বাংলাদেশের চারটি গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন পর ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের এই ঘোষণা শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ও সচেতন মহলে একধরনের আশাবাদ জাগিয়েছে। কারণ, স্বাধীন বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতি শুধু দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রই ছিল না; বরং গণতান্ত্রিক আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ প্রতিটি জাতীয় সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। দীর্ঘ সময় ধরে ছাত্র সংসদ নির্বাচন স্থগিত থাকা এবং ছাত্ররাজনীতির নামে সহিংসতা, দখলদারি ও স্বজনপ্রীতির সংস্কৃতি শিক্ষাঙ্গনে স্থবিরতা ও অবিশ্বাসের সংস্কৃতি তৈরি করেছে।
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে দেশে নতুন করে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। এই প্রেক্ষাপটে আসন্ন নির্বাচন শিক্ষাঙ্গনে গণতান্ত্রিক চর্চার নবযাত্রা শুরু করা, শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেতৃত্ব গঠন এবং গঠনমূলক রাজনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার একটি বড় সুযোগ। তবে একে সফলভাবে কাজে লাগাতে হলে নির্বাচনকে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে আয়োজনের বিকল্প নেই। প্রশাসন, শিক্ষক সমাজ, রাজনৈতিক দল ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি অভিন্ন প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে—এই নির্বাচনকে কোনোভাবেই সহিংসতা, সন্ত্রাস বা বাহুবলের প্রতিযোগিতায় পরিণত হতে দেওয়া যাবে না।
এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। তারা যেন প্রার্থীদের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করে, নির্বাচনী প্রচারণা শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালনার পরিবেশ তৈরি করে এবং ভোটের দিন নিরাপত্তাব্যবস্থা বজায় রাখে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শুধু নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত রাখতে হবে, যাতে তাদের উপস্থিতি ভীতির বদলে আস্থার প্রতীক হয়।
রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাও এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দলীয় হস্তক্ষেপের ফলে অতীতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের পরিবেশ ভেঙে পড়েছে। এবার দলগুলোকে নিজেদের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে শিক্ষার্থীদের স্বাধীনভাবে প্রতিনিধি বেছে নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। ছাত্রসংগঠনগুলোকে মনে রাখতে হবে, তাদের প্রথম পরিচয় ছাত্র, পরে রাজনৈতিক কর্মী। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থ, একাডেমিক পরিবেশ ও শিক্ষার্থীদের কল্যাণ—এসবই হওয়া উচিত তাদের প্রধান এজেন্ডা।
একটা বিষয় স্পষ্ট করে বলা উচিত, প্রার্থীদের নির্বাচনী ইশতেহার যেন বাস্তবসম্মত হয় এবং শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন সমস্যা সমাধানকেই প্রাধান্য দেয়। আবাসনসংকট, পরিবহন সমস্যা, একাডেমিক সেশনজট, গ্রন্থাগারের আধুনিকায়ন—এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে।
গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের নজরদারি নির্বাচনকে স্বচ্ছ রাখতে সহায়তা করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক সাংবাদিকেরা যদি নিরপেক্ষভাবে নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে খবর প্রকাশে সহায়তা করেন, তবে অনিয়মের আশঙ্কা কমে আসবে। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া তথ্য ও অপপ্রচার রোধে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে সবাইকে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই নির্বাচন কেবল একটি দিনের ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া নয়; বরং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গঠনমূলক ছাত্ররাজনীতির সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনার দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগের অংশ হওয়া উচিত। দখলদারি ও সহিংসতা নয়, শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব যেন সেবা, সততা ও সৃজনশীল চিন্তার প্রতীক হয়, এটাই সবার চাওয়া।
বাংলাদেশের ইতিহাস প্রমাণ করেছে, সঠিক সময়ে সঠিক নেতৃত্ব গড়ে উঠলে তা শুধু ক্যাম্পাসেই নয়, জাতীয় পর্যায়েও ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। তাই এই ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যদি আমরা ন্যায়সংগত, অংশগ্রহণমূলক ও গঠনমূলক রাজনীতির নতুন ধারা প্রতিষ্ঠা করতে পারি, তবে তা হবে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার পথে এক অনন্য মাইলফলক।
অন্যদিকে এই সুযোগ হাতছাড়া হলে ক্ষতি হবে কেবল শিক্ষাঙ্গনের নয়; বরং সমগ্র দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, সব পক্ষ মিলে যেন প্রমাণ করি, ছাত্ররাজনীতি মানেই সহিংসতা নয়; বরং এটি হতে পারে প্রজ্ঞা, নৈতিকতা ও দায়িত্বশীলতার উজ্জ্বল উদাহরণ।