"ধর্মীয় রাজনীতি" বলতে বোঝায় যেখানে রাজনীতির কাঠামো, আইন-কানুন, শাসনব্যবস্থা সবকিছু নির্ধারিত হয় ধর্মীয় বিধান অনুসারে। যেখানে একটি নির্দিষ্ট ধর্মের অনুসারীরা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল গঠন করে, তাদের রাজনীতির দর্শন হলো ধর্ম। ধর্মীয় ভিত্তি মানুষকে অনুসরন করায়। কারণ রাজনীতিবীদরে মধ্যে যখন ধর্মীয় মুল্যেবোধ থাকবে তখন সে আর রাষ্ট্রের সম্পদকে ব্যক্তিগত সম্পদ মনে করবে না, ঘুষ নিবে না, চাকরি বাণিজ্য করবে না , সম্পদের অপব্যবহার করবে না, দূর্নীতি করবে না।
আমাদের দেশে নির্বাচন আসলেই রাজনৈতিক দলগুলো ধর্ম নিয়ে রাজনীতি শুরু করে। যে দলগুলো সারা বছর রাজনীতিতে ধর্ম নিষিদ্ধ চান এবং এ কথা বলতে বলতে যারা চৈত্রের রোদে জমিন ফাটানোর মতো যাদের গলা ফাটিয়ে ফেলেন তারাই যেকোন সভা সমাবেশে এ কথা বলা রুটিন বানিয়ে ফেলেন। তারাই প্রথমে শুরু করেন এই কারুকাজ।
এখানে ধর্মকে সরাসরি রাষ্ট্রদর্শন হিসেবে ব্যবহার না করে, বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ ভোট, জনপ্রিয়তা বা ক্ষমতা অর্জনের জন্য নেতারা ধর্মীয় আবেগ, প্রতীক, অনুষ্ঠান, বিভাজন ইত্যাদি কাজে লাগান।
"ধর্ম নিয়ে রাজনীতি" বলতে বোঝায় রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বা ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কাজে লাগানো, যা ধর্মীয় অনুশাসনকে লঙ্ঘন করে বা ধর্মীয় মূল্যবোধের অপব্যবহার করে।
আমার বয়স তখন ১০-১২ বছর তখন দেখতাম যখন নির্বাচন আসলে এলাকার চেয়ারম্যান মেম্বার প্রার্থীরা পাতলা ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি পড়তো, মাথায় টুপি দিত, আযান হওয়ার সাথে সাথে সবার আগে মসজিদে গিয়ে সামনের কাতারে বসত। নিজের বাক্স ভোট আনার জন্য সাবার সাথে মোলায়েম আচরণ করতো। ছোটদের স্নেহ করতো। রাস্তা ঘাটে জনগণকে আগে বাগে সালাম দিত।
ঠিক নির্বাচন শেষ হওয়ার সপ্তাহ খানেক পরই তাদের খোলস পাল্টে যায়। এখন আর তারা মসজিদে যায় না, আগে যাদের দেখলে সালাম কালাম দিত এখন তাদের দেখলেও না দেখার বান করে। নামাজের সময় হলে চায়ের বসে দোকানে অন্যদের নিজের সফলতার গল্প শোনায়। সে আগে যাদের ধারে ধারে ঘুরে বেঁড়াত, সেই লোকদের এখন তার সাথে দেখা করতে সিডিউল লাগে।
আওয়ামী লীগ ও ধর্ম:
আওয়ামী লীগ মুলত একটি ভারতের পা চাটা দল। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা বাম সহ হিন্দু এবং ভরতকে খুশি রাখার জন্য সংবিধান থেকে ইসলাম বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা যুক্ত করে। এর মাধ্যমে মুসলিম ছাড়া সকল বিরোধী ধর্মালম্বীদের আবেগকে ব্যবহার করে তাদের ভোট টানেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্ম এক অনিবার্য বাস্তবতা। আওয়ামী লীগ জন্মলগ্ন থেকেই নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারক-বাহক হিসেবে তুলে ধরলেও, বাস্তব রাজনীতিতে বিভিন্ন সময়ে ধর্মকে ব্যবহার করেছে। এই ব্যবহারের ধারা বুঝতে হলে ইতিহাসের দিকে তাকানো জরুরি। তবে দলটি কখনো ধর্মকে সরাসরি অস্বীকার করেনি; বরং ধর্মীয় অনুভূতির ফায়দা নিয়ে রাজনীতি চালিয়েছে।
১৯৭১-৭৫ সালে স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে যুক্ত হয়। মসজিদ, মন্দির, গির্জা ও প্যাগোডায় সমান মর্যাদার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। এটাই ছিল আওয়ামী লীগের এক স্পষ্ট সব ধর্মকে ব্যবহার করার রাজনৈতিক কৌশল।
জিয়াউর রহমান সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেন এবং ইসলামকে গুরুত্ব দেন। পরবর্তীতে এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন। এই সময়ে আওয়ামী লীগ আবারো ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে দাঁড়ালেও নির্বাচনী রাজনীতিতে টিকে থাকতে ধর্মীয় পরিচয়কেও ব্যবহার করে।
