বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় বিচারকের সংকট দিন দিন তীব্র আকার ধারণ করছে। দেশে প্রায় ১৮ কোটি মানুষের জন্য বিচারকের সংখ্যা মাত্র ২ হাজার ৩০৭। এর ফলে প্রত্যেক বিচারকের কাঁধে গড়ে দুই হাজারের বেশি মামলা জমে আছে। আপিল বিভাগে মাত্র ৭ জন বিচারপতি ৩৭ হাজার মামলার দায়িত্বে আছেন। ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার–এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
এই সংখ্যাগুলো কেবল পরিসংখ্যান নয়; বরং লাখো মানুষের হতাশা, ক্ষোভ ও অব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। মামলার জট ক্রমেই অস্বাভাবিক আকার ধারণ করছে। মামলার তারিখ পেতে বিচারপ্রার্থী বা আইনজীবীদের মাসের পর মাস, কখনো বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এর ফলে ন্যায়বিচার পাওয়া মানুষের জন্য দীর্ঘ ও অনিশ্চিত এক অপেক্ষার নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইংরেজিতে একটা কথা রয়েছে, ‘জাস্টিস ডিলেইড, জাস্টিস ডিনাইড’; ন্যায়বিচার বিলম্বিত হওয়া মানেই ন্যায়বিচার প্রত্যাখ্যাত হওয়া। বাংলাদেশে সেই প্রত্যাখ্যাতের চিত্র আজ স্পষ্ট। এটা বিচারব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থাকে দুর্বল করছে।
তুলনামূলকভাবে আমরা দেখতে পাই, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৬ হাজার ৬৬৭ জনে ১ জন বিচারক এবং যুক্তরাজ্যে প্রতি ১৩ হাজার ১৪০ জনে ১ জন বিচারক রয়েছেন। এমনকি প্রতিবেশী নেপাল ও শ্রীলঙ্কায়ও বিচারকের অনুপাত বাংলাদেশের চেয়ে অনেক ভালো। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে মালদ্বীপ ও ভুটান যেখানে বিচারকের প্রাপ্যতায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে, সেখানে বাংলাদেশ এখনো অব্যবস্থাপনায় পিছিয়ে।
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন নিম্ন আদালতে বিচারকের সংখ্যা ২ হাজার থেকে বাড়িয়ে অন্তত ৬ হাজারে উন্নীত করার সুপারিশ করেছে। বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই অন্তত এক হাজার বিচারক নিয়োগ না দিলে এই সংকট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। তবে কেবল নিয়োগই যথেষ্ট নয়; নিয়োগের পাশাপাশি দক্ষতা উন্নয়ন, অবকাঠামোগত সহায়তা ও বিচারকাজে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
প্রথমত, একটি কেন্দ্রীয় কেস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম বা মামলা ব্যবস্থাপনার জন্য একটি পদ্ধতি চালু করা জরুরি। এতে মামলার অগ্রাধিকার নির্ধারণ, শুনানির তারিখ প্রদান এবং দ্রুত নিষ্পত্তি সহজ হবে। জরুরি ও অতি জরুরি মামলাকে আলাদা করে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে হবে, যাতে অনেক মামলা আদালতে না গিয়েই নিষ্পত্তি সম্ভব হয়। তৃতীয়ত, বিচারকদের নিয়োগ ও পদোন্নতিতে রাজনৈতিক প্রভাবের অবসান ঘটিয়ে যোগ্যতা, সততা ও অভিজ্ঞতাকে প্রাধান্য দিতে হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখা। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, নিরপেক্ষ ও দক্ষ বিচারক নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক চাপের কারণে কয়েকজন বিচারককে দায়িত্ব থেকে বিরত রাখা হয়েছে, যা জন–আস্থাকে ক্ষুণ্ন করেছে। বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা না গেলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাই ঝুঁকির মুখে পড়বে।
সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, এই সংকট সমাধানকে কেবল প্রশাসনিক সমস্যা হিসেবে দেখা যাবে না। এটি ন্যায়বিচার, রাষ্ট্রীয় সুশাসন এবং আইনের শাসনের সঙ্গে সম্পর্কিত। সরকারকে যত দ্রুত সম্ভব জরুরি ভিত্তিতে বিচারক নিয়োগ, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তিনির্ভর সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। ন্যায়বিচার দ্রুত ও সবার জন্য সহজলভ্য করতে না পারলে বিচার বিভাগের ওপর জনগণের আস্থা হারিয়ে যাবে, তেমনটা হলে তা একটা বড় সংকট ডেকে আনবে।