সরকারি কর্মচারীদের পদোন্নতি প্রক্রিয়া নিয়ে সাধারণের মধ্যে খুব একটা আলোচনা হয় না। এমনকি রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চোখে পড়ে না।

সরকারি কর্মচারীদের পদোন্নতি প্রক্রিয়া নিয়ে সাধারণের মধ্যে খুব একটা আলোচনা হয় না। এমনকি রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চোখে পড়ে না। যদিও রাষ্ট্রের বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের সেবার মান ও দক্ষতার সঙ্গে বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ।

বর্তমানে যে প্রক্রিয়া ও কাঠামোর মধ্যে সরকারি কর্মচারীদের পদোন্নতি দেয়া হয় তা অত্যন্ত অন্যায় ও বৈষম্যমূল্যক। সংগত কারণেই তা অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের চূড়ান্ত অজ্ঞতা ও অদূরদর্শিতা এবং আমলাতন্ত্রের একটি অংশের ঔপনিবেশিক মনোবৃত্তির কারণে এ অন্যায়, অগ্রহণযোগ্য ও বৈষম্যমূলক রীতিই চলে আসছে বছরের পর বছর। বিদ্যমান পদোন্নতি পদ্ধতি কেন অন্যায় ও বৈষম্যমূলক তা বোঝা যাবে পদোন্নতির জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটি পর্যালোচনা করলেই।

প্রজাতন্ত্রের নবম গ্রেড ও তদূর্ধ্ব স্তরের কর্মচারীদের পদোন্নতির জন্য দুটি কমিটি তৈরি করা হয়। এর একটির নাম ডিপিসি ও অন্যটির নাম এসএসবি। ডিপিসি হলো ডিপার্টমেন্টাল প্রমোশন কমিটি বা বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটি। আর এসএসবি হলো সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড। ডিপিসির মাধ্যমে নবম থেকে ষষ্ঠ গ্রেডের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেয়া হয়। সব পেশা ও বিভাগের ক্যাডার কর্মকর্তা নবম গ্রেডে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন। অন্যদিকে এসএসবির মাধ্যমে উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদে পদোন্নতি ও নিয়োগ দেয়া হয়। এসএসবির মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিভিন্ন দপ্তর, অধিদপ্তর, স্বশাসিত সংস্থার প্রধানসহ রাষ্ট্রের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদেও নিয়োগ দেয়া হয়।

কিন্তু এ দুটি কমিটির সদস্য নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ডিপিসির সদস্য হিসেবে রয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব, সংস্থাপন ও অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব/যুগ্ম সচিব ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রধান। একটু খেয়াল করলে খুব সহজেই বোঝা যায় এ কমিটির সমস্যা কোথায়! ডিপিসির সদস্য চারজন। এর মধ্যে তিনজনই প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য। আর একজন নিজ বিভাগের প্রধান।

বাংলাদেশে বর্তমানে ২৬টি ক্যাডার সার্ভিস রয়েছে। এদের সবার কাজের ধরন আলাদা। একজন ট্যাক্স অফিসার যে কাজ করেন, একজন পুলিশ কর্মকর্তা সেই কাজ করেন না। একজন কৃষি কর্মকর্তা ও একজন প্রকৌশলীর কাজের ধরন ও প্রকৃতি আলাদা। কিন্তু আপনি যে পেশায়ই চাকরি করেন না কেন, পদোন্নতির জন্য আপনাকে প্রশাসনের সদস্যদের দয়ার ওপর নির্ভর করতেই হবে। কারণ বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটির তিনজন সদস্যই প্রশাসনের সদস্য। কাজেই সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে পদোন্নতি সম্পর্কিত সব সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা তাদের হাতেই ন্যস্ত করা হয়েছে। প্রশাসনের সদস্যরাই সিদ্ধান্ত নেন কোন পেশার কতজনকে পদোন্নতি দেয়া হবে, কখন পদোন্নতি দেয়া হবে কিংবা আদৌ পদোন্নতি দেয়া হবে কিনা! নিজেদের পদোন্নতির ক্ষেত্রেও তারাই সর্বেসর্বা। তারা নিজেরাই ঠিক করেন নিজেদের কতজনকে পদোন্নতি দেয়া হবে, কখন দেয়া হবে। ফলে একদিকে প্রশাসন ক্যাডারের পদোন্নতি দ্রুততর হচ্ছে, অন্যদিকে অন্য পেশার পদোন্নতিতে তৈরি করা হচ্ছে ইচ্ছাকৃত দীর্ঘসূত্রতা। একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। প্রশাসন ক্যাডারের ২২তম ব্যাচের কর্মকর্তারা যেখানে তৃতীয় গ্রেডের পদে পদোন্নতি পেয়েছেন, সেখানে পুলিশ ও ট্যাক্স ক্যাডারের কর্মকর্তাদের অবস্থান চতুর্থ গ্রেডে, আর শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের অবস্থান পঞ্চম গ্রেডে। এমনকি শিক্ষা ক্যাডারের ২১তম ব্যাচের সদস্যরাও দীর্ঘদিন ধরে পঞ্চম গ্রেডে অবস্থান করছেন।

একই অবস্থা এসএসবিতেও। এসএসবির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব। আর বোর্ডের অন্য সদস্যরা হলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, অর্থ বিভাগের সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল। এ কমিটির সদস্য সচিব হলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব। আট সদস্যের এ কমিটির সