পুরানো ঢাকার মিটফোর্ড এলাকায় লালচাঁদ ওরফে সোহাগ নামের এক ভাঙারী ব্যবসায়ীকে প্রকাশ্যে দিবালোকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। ব্যবসায়িক বিরোধের জেরে ঘাতকচক্র তাকে পিটিয়ে এবং ইট-পাথরের টুকরো দিয়ে আঘাত করে এক পর্যায়ে তাকে বিবস্ত্র করে তার দেহের ওপর নৃত্য করার মতো পৈশাচিকতা প্রদর্শন করেছে। এই লোমহর্ষক হত্যাকা-ের ঘটনায় দেশব্যাপী ক্ষোভ ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। ঘটনাচক্র এই হত্যাকা-ের সঙ্গে বিএনপির অঙ্গ সংগঠনের স্থানীয় নেতাকর্মীদের নাম উঠে এসেছে, যা দলের জন্য বিব্রতকর। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতিতে এই হত্যাকা-ের তীব্র নিন্দা জানিয়ে দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন, এটি শুধু একটি প্রাণনাশের ঘটনা নয়, বরং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, নাগরিক অধিকার এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির একটি ভয়াবহ দৃষ্টান্ত। এই ধরনের ঘটনা একটি সভ্য রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি আরও গভীর করছে। তিনি আরও বলেছেন, আমাদের রাজনৈতিক আদর্শ ও নীতির সঙ্গে সন্ত্রাস ও সহিংসতার কোনো সম্পর্ক নেই। অপরাধী যেই হোক, সে কখনোই আইনের ঊর্ধ্বে হতে পারে না। বলা বাহুল্য, দলীয় মহাসচিবের এই বিবৃতিতে হত্যাকা-ের ব্যাপারে বিএনপির অবস্থান অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে প্রতিলিত হলেও কয়েকটি রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন মহল থেকে বিএনপির বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় বিষোদ্গার ও সমালোচনা করা হচ্ছে। প্রতিবাদ সমাবেশ ও মিছিল করা হচ্ছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, বিএনপিবিরোধী সমালোচনা ও কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল ও মহল রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের অপচেষ্টা করছে। বিএনপি যাতে আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে না পারে, সে জন্য দেশি-বিদেশি একটা ষড়যন্ত্র শুরু থেকেই চলছে। বিভিন্ন ঘটনার সূত্র ধরে এই ষড়যন্ত্রের পালে হাওয়া লাগানোর অপতৎপরতা অব্যাহত আছে। সোহাগ হত্যাকা-কেও কাজে লাগানো হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে যুবদলের সভাপতি মোনায়েম মুন্নার একটি বক্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে। তার আগে এটাও উল্লেখ করা দরকার, সোহাগ হত্যাকা-ের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে যুবদলের পাঁচজনকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়েছে। মোনায়েম মুন্না অভিযোগ করেছেন, ‘পুলিশ যাদের বিরুদ্ধে ভিডিও ফুটেজে স্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছে, তাদের গ্রেফতার করা হয়নি।’ তিনি উদ্দেশ্যমূলকভাবে মূল আসামীদের আড়াল করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলে প্রশ্ন করেছেন, ‘৯ জুলাইয়ের ঘটনা হঠাৎ করে ১১ জুলাই ব্যাপক প্রচার পেল কেন? আগে কেন প্রচার পায়নি? এখানে কোনো উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে।

যুবদল সভাপতির এই অভিযোগ ও প্রশ্ন থেকে ভিন্ন কিছু মনে হয়, যা স্পষ্ট হওয়া জরুরি। প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও মূল আসামীদের না ধরার কারণ কী, সঙ্গতকারণেই এ প্রশ্ন উঠবে। একদিকে প্রকৃত আসামীদের এড়িয়ে যাওয়া, অন্যদিকে ঘরে-বাইরে, মাঠে-ময়দানে বিএনপিকে হেয় প্রতিপন্ন করা একটি বিশেষ মতলবকে সামনে রেখেই যে হচ্ছে, তাতে সন্দেহ আছে কি? বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও সোহাগ হত্যাকা-ের ঘটনায় খুনিকে গ্রেফতার কেন করা হচ্ছে না সে প্রশ্ন তুলেছেন। বলেছেন, কিছু কিছু দল পুরানো ঢাকার ঘটনাটিকে ভ্রান্তভাবে উপস্থাপন করছে। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, যে খুন করছে বা হত্যা করছে, অন্য জায়গা থেকে তাকে আনা হয়েছে। তাকে ধরা হচ্ছে না। ধরা হলো অন্যদেরকে। তাঁকে আসামী পর্যন্ত করা হয়নি বোধহয় এখন পর্যন্ত। কেনো হয়নি? কেনো ধরা হচ্ছে না? আমাদের পক্ষ থেকে তো একবারও বলা হয়নি অমুককে ধরা যাবে না, তমুককে ধরা যাবে না। আমরা বরাবরই বলেছি, অন্যায়কারীর আইন অনুযায়ী বিচার হবে। দলের সাথে তার কী সম্পর্ক, কিছু যায় আসে না তাতে। তাকে দল থেকে কোনো রকম প্রশ্রয় দেবে না কেউ। উল্লেখ করা যেতে পারে, দলীয় পদ ও পরিচয় যাই হোক সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, কমিশনবাজি ইত্যাদি অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হলে বা যুক্ত হওয়ার প্রমাণ মিললে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তারেক রহমান কখনো পিছপা হন না। দলীয় শৃংখলা ভঙ্গ বা অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে এ পর্যন্ত সাড়ে চার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত দ্ব্যার্থহীন ও কঠোর। অথচ তার বিরুদ্ধে দল ও মহল বিশেষ নাম ধরে কুৎসা রটাতে ও সমালোচনা করতে দ্বিধা করছে না। বিষয়টি যে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রেরই অংশ, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। তারেক রহমান তার ও বিএনপির বিরুদ্ধে এবং দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কথা বিভিন্ন সময়ে উল্লেখ করেছেন। গত শনিবার ছাত্রদল আয়োজিত অনুষ্ঠানেও তিনি এ প্রসঙ্গ টেনেছেন। বলেছেন, দেশে ষড়যন্ত্র শেষ হয়নি, আরো জোরেশোরে শুরু হয়েছে। এ ব্যাপারে সতর্ক থাকার আহবান জানিয়ে বলেছেন, কারা কীভাবে ষড়যন্ত্র করছে, কারা কীভাবে বিভিন্ন কথা বলছে এবং ক্ষণে ক্ষণে অবস্থান পরিবর্তন করছে এসব বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। চোখ-কান খোলা রাখতে হবে।

বিভিন্নভাবে মব সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর পেছনে সরকারের কোনো প্রশ্রয় আছে কি না, এমন প্রশ্ন তুলেছেন তারেক রহমান। দেশজুড়ে সাম্প্রতিককালে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির প্রেক্ষাপটে এটি একটি সঙ্গত প্রশ্ন। সোহাগ হত্যাকা-, মুরাদনগরে ট্রিপল মার্ডার, লালমানিরহাটে থানা ঘেরাও ইত্যাদি ছাড়াও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাঁদার দাবিতে গুলি, ছিনতাই, রাহাজানি আইনশৃঙ্খলার শোচনীয় অবনতির প্রমাণ বহন করে। যারা দ্রুত নির্বাচন চায় না, তারা আইনশৃঙ্খলার অবনতিকে তাদের অবস্থানের অনুকূলে ব্যবহার করছে। সরকারের ভেতরেও একটি অংশ আছে, যে অংশটি নির্বাচনকে বিলম্বিত করে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চায়। এই উভয় পক্ষের জন্যই আইনশৃঙ্খলার অবনতি কাম্য হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলার ক্রমাবনতির পাশাপাশি অর্থনীতির ভঙ্গুরতা ভয়াবহ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। সরকার অর্থনীতির পুনর্গঠনে চরম ব্যর্থতার পরিচয় স্থাপন করেছে। এই প্রেক্ষাপটে মহল বিশেষ সামরিক অভ্যুত্থানের আশঙ্কা দেখছে বলে পর্যবেক্ষকদের অনেকের ধারণা। এ প্রসঙ্গে স্পষ্টই বলা যায়, সামারিক অভ্যুত্থানের কোনো আশঙ্কা নেই। গণঅভ্যুত্থানের সময় সামরিক অভ্যুত্থানের সুযোগ ছিল বৈকি! তখনই যখন হয়নি, এখন তো পানি অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। আইনশৃঙ্খলার অবনতি ও অর্থনীতির ভঙ্গুরতার অবসান ঘটাতে পারে একমাত্র নির্বাচনের মাধ্যমে আসা সরকার। দেশ-জাতি সেই সরকারেরই প্রত্যাশা করছে। বিএনপি বরাবরই মনে করে নির্বাচিত সরকারই সব সমস্যার কার্যকর সুরাহা নিশ্চিত করতে পারে। সিপিবিসহ বিভিন্ন দলও সেটা মনে করে। সন্দেহ নেই, নির্বাচন হলে যে কোনো বিবেচনায় বিএনপিই ক্ষমতায় আসবে। যারা দ্রুত নির্বাচন চায় না, বিএনপি ক্ষমতায় আসুক, তারা চায় না, তাই তারা নানা ইস্যু তৈরি করছে, নন ইস্যুকে ইস্যু বানাচ্ছে। তাদের অসৎ উদ্দেশ্য কোনোভাবেই সফল হতে দেয়া যাবে না। অতএব, সকল মহলকে সতর্ক ও সাবধান থাকতে হবে। যে কোনো চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিতে হবে।

সূত্র, ইনকিলাব