে নির্দলীয় ও অন্তর্বর্তী সরকারের অধীন নির্বাচন হওয়ায় সে ধরনের চাপের আশঙ্কা কম। কিন্তু নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর চাপ থাকবে, যার আলামত এখনই পাওয়া যাচ্ছে। ইসির কোনো সিদ্ধান্ত পছন্দ না হলে তাকে প্রতিপক্ষের দোসর হিসেবে চিহ্নিত করা রাজনৈতিক দলগুলোর অসহিষ্ণু মনোভাবেরই প্রকাশ বলে মনে করি।
এ ছাড়া জুলাই সনদের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো এখনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দফায় দফায় বৈঠক করেও সমঝোতায় আসতে পারেনি। আমরা মনে করি, নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার পর রাজনৈতিক দলগুলোর মনস্তাত্ত্বিক চাপও বাড়ল। নেতারা জুলাই সনদের দাঁড়ি–কমা নিয়ে যতই বাহাস করুন না কেন, জনগণ ভোটের জন্য উন্মুখ। সমঝোতার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাই মুখ্য।
নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি সরকারের জন্য সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের। নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরিতে রাজনৈতিক দলগুলোরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।