অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর অতিক্রম করেছে। এই এক বছরে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা, তার প্রভু মোদি এবং তাদের এদেশীয় দোসররা নানাভাবে সরকার ফেলে দেয়ার ষড়যন্ত্র করেছে। এই ষড়যন্ত্র ছাত্র-জনতা ও ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দিয়েছে। তাদের একের পর এক ষড়যন্ত্র যখন ব্যর্থ হয়েছে, তখন প্রিন্ট মিডিয়া, টেলিভিশন চ্যানেল ও অন্যান্য গণমাধ্যমে ঘাপটি মেরে থাকা হাসিনার দোসর সাংবাদিকরা রং বদলে গণমাধ্যমে বহাল তবিয়তে রয়েছে। অনেকে গুহা থেকে মুখ বের করা শুরু করেছে। যারা খোলস থেকে বের হচ্ছে, তারা এখন অন্তর্বর্তী সরকারের ভুল-ত্রুটি নিয়ে সমালোচনায় মেতে উঠেছে। যেকোনো ইস্যুতে সরকারের সমালোচনা করে ইংরেজি-বাংলায় ঢাউস সাইজের কলাম, প্রতিবেদন ইত্যাদি প্রকাশ করছে। এর মাধ্যমে পরোক্ষভাবে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিক্রির পক্ষে কথা বলছে। ইনিয়ে বিনিয়ে ‘আগেই ভালো ছিলাম’ এই বয়ান সামনে এনে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে লিখছেন, কথা বলছেন। তাদের এই চেষ্টা ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’কে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে। ঘোষণাপত্রে কি আছে, কি নেই, তুলে ধরে সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে ধান্ধাবাজি সামনে নিয়ে আসছে। কেউ কেউ এমনও লিখছেন, জুলাই ঘোষণাপত্রে মুক্তিযুদ্ধ ও ভারতের অবদানকে খাঁটো করা হয়েছে। অথচ এই তারাই শেখ হাসিনা যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ব্যবসা করে জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করে ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠেছিলেন, এ নিয়ে কোনো কথা বলেন না। তাদের পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলে হাসিনাকে ‘ফ্যাসিস্ট’ নিদেনপক্ষে ‘স্বৈরাচার’ শব্দ উচ্চারণ করে না। তার নামের আগে ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী’ জুড়ে দিচ্ছেন। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের আগে যদি ‘স্বৈরাচার’ শব্দ যোগ করা যায়, তাহলে তারা হাসিনার নামের আগে কেন ‘ফ্যাসিস্ট’ বা ‘স্বৈরাচার’ যুক্ত করে না? তাদের এই আচরণ থেকেই বোঝা যায়, তারা হাসিনার কতটা দোসর হয়েছিলেন।

দীর্ঘ দেড় দশকের বেশি সময় ধরে তথাকথিত প্রগতিশীল সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের নিরন্তর তোষামোদি শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ সৃষ্টি করে ঔপনিবেশিক ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতির মাধ্যমে দেশকে বিভাজিত করে হাসিনার শাসন-শোষণকে তরা উৎসাহ দিয়েছেন। বিনিময়ে তারা এন্তার সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তাদের মিডিয়াগুলোকে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বিক্রির এজেন্সিতে পরিণত করেছেন। তারা আন্দোলনরত বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের ওপর হাসিনার দমন-পীড়ন, খুন, গুম, জেল-জুলুম, মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতা হরণের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো প্রতিবাদ করেনি। তাদের প্রবণতা এমন হয়ে গিয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথিত সৌল এজেন্ট হাসিনা সাত খুন করলেও তা মাফ করে দেয়া যায়। এমনকি অসংখ্য সাংবাদিক হত্যা, নির্যাতন, গুম, জেল-জুলুমের শিকার হলেও তা নিয়ে টুঁ শব্দ করতে দেখা যায়নি। সাগর-রুনির বিচারের ব্যাপারে তাদের কোনো তাগিদ ছিল না। এখন গাজীপুরে এক সাংবাদিক হত্যা এবং একটি সংবাদপত্র অফিসে পালবদল নিয়ে খুব হইচই শুরু করে দিয়েছে। আমরা সাংবাদিক হত্যা ও সংবাদপত্রে যেকোনো ধরনের হস্তক্ষেপ কোনোভাবেই সমর্থন করি না। তবে যারা ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সময় সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতন ও ভিন্নমতের পত্রপত্রিকা এবং টিভি চ্যানেল বন্ধ করা নিয়ে কোনো প্রতিবাদ করেনি, সেই তাদের এখন প্রতিবাদী হওয়াকে প্রহসন ছাড়া কিছু বলা যায় না। তারা এখন অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। হাসিনার সময়ে তাদের এই প্রতিবাদ ও আহাজারি কোথায় ছিল? তারা এখন কেন এত সোচ্চার হয়ে উঠেছেন? এর জবাব প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং বেশ কড়াভাবেই দিয়েছে। গত বৃহস্পতিবার সংবাদপত্র মালিকদের এক বিবৃতির জবাবে প্রেস উইংয়ের বিবৃতির এক অংশে বলা হয়েছে, ‘গঠনমূলক সমালোচনা উন্মুক্ত থাকা সত্ত্বেও সরকারের পরামর্শ হচ্ছে, দায় আরোপ করার আগে নোয়াবের উচিৎ, নিজ সংগঠনের ভেতর নজর দেয়া।’ বলার অপেক্ষা রাখে না, বর্তমানে এ সংগঠনের নেতৃত্বে কারা আছেন, তাদের ভূমিকা কারো অজানা নয়। এই তাদেরই কেউ কেউ ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার শাসনামলকে বাহবা ও সমর্থন দিয়ে ফ্যাসিবাদী শাসনকে দীর্ঘায়িত করতে সহায়তা করেছেন। তারা হাসিনার একপাক্ষিক মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ব্যবসাকে সমর্থন দিয়ে গেছেন। হাসিনাকে দিয়ে ভারত দেশকে তার অঙ্গরাজ্যে পরিণত করলেও তার কোনো প্রতিবাদ করেননি। এমনকি ভারতের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতারা বারবার ‘একাত্তরেই বাংলাদেশ দখল করে নেয়া উচিৎ ছিল’ বলে বক্তব্য দিলেও তার প্রতিবাদে সংবাদ প্রকাশ বা কলাম লেখা দূরে থাক, লিপসার্ভিসটুকু পর্যন্ত দেননি। উল্লেখ করা প্রয়োজন, মুক্তিযুদ্ধ যে, কোনো দল বা পরিবারের একক যুদ্ধ ছিল না, ছিল দেশের সব শ্রেণীপেশা মানুষের এক জনযুদ্ধ, এ সত্যটি হাসিনা মেনে না নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে তার বাবার সম্পদ হিসেবে কুক্ষিগত করতে চেষ্টা করেছেন। কারণে-অকারণে ভারতের সহাযোগিতায় গদগদ হয়েছেন। তার এই ন্যারেটিভকে দীর্ঘ দেড় দশকের বেশি সময় ধরে সায় দিয়ে গেছে তথাকথিত প্রগতিশীল ও তেলবাজ সাংবাদিক এবং হাসিনামিডিয়া। যুক্তিযুদ্ধ নিয়ে হাসিনার চেতনা ব্যবসা ও ভারতের প্রভুত্বকে দেশের মানুষ মেনে নিতে পারেনি। দেশের স্বাধীনাত-সার্বভৌমত্বকে বিকিয়ে দেয়া নিয়ে হাসিনার ওপর তারা চরম ক্ষুব্ধ ছিল। তাদের এই ক্ষুব্ধতার বিস্ফোরণ ঘটে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে। শেষ পর্যন্ত তাকে জীবন নিয়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছে। আমরা দেখেছি, হাসিনা বিদেশ সফর শেষে দেশে ফিরে যে সংবাদ সম্মেলন করতেন, তাতে তার চাটুকার সাংবাদিকরা কীভাবে তোষামোদী করত! তার পতনের আগে সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে দুর্নীতি ও হত্যা মামলায় গ্রেফতার হয়ে জেলে থাকা একাত্তর টেলিভিশনের সাংবাদিক ফারজানা রুপা তাকে প্রশ্ন করে কীভাবে তাকে উত্তেজিত করে গণহত্যার উসকানি দিয়েছে, তা দেশবাসী দেখেছে। তার মতো এমন আরও চিহ্নিত তেলবাজ ও তোষামোদকারি সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের অনেকে পালিয়ে গেছেন, অনেকে এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। তাদের কেউ এখন রং পাল্টিয়ে নিরপেক্ষ সেজে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে উচ্চকিত। কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ব্যবসা নিয়ে মাঠে নেমে গেল গেল বলে রব তুলেছেন। ফলে, মুক্তিযুদ্ধের নানা দিক নিয়ে এখন আলোচনা হচ্ছে। যারা হাসিনার অনুসারী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ব্যবসায়ী, তারা যে পুনরায় হাসিনা ও ভারতের ন্যারেটিভকে প্রতিষ্ঠিত করতে মাঠে নেমেছেন, সেটা বোঝা যাচ্ছে। বলা প্রয়োজন, মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যÑ গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা, তা স্বাধীনতার পরপরই শেখ মুজিবুর রহমান সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে একদলীয় বাকশাল কায়েম এবং চারটি সংবাদপত্র বাদে বাকি সব নিষিদ্ধ করে স্বাধীনতার চেতনাকে কবর দিয়েছিলেন। তিনিই দেশে ফ্যাসিজমের জনক ছিলেন। তার মেয়ে হাসিনা ২০০৮ সালে ক্ষমতায় এসে দেড় দশকের বেশি সময় ধরে সেই ফ্যাসিজমকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়ে ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠেন। তবে শেখ মুজিবের বাকশালি ফ্যাসিজম থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে মুক্ত করে দেন সিপাহী-জনতার বিপ্লবে বন্দিদশা থেকে মুক্ত হওয়া স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান। দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ যতবার ক্ষমতায় এসেছে, ততবার দেশ ফ্যাসিজমের কবলে পড়েছে। মুক্তিযুদ্ধের একচ্ছত্র মালিক বনে যাওয়া এবং চেতনা বাণিজ্য যে দেশের মানুষ পছন্দ করে না, তা দেশের মানুষ শেখ মুজিব ও তার মেয়ে শেখ হাসিনার পতন ঘটিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে। এখনও এই চেতনা ব্যবসাকে যেসব সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী আঁকড়ে ধরে আছেন, তারা তা থেকে শিক্ষা নেননি বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

পর্যবেক্ষকদের মতে, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনার স্বীকৃতি। এর মাধ্যমে শেখ হাসিনার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ব্যবসার চূড়ান্ত পতন ঘটেছে। শুধু হাসিনারই পতন নয়, তার প্রভু ভারতেরও পতন হয়েছে। দেশের মানুষ বুঝিয়ে দিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ব্যবসা আর চলবে না। তারা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ধারণ করেই এগিয়ে যেতে চায়। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য বিজয়ী দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের স্বীকৃত পথ ধরেই এগিয়ে যাবেন বলে, দেশের মানুষের প্রত্যাশা। যারা এখন ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে হাসিনার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ব্যবসা ফিরিয়ে আনা ও ভারতীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের পথ ধরেছেন, তাদের এ স্বপ্ন কখনো পূরণ হবে না।

সূত্র, ইনকিলাব