জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমেই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল। বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের অন্তর্গত আকাঙ্ক্ষা ছিল গণতান্ত্রিক চেতনা। ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে ভারত গণতান্ত্রিক চেতনা দিয়েই জাতীয় সংহতিকে দৃঢ় করেছিল।

জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমেই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল। বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের অন্তর্গত আকাঙ্ক্ষা ছিল গণতান্ত্রিক চেতনা। ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে ভারত গণতান্ত্রিক চেতনা দিয়েই জাতীয় সংহতিকে দৃঢ় করেছিল। আর পাকিস্তান তার অখণ্ডতা রক্ষার্থে কর্তৃত্ববাদিতাকে পুঁজি করেছিল। ফলে গণতান্ত্রিক চেতনা দূরে সরে চলে যায়। এরই প্রতিক্রিয়ায় জন্ম হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে না তুলে বরং ধ্বংস করা হয়। ১৯৯১ সালে যে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাটি শুরু হয়েছিল ব্যাপক আশাবাদকে সঙ্গী করে, সেটি ব্যর্থ হয় মূলত আওয়ামী লীগের নেতিবাচক রাজনীতির কারণে। আওয়ামী লীগসহ দেশী-বিদেশী চক্রান্তকারীদের যৌথ প্রচেষ্টায় নির্বাচনী রাজনীতির মূলে কুঠারাঘাত করা হয় ২০০৬ সালে, সৃষ্টি করা হয় ওয়ান ইলেভেন, ২০০৭। মুখ থুবড়ে পড়ে নির্বাচনী গণতন্ত্র। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যে সরকার গঠন করে, সেটি ছিল নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ববাদী সরকার ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন। দেশে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন ছাড়া কর্তৃত্ববাদী সরকার ব্যবস্থা থেকে প্রত্যাবর্তন করা সম্ভব নয়। এটি নির্বাচনী গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকতা দিতে পারবে না, এটা সত্য। কিন্তু নির্বাচনী গণতন্ত্রে না ফিরলে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকতা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অসম্ভব বলে বিবেচিত হতে বাধ্য। তাই সর্বাগ্রে দেশে প্রয়োজন একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনী গণতন্ত্রের মহাসড়কে প্রবেশ করার।

একটি সর্বব্যাপী গণ-আন্দোলনে স্বৈরাচার লে. জে. এরশাদের পতনের পর স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশে ও বিদেশে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯১ সালে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এ-যাবৎ কালের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনকে ‘‌সূক্ষ্ম কারচুপি’ হিসেবে অভিহিত করেন। এমনকি ড. কামাল হোসেন নির্বাচনকে সুষ্ঠু হয়েছে মর্মে মতামত ব্যক্ত করলে তাকে দল ত্যাগে বাধ্য করা হয়। শেখ হাসিনা শুধু ‘‌সূক্ষ্ম কারচুপি’ হয়েছে বলেই স্থির থাকলেন না, বললেন ‘‌এই সরকারকে একদিনের জন্য শান্তিতে থাকতে দিব না।’ মূলত এ বক্তব্যের মধ্য দিয়েই শেখ হাসিনা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সৃষ্ট তিন জোটের রূপরেখার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করলেন। (যদিও তিনি স্বৈরাচারের দোসর ছিলেন! ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে চট্টগ্রামে তিনি ঘোষণা দেন—‘‌ যে দল সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে সেই দল জাতীয় বেঈমান হিসেবে বিবেচিত হবে।’ এ ঘোষণার দুদিন পর আওয়ামী লীগ ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দেয়। ফলে সামরিক শাসন আরো প্রলম্বিত হয়েছিল।) ফলে ১৯৯১ সালে রাষ্ট্রপতি শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তনের মতো প্রশংসনীয় উদ্যোগ সত্ত্বেও সেটির পূর্ণাঙ্গ সুফল পাওয়া সম্ভব হয়নি আওয়ামী লীগের নেতিবাচক রাজনীতির কারণে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী তার কথা ‘‌সরকারকে একদিনের জন্য শান্তিতে থাকতে দিব না’—রেখেছিলেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে সুশাসনের দিক দিয়ে সবচেয়ে প্রশংসনীয় গণতান্ত্রিক পর্বটি ছিল (১৯৯১-৯৬)। কিন্তু সেটিকে কালিমালিপ্ত করা হয়। মাগুরার উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ ১৭৩ দিনের ধ্বংসাত্মক হরতাল করে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ২৫ মার্চ ১৯৯৬ সালের মধ্যরাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলটি পাস করে। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে যে আন্দোলনটি সংগঠিত করে, সে আন্দোলনের সবচাইতে নেতিবাচক দিক হলো বেসামরিক আমলাতন্ত্রের রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত হয়ে যাওয়ার অনুষঙ্গ। আওয়ামী লীগের অপরাজনীতির এর চেয়ে বড় উদাহরণ সম্ভবত খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনে বাংলাদেশ সচিবালয়ের ৩৭ জন সচিব ‘‌জনতার মঞ্চে’ উঠে আন্দোলনের প্রতি তথাকথিত একাত্মতা ঘোষণা করে। এটা ঠিক পাকিস্তান জমানার মতো বেসামরিক আমলাতন্ত্রের ক্ষমতার মঞ্চে আবির্ভাব! এরপর থেকে আজ পর্যন্ত বেসামরিক আমলাতন্ত্রের এ কর্তৃত্ববাদিতা থেকে দেশ মুক্ত হয়নি। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। আমরা যেমনটা আগে দেখেছি আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থেকে যেমন দায়িত্বশীল বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হয়নি, তেমনি ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসেও দায়িত্বশীল সরকারি দলের ভূমিকা পালনে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেয়, ঠিক স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের মতো। ১৯৯৬-২০০১ পর্বে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সন্ত্রাস ফিরে আসে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন—‘‌একটি লাশের পরিবর্তে দশটি লাশ পড়বে’। আওয়ামী লীগ নেতাদের সন্ত্রাসে উৎসাহিত করে ভৎসর্না করেন—‘‌আপনারা শাড়ি চুড়ি পরে থাকেন?’ ঠিক (১৯৭২-৭৫) কালপর্বের মতো! ক্রসফায়ারের সিরাজ সিকদারকে হত্যা করে সংসদে রাষ্ট্রপ্রধানের সেই বিখ্যাত দম্ভোক্তি—‘‌কোথায় আজ সিরাজ শিকদার?’ অথবা ‘‌লাল ঘোড়া দাবড়ায়ে দিব।’-এর ভিন্নমাত্রার প্রতিধ্বনি ১৯৯৬-২০০১ পর্বে জনগণ শোনে এবং তার উপলব্ধিতে আসে দেশে ‘‌সন্ত্রাসের রাজত্ব’ ফিরে এসেছে, ঠিক স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের মতো! জনগণ ব্যালটের মাধ্যমে এ সন্ত্রাসের জবাব দিয়েছিল ২০০১ সালে। একটি অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হয়। এবারো শেখ হাসিনা নেতিবাচক রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে পারলেন না। দেশে ও বিদেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনকে কালিমালিপ্ত করলেন ‘‌স্থূল কারচুপি’ হয়েছে মর্মে হাস্যকর অভিযোগ এনে। ঘোষণা করলেন ‘‌শপথও নিব না, সংসদেও যাব না।’ এর মাধ্যমে যে নেতিবাচক রাজনীতি শুরু করলেন সেটি শেষ হয়েছিল ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে।

১৯৯১-২০০৬ কালপর্বে যে নির্বাচনী গণতন্ত্রের অনুশীলন হয়েছিল সেটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে মূলত আওয়ামী লীগের নেতিবাচক রাজনীতির কারণে। উপরিউক্ত কালপর্বে গণতন্ত্রের জন্য যে ধরনের জবাবদিহিতামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা দরকার সে ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যায়নি। গণতন্ত্রে সরকারের যেমন দায়িত্ব থাকে তেমনি বিরোধী দলের দায়িত্বশীলতা গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক মাত্রা দেয়। আওয়ামী লীগ বিরোধী দল থেকে দায়িত্বশীল বিরোধী দলের ভূমিকা পালনে যেমন ব্যর্থ হয়েছিল, ঠিক তেমনি সরকারি দলে থেকেও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়। আওয়ামী লীগের এ ব্যর্থতা থেকেই নির্বাচনী গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা মুখ্য হয়ে ওঠে। এর অনিবার্য পরিণতিতে ২০০৬ সালে রাজনৈতিক সংকটের সূচনা হয়। এ সংকটের মাধ্যমেই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পশ্চাৎ যাত্রার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হয়ে উঠল। ১৯৯১-২০০৬ কালপর্বে গণতন্ত্রের পথ ও পরিক্রমাকে আলী রীয়াজ (২০২১) চিহ্নিত করেছেন নির্বাচনী গণতন্ত্র-আধাকর্তৃত্ববাদ-প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক কর্তৃত্ববাদ। ১৯৯১ সালে যে নির্বাচনী গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০০৬ সাল নাগাদ তা ‘‌আধাকর্তৃত্ববাদ’ হয়ে ‘‌প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক কর্তৃত্ববাদে’ পরিণত হয়।

স্বাধীনতার পর থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দেশে ১২টি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনগুলোর মধ্যে পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম ও নবম জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। দলীয় সরকারের তুলনায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে বলে দেশী-বিদেশী পর্যবেক্ষক মহল মতামত ব্যক্ত করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত অধিকাংশ নির্বাচনী ছিল কারচুপি, প্রতারণামূলক ও প্রশ্নবিদ্ধ। অনেক নির্বাচনেই নিজের পছন্দমতো জনপ্রতিনিধি বা সরকার নির্বাচিত করার সুযোগ জনগণের ছিল না। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচারের পতনের সঙ্গে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন ঘটে এবং সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয়।

২০০৯ সালের পরে তৎকালীন ক্ষমতাসীনরা কর্তৃত্ববাদী শাসনের পথে যাত্রা শুরু করে। সবগুলো বিরোধী দল, সিভিল সোসাইটির তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও ২০১১ সালের মে মাসে সুপ্রিম কোর্টের একটি সংক্ষিপ্ত রায়কে অজুহাত করে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগীরা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে। ২০১১ সালের ১০ মে সুপ্রিম কোর্ট বিদ্যমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে একটি রায় প্রকাশ করেন। সংক্ষিপ্ত এ রায়ে বলা হয়, সংবিধান ত্রয়োদশ সংশোধনী আইন ১৯৯৬ এখন থেকে বাতিল ও সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করা হলো। কিন্তু এ রায়ে পর্যবেক্ষণ হিসেবে এটাও বলা হয় উপরোক্ত ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিধানের অধীনে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। সংক্ষিপ্ত রায় কিংবা ১৪ মাস পরে প্রকাশিত পূর্ণ রায়ের কোথাও স্পষ্টভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুরোপুরিভাবে বাতিলের কথা বলা ছিল না। তার পরও তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল এ রায়কেই একটি অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করেছে। তাছাড়া ক্ষমতাসীন দলের সদস্যদের নিয়ে গঠিত একটা সংসদীয় কমিটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুরোপুরি বাতিলের বদলে এর সংশোধনের প্রস্তাব করে। কিন্তু স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একক সিদ্ধান্তে এ ব্যবস্থা বাতিল করা হয়।

পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয় এবং মেয়াদ শেষের আগে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার বিধান করা হয়। এর অর্থ নির্বাচনের সময়ও মন্ত্রিসভার দায়িত্বপ্রাপ্তরা স্বপদে বহাল থাকবেন এবং সংসদ কার্যকর থাকবে। পূর্ববর্তী সংসদ কার্যকর থাকা অবস্থায়ই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, যা কিনা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় নিরপেক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বিশ্বজুড়ে সংসদীয় ব্যবস্থার সাধারণ রীতিবিরুদ্ধ। সুপ্রিম কোর্টের কাঁধে বন্দুক রেখে নির্বাচনকে অকার্যকর করে দিতে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনের মাধ্যমে দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতাহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যে নির্বাচনে ফলাফলে কোনো অনিশ্চয়তা থাকে না। তাই এ ধরনের নির্বাচন কর্তৃত্ববাদের হাতিয়ারে পরিণত হয়। এক্ষেত্রে স্বৈরশাসক লে. জে. এরশাদের আমলে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো স্মরণ করা যেতে পারে। লে. জে. এরশাদ জমানায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোয় (স্থানীয় পরিষদ ও সংসদ নির্বাচন) সাধারণ জনগণের উৎসাহ না থাকায় (প্রতিযোগিতাহীন নির্বাচন) ভোটারের উপস্থিতি থাকত নগণ্য। ভোটের দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের বলা হতো নির্দিষ্টসংখ্যক সিল মেরে ব্যালট বাক্স পূর্ণ করার। স্বৈরাচার এরশাদ জমানার মতোই শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থায়ও একই দৃশ্যের মঞ্চায়ন লক্ষ করা গেছে। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪-এর জাতীয় নির্বাচনসহ উপনির্বাচনগুলোয় অত্যন্ত নগণ্য সংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি এরশাদ জমানায় ফেরার স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে।

স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ল্যারি ডায়মন্ড (২০১৭) স্বৈরাচারীদের ১২ ভাগ কর্মসূচি বলে একটি তালিকা দিয়েছেন, তালিকাটি নিম্নরূপ:

বিরোধীদের অবৈধ ও দেশপ্রেমিক নয় বলে চিত্রিত করা; আদালতের স্বাধীনতা খর্ব করা; গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আক্রমণ করা; রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমগুলোকে দখল করা; ইন্টারনেটের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ; সিভিল সোসাইটির অন্য উপাদানগুলো যেমন নাগরিক অধিকারবিষয়ক সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশেষ করে দুর্নীতিবিরোধী এবং মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোকে শায়েস্তা করা; ব্যবসায়িক সম্প্রদায়কে হেনস্তা করার হুমকি দেয়া; অনুগত একটি নতুন পুঁজিবাদী শ্রেণী তৈরি করা; সিভিল সার্ভিস ও নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট বাহিনীর ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন; নির্বাচনী এলাকাগুলো নিজেদের সুবিধামতো করে সাজানো এবং নির্বাচনী আইনকানুন জালিয়াতি করা; নির্বাচন পরিচালনার সংস্থার ওপরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা; ওপরের ধাপগুলো বারবার করতে থাকা।

এছাড়া বিবিসি বাংলা ২০১৯ সালে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতির ১০টি লক্ষণের তালিকা দেয়। ১০টি লক্ষণ হলো—প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন, প্রতিদ্বন্দ্বীকে নানা কৌশলের মাধ্যমে নির্বাচনে অযোগ্য করে একনায়কদের করা সাজানো নির্বাচন; নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণ হ্রাস; একদলীয় সংসদ; নিরাপত্তা বাহিনীর প্রভাব বৃদ্ধি; দুর্বল (গণতান্ত্রিক) প্রতিষ্ঠান; মত প্রকাশে ভয়; দুর্নীতি বৃদ্ধি এবং একনায়কদের ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার প্রবণতা।

উপরিউক্ত দুটো সূচকের মাধ্যমেই সিদ্ধান্তে আসা যায়, বাংলাদেশে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা চালু করেছিল আওয়ামী লীগ। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর সরকার এমন এক প্রক্রিয়ার দিকে অগ্রসর হয়েছে যার মূলগত উদ্দেশ্য হলো, গণতন্ত্রকে টেকসই করতে পারে এমন সব রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা। এক্ষেত্রে তিনটি ধাপ অনুসরণ করা হয়েছে প্রথমত, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে শাসন ব্যবস্থা পাল্টে ফেলে গোটা ব্যবস্থাকে নিজ বলয়ে নিয়ে আসা। দ্বিতীয়ত, ২০১৩ সালের তথ্য প্রযুক্তি আইন এবং ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে বিরোধী দল ও মতের দমন করা। তৃতীয়ত, বিচার বিভাগকে কুক্ষিগত করার মাধ্যমে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ববাদিতা সৃষ্টি করা। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো, প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার জোরপূর্বক পদত্যাগ এবং দেশত্যাগে বাধ্য করা।

বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথভাবে গড়ে ওঠেনি, প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথভাবে কাজ করতে পারে না, এমন একটি দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো গ্রহণযোগ্য বিকল্প আর একটিও নেই। তাই ন্যূনতম নির্বাচনী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরতে গেলেও বাংলাদেশে প্রয়োজন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের দুটি ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে বাতিল ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের বিধান পুনর্বহাল এবং আইনের আরো চারটি ধারা বাতিল করেছেন আদালত। মহামান্য আদালতের এ রায়কে আমরা স্বাগত জানাই।

ড. মো. শামছুল আলম: অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ; ডিন (ভারপ্রাপ্ত), সমাজবিজ্ঞান অনুষদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র, বণিক বার্তা