উন্নয়নশীল দেশসমূহে জাতীয় ঐক্যের অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। যদিও এই সকল দেশে মাঝেমধ্যে জাতীয় ঐক্যের কথা যে উচ্চারিত হয় না, তাহা নহে। তবে, তাহা অন্তরে কতটা বিশ্বাস করা হয়, তাহা লইয়া প্রশ্ন থাকিয়া যায়। প্রায়শ দেখা যায়, স্বাধীনতা অর্জনের সময় এই দেশসমূহ ঐক্যবদ্ধ হইয়া বিদেশি শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিয়াছে। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পর তাহারাই আবার অনৈক্য ও হানাহানিতে লিপ্ত হয়। এই বিভেদের সুযোগ গ্রহণ করে দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীরা, যাহারা রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা নষ্ট করিতে বদ্ধপরিকর।

এই সকল দেশে স্বাধীনতা লাভের পর জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখিবার পরিবর্তে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষের শক্তির কথা বলিয়া প্রথমেই বিভাজনের রেখা টানিয়া দেওয়া হয়। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় দেশের অভ্যন্তরে যাহারা অন্যায়-অপকর্ম করিয়াছিল; হত্যা, লুটতরাজ, রাহাজানি ইত্যাদির আশ্রয় নিয়াছিল, তাহাদের প্রচলিত আইনে শাস্তির ব্যবস্থা করিয়া বিরোধ-বিসংবাদের বিষয়টি সেইখানেই ইতি টানা যাইত। কিন্তু তাহা না করায় যুগ যুগ ধরিয়া বিরাজ করে আনফিনিশড রেভ্যুলেশন বা অসমাপ্ত বিপ্লবের মতো পরিস্থিতি। এই সকল দেশে গণআন্দোলন বা গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে যতবার রাজনৈতিক পরিবর্তন আসিয়াছে, ততবারই জাতীয় ঐক্য গঠনের সুযোগ তৈরি হইয়াছে। কিন্তু জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করিতে এই সকল দেশের রাজনীতিবিদগণ উদারতা, বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে পারেন নাই। ফলে কিছুদিন না যাইতেই এই সকল দেশে আবার অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এই অরাজকতা সামলাইতে গিয়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই সকল দেশকে একদলীয় শাসনব্যবস্থা বা স্বৈরতন্ত্রের প্রতি ঝুঁকিয়া পড়িতে দেখা যায় এবং তখন আবার আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এইভাবে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলার পুনরাবৃত্তি চলিতেই থাকে। অনেক সময় প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়াই জাতীয় ঐক্যের সুর তোলা হয়, যাহা কখনোই প্রকৃত শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনিতে পারে না। বরং ইহা হিংসা-বিদ্বেষ ও বিভেদ-গৃহবিবাদকে আরো উসকাইয়া দেয়। ইহাতে উন্নয়নশীল দেশসমূহে উদার গণতন্ত্রের বিকাশ বারংবার বাধাগ্রস্ত হয়। নাগরিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের স্বপ্ন অধরাই থাকিয়া যায়।

প্রকৃতপক্ষে এই সকল দেশে পারস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বাস, হিংসা-প্রতিহিংসা, অসুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চা ইত্যাদি কারণে বিরুদ্ধ মত-পথ ও আদর্শে বিশ্বাসীদের প্রতি অত্যাচার-নির্যাতন বৃদ্ধি পায়। বৃদ্ধি পায় জ্বালাও-পোড়াও, মামলা-হামলা, গুম-খুন, গ্রেফতার, নিষিদ্ধকরণ, নির্মূলকরণ ইত্যাদি প্রবণতা। এই ধরনের উদ্যোগ উদার গণতন্ত্রের পরিচায়ক নহে, বরং উগ্রপন্থার লক্ষণ। উদার গণতন্ত্রে ভিন্ন মতকে সর্বদা শ্রদ্ধার সহিত দেখা হয় এবং বিতর্কের মাধ্যমে সমাধানের পথ খোঁজা হয়। কিন্তু যখন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার চেষ্টা চলে, তখন সমাজে কেবল অস্থিরতা ও অবিশ্বাসই বৃদ্ধি পায়।

যদি এই সকল দেশে যে কোনো বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর জাতীয় ঐক্যের প্রতি গুরুত্ব না দেওয়া হয়, তাহা হইলে অস্থিরতা, উত্তেজনা ও বিশৃঙ্খলা লাগিয়াই থাকিবে। আর একটি জাতি ততক্ষণ পর্যন্ত উন্নতি লাভ করিতে পারে না, যতক্ষণ না তাহার জনগণ ঐক্যবদ্ধ থাকে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের মধ্যে চিন্তা ও মতাদর্শগত পার্থক্য থাকাটা অস্বাভাবিক নহে। কিন্তু ইহার পরও কতিপয় জাতীয় ইস্যুতে সকলের এক থাকা প্রয়োজন। প্রয়োজন পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সৌজন্যবোধের অনুশীলন। বিশেষ করিয়া ব্যক্তি, দলীয় বা গোষ্ঠীগত স্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়া জনগণের সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। এই জন্য জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করিয়া জনগণের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক জোরদারের কোনো বিকল্প নাই। বলা বাহুল্য, জাতীয় ঐক্য কেবল একটি দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি ও স্থিতিশীলতাই নিশ্চিত করে না, বরং ইহা অর্থনৈতিক উন্নতি এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের অবস্থান সুদৃঢ় করিতেও সহায়ক হয়। সুতরাং, উন্নয়নশীল দেশসমূহের অগ্রগতির জন্য জাতীয় ঐক্য গঠন ও বজায় রাখা অত্যাবশ্যক এবং এই জন্য এই সকল দেশে দরকার একজন প্রকৃত স্টেটসম্যান বা রাষ্ট্রনায়কও।