১৯৯০-এর দশকে ভোটের রাজনীতিতে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর বিএনপি-জামায়াত জোটের মোকাবিলায় আওয়ামী লীগ একদিকে ধর্মনিরপেক্ষতার দাবি তোলে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষকে বোঝাতে চায় যে আওয়ামী লীগ মুসলমানদের দল, ধর্মবিরোধী নয়। শেখ হাসিনার জনসভায় ধর্মগ্রন্থ উদ্ধৃতি, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ সেই কৌশলেরই বহিঃপ্রকাশ।
২০০৮ সালের নির্বাচনে জয় লাভের পর আওয়ামী লীগ আবার সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ফিরিয়ে আনে, তবে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রাখে। এর ফলে দলটি একসঙ্গে দুটি বার্তা দেয়—১. সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা দিয়ে প্রগতিশীল শক্তিকে আশ্বস্ত করা। ২. রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রেখে বৃহৎ মুসলিম জনসংখ্যাকে সন্তুষ্ট রাখা।
এ সময় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম বাড়িয়ে হজ ব্যবস্থাপনায় ভর্তুকি দিলেও ফ্যসিস্ট হাসিনার আমলা কামলারা
দূর্নীতিতে মত্ত হয়ে উঠে। প্রকৃত অর্থে ভর্তুকির টাকা তাদের পকেটে যায়। মাদ্রাসা শিক্ষায় সহায়তা করলেও বেসিক বিষয় গুলোকে পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দেওয়া হয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইসলামি সম্মেলনের আয়োজন ও অংশগ্রহণ—সবই আওয়ামী লীগের কৌশলগত ধর্ম ব্যবহারকে প্রমাণ করে।
আজকের আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষতার কথাই বেশি উচ্চারণ করে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় আচরণে ইসলামকে বিশেষ মর্যাদা দেয় মুখে। বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনাকে ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসেবে উপস্থাপন করা থেকে শুরু করে পবিত্র রমজান, ঈদ ও হজ কেন্দ্রিক ভর্তুকি—সবকিছুই ধর্ম ব্যবহারের অংশ।
আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার এক ধরনের দ্বৈততা তৈরি করেছে। দলটি মুলত ধর্মনিরপেক্ষতা ধারণ করে, আর বাস্তবে ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতির মাঠে টিকে থাকার হাতিয়ার হিসেবে। একদিকে প্রগতিশীল ভোটব্যাংক, অন্যদিকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আবেগ—এই দুই মেরুকেই একসঙ্গে সামলাতে গিয়ে আওয়ামী লীগ আজ এক জটিল দ্বন্দ্বে অবস্থান করছে।
সিলেটে শেখ হাসিনার ধর্ম ব্যবহারের কৌশল
এখন আবার ২০-২৫ বয়সে এসে দেখলাম আওয়ামী লীগের ধর্ম নিয়ে রমরমা ব্যবসা। ফ্যাসিস্ট শেখ ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদের ঢামি নির্বাচনের প্রচার শুরু করেন সিলেট হযরত শাহা জালাল-হযরত শাহ পরান (রা) এর মাজার জিয়ারতের মাধ্যমে।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারণা শুরু হলো সিলেটে হযরত শাহজালাল (র.) ও শাহ পরান (র.)-এর মাজার জিয়ারতের মধ্য দিয়ে। এটা নিছক কোন আধ্যাত্মিকতার প্রয়াস বরং ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফয়দা নেওয়ার স্পষ্ট বার্তা।
বিএনপি-জামায়াত সহ অন্যান ধর্মীয় দলগুলো দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগকে ধর্মবিরোধী বলে আখ্যা দিত। সেই প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনা মাজার জিয়ারতের মাধ্যমে প্রমাণ করতে চাইলেন— আওয়ামী লীগ ইসলাম ও আউলিয়াদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। একইসঙ্গে তিনি সিলেট অঞ্চলের ধর্মপ্রাণ জনগণের আবেগকে ছুঁয়ে তাদের আস্থা অর্জনের কৌশল নিয়েছেন।
এই পদক্ষেপ দেখায়, বাংলাদেশে ধর্ম কেবল আধ্যাত্মিক চর্চার বিষয় নয়, বরং রাজনৈতিক টিকে থাকার হাতিয়ারও বটে। শেখ হাসিনার সিলেট সফর সেই বাস্তবতারই প্রতিচ্ছবি।
লেখক:
সাংবাদিক