বিজ্ঞানের অগ্রগতি বেড়েই চলেছে। যারা ব্যবহার করছে তারা লাভবান হচ্ছে। ধরিত্রীর বাইরে গ্রহ-নক্ষত্রেও পৌঁছে যাচ্ছে। সেখানেও স্থায়ী বসবাসের কর্মপরিকল্পনা করা হচ্ছে। ইলন মাস্ক ২০৩০ সালে মঙ্গলে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। মহাকাশে নভোচারীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ও গভীর মহাশূন্যে অভিযান সংক্রান্ত চিকিৎসা সহায়তা বাড়াতে চীন গড়ছে একটি ভবিষ্যৎ মহাকাশ হাসপাতাল। এই অবস্থায় নতুন আলোচনা শুরু হয়েছে প্রযুক্তি নিয়ে। প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়তে বাড়তে মানুষের জীবনের নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি মানুষের চরম প্রতিদ্বন্দ্বীও হয়ে উঠেছে। ফলে কোটি কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছে। প্রযুক্তির সর্বাধিক ব্যবহার হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই-ভিত্তিক প্রযুক্তি। তন্মধ্যে মানবাকৃতির এআইয়ের ব্যবহার সর্বাধিক। ওপেনএআইয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা স্যাম অল্টম্যান সম্প্রতি বলেছেন, ‘এআইয়ের কারণে একেবারেই বিলুপ্ত হতে পারে কিছু পেশা’। তিনি আরো বলেছেন, ‘সময়ের সাথে সাথে এআই ব্যবহার করা ক্রমেই সাশ্রয়ী হবে’। মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস বলেছেন, ‘জীববিজ্ঞান ও জ্বালানি খাত ছাড়া সব পেশা দখলে নেবে কৃত্রিম বিদ্ধিমত্তা’। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গডফাদার ও নোবেলজয়ী কম্পিউটার বিজ্ঞানী জেফরি হিন্টন বলেছেন, ‘এআই প্রযুক্তি মানবজাতিকে ধ্বংস করে দিতে পারে’। তবুও প্রযুক্তির ব্যবহার ও উৎকর্ষ বন্ধ হচ্ছে না, বরং বেড়েই চলেছে। চীনের তৈরি একটি মানবাকৃতির রোবট পিএইচডি করছে। এই রোবটটি তৈরি করেছে ইউনিভার্সিটি অব সাংহাই ফর সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ও ড্রয়েডআপ রোবোটিকস। রোবট দিয়ে এখন নদী ও সাগরের বর্জ্য-আবর্জনা পরিষ্কার করা হচ্ছে। দামে সস্তা, ব্যবহারে সর্বাধিক সুবিধা, উৎপাদনশীলতার হার বেশি ও নিখুঁত ইত্যাদি কারণে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েই চলেছে। সে কারণে এর উৎকর্ষও বেড়েই চলেছে। প্রযুক্তিবিদরা এ ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। এআই তৈরি ভুয়া ছবি ও কথার ছড়াছড়ি চলছে সারা বিশ্বে!
প্রযুক্তির উৎকর্ষের ক্ষেত্রে শরীর শিউরে উঠার মতো উদ্ভাবন করেছেন প্রযুক্তির জনক ও বর্তমান বিশ্বের প্রধান ধনী ইলন মাস্ক। সম্প্রতি তার উদ্ভাবনকৃত প্রযুক্তি হচ্ছে, পায় ৯ হাজার কিলোমিটার গতি সম্পন্ন হাইপারসনিক ফাইটার জেট। ঝঢ়ধপবঢ এবং টেসলা অ্যাডভান্সড এভিয়েশন যৌথভাবে এটি তৈরি করেছে। এর গতিবেগ ঘণ্টায় ৮,৬০০ কিলোমিটার, যা শব্দের গতির ৭ গুণ বেশি, যা বর্তমানে প্রচলিত যেকোনো ফাইটার জেটের সর্বোচ্চ গতির (যেমন এফ-৩৫-এর ম্যাক ১.৬) চেয়ে তিন গুণেরও বেশি দ্রুত। পেন্টাগন এটিকে ‘৬ষ্ঠ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান-এর সূচনা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। পন্ডিতরা এই উদ্ভাবনকে বিমান প্রযুক্তিতে নতুন বিপ্লব বলে আখ্যায়িত করেছেন। হাইপারসনিক ফাইটার জেট সর্বাধিক ধ্বংসাত্মক হলেও যুদ্ধবাজরা যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য এটা তৈরি এবং ব্যবহার করবেই। তাই এটি তৈরি করার জন্য ধনী ও যুদ্ধবাজ দেশগুলোর মধ্যে প্রচন্ড প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যাবে অচিরেই! সিএনবিসির সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, হালে এআইয়ের বদৌলতে যে হারে নতুন বিলিয়নেয়ার তৈরি হচ্ছে, তা অতীতের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম বৃহৎ সম্পদ সৃষ্টির এ ঢেউ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নতুন এক অধ্যায়। সিবি ইনসাইটসের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে এআই জগতে ৪৯৮টি ‘ইউনিকর্ন’ কোম্পানি রয়েছে, যাদের প্রত্যেকের বাজারমূল্য ১০০ কোটি ডলার বা আরো বেশি। এ কোম্পানিগুলোর সম্মিলিত আকার ২.৭ ট্রিলিয়ন ডলার।
প্রযুক্তির ব্যবহার যতই বেড়ে যাচ্ছে, জনবহুল দেশে বেকারত্ব ততই বেড়ে যাচ্ছে। বেকাররা অবর্ণনীয় দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। তাই প্রযুক্তি বিরোধী তৎপরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে সারা বিশ্বেই। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘ পর্যন্ত ভূমিকা পালন করছে। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ সংস্থার (আইটিইউ) প্রধান ডোরিন বোগডান-মার্টিন সম্প্রতি বলেছেন, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণে দ্রুত একটি আন্তর্জাতিক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। নতুবা অপরিকল্পিত উদ্যোগ ঝুঁকি ও বৈষম্য আরো বাড়িয়ে দিতে পারে’। তবুও এখনো বিশ্বের ৮৫ শতাংশ দেশের কোনো জাতীয় এআই নীতিমালা নেই বলে এক তথ্যে জানা গেছে।
যা’হোক, এআইয়ের উত্থান বিস্ময়কর। তাই প্রযুক্তি নিয়ে দেশে দেশে এমনকি আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিকভাবে বিশ্ব মেলা, প্রতিযোগিতা চলছে অহরহ। এআই নিয়ে সর্বশেষ বিশ্ব মেলা হয়েছে চীনে। ২০২৫ সালের জুলাই ২৬ থেকে ২৮ পর্যন্ত, বিশ্ব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) সম্মেলন ও বিশ্ব এআই পরিচালনা সংক্রান্ত উচ্চ পর্যায়ের সভা চীনের সাংহাইয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবার সম্মেলনের প্রতিপাদ্য ছিল স্মার্ট যুগ, বৈশ্বিক সহযোগিতা। ৮শ’টির বেশি কোম্পানি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিল, যাতে তারা ৪০টিরও বেশি লার্জ মডেল, ৫০টিরও বেশি এআই টার্মিনাল পণ্য ও ৬০টিরও বেশি স্মার্ট রোবটসহ ৩ হাজারেরও বেশি অত্যাধুনিক পণ্য প্রদর্শন করেছে। স্মরণীয় যে, নিত্য নতুন এআই উদ্ভাবন হচ্ছে। ভারতের কেরালার শিক্ষার্থী অজয় এইচ ‘টক-টু-রাইট’ নামে এআই-চালিত এক যন্ত্র উদ্ভাবন করেছে, যা মুখে বললেই কাগজে লিপিবদ্ধ হবে। ২০২৬ সাল থেকে দুবাইয়ের আকাশপথে যাত্রী পরিবহন চলবে বৈদ্যুতিক এবং পরিবেশবান্ধব উড়ন্ত ট্যাক্সি। এটি সফলভাবে পূর্ণমাত্রার পরীক্ষামূলক ফ্লাইট সম্পন্ন করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জোবি অ্যাভিয়েশন এটি নির্মাণ করেছে। সৌদি আরবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা পরিচালিত একটি ক্লিনিক চালু হয়েছে গত এপ্রিলে, যা বিশ্বে প্রথম। এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার পরামর্শ দিতে সক্ষম। চীনের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ইন্সটিটিউটের প্রকাশিত ‘মানবাকৃতির রোবট শিল্প উন্নয়ন গবেষণা প্রতিবেদন, ২০২৪’ অনুযায়ী, ২০২৮ সালের মধ্যে চীনে গোটা যন্ত্র বাজারের আকার ২ থেকে ৫ বিলিয়ন ইউয়ান হবে; ২০৩৫ সালের মধ্যে গোটা যন্ত্র বাজারের আকার প্রায় ৫০ বিলিয়ন ইউয়ানে পৌঁছাবে এবং ২০৪৫ সালের পর, ব্যবহৃত মানবাকৃতির রোবটের সংখ্যা দাঁড়াবে ১ বিলিয়নের বেশি। প্রযুক্তি এখন অত্যাবশ্যক পণ্যে পরিণত হয়েছে। তাই প্রযুক্তিকে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। এর অগগতি বাড়তেই থাকবে। কেউ রুখতে পারবে না। প্রযুক্তির অগ্রগতি অপ্রতিরোধ্য।
এ অবস্থায় এআইয়ের উন্নয়নে বিনিয়োগের হিড়িক পড়েছে সারাবিশ্বেই। প্যারিসে ‘এআই অ্যাকশন সামিট ২০২৫’-এ ফ্রান্স এআই খাতের উন্নয়নে ১০৯ বিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগ করার ঘোষণা দিয়েছে। এই সম্মেলনে এআই উন্নয়নে উন্মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। তাতে ফ্রান্স, চীন ও ভারতসহ ৬০টি দেশ স্বাক্ষর করেছে। তবে, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সই করেনি। আন্তর্জাতিক এই সম্মেলনে প্রায় ১০০টি দেশের রাষ্ট্র প্রধান, শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী এবং বিজ্ঞানীরা অংশগ্রহণ করেন।
কিন্তু প্রযুক্তি অত্যাবশ্যক পণ্য হলেও এই খাতে দক্ষ লোকের ঘাটতি রয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ডাটা কর্পোরেশনের (আইডিসি) তথ্য মতে, প্রযুক্তিগত দক্ষতার ঘাটতিতে ২০২৬ সালে বৈশ্বিক কোম্পানিগুলোর ক্ষতির আকার দাঁড়াবে ৫.৫ ট্রিলিয়ন ডলার। মার্কিন গবেষণাপত্র-২০২৪ মতে, মানব সভ্যতার জন্য হুমকি হতে পারে উন্নত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।কাউন্টারপয়েন্টের রিসার্চের ‘গ্লোবাল এআই সিটিজ ইনডেক্স- ২০২৫’ মতে, এআই ব্যবহারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শহর এখন সিঙ্গাপুর। তারপর যথাক্রমে সিউল ও বেইজিং। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশ প্রযুক্তি খাতের উন্নতি আশানুরূপ নয়। আইএমএফ প্রণীত এআই প্রস্তুতি সূচক-২০২৪ মতে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) প্রস্তুতিতে বিশ্বের ১৭৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৩তম। এই সূচকে কেনিয়া, রুয়ান্ডা, ঘানা, সেনেগাল বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে। বর্তমানেও বাংলাদেশের অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি!Local culture
বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। ২০২৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এ ঐতিহাসিক অর্জন কার্যকর হবে। তখন দেশ মহা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। সে চ্যালেঞ্জের অন্যতম হচ্ছে, বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা তথা জিএসপি সুবিধা এবং বিশেষ সুবিধায় আন্তর্জাতিক ঋণ পাওয়া বন্ধ ইত্যাদি হবে। উপরন্তু বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চরম ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এ অবস্থায় এলডিসি উত্তরণোত্তর সংকট এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট মোকাবেলা করে কাক্সিক্ষত উন্নতি করতে হবে এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হবে। সে লক্ষ্যে দেশে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে তথা দেশের সর্বত্রই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। উপরন্তু দেশোপযোগী প্রযুক্তি আবিষ্কার করে ব্যবহার করতে হবে। সর্বোপরি সমগ্র জাতিকে প্রযুক্তিমনস্ক করতে হবে। সে ক্ষেত্রে তরুণদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। কারণ, তারা পরিবর্তনে বিশ্বাসী এবং দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। তাই দেশের শিক্ষার সকল স্তরে সর্বদা আধুনিক প্রযুক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করে শিক্ষার্থীদের ভালভাবে শিক্ষা দান করতে হবে। মালয়েশিয়ার প্রযুক্তিবিদ আইদিলা রাজ্জাকের মতে, এআই টুলস ব্যবহার সম্পর্কে যত জ্ঞান অর্জন করা যাবে, ততটাই যথাযথভাবে এ প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি এআই দিয়ে তৈরি ভুয়া তথ্য শনাক্ত করাও সম্ভব হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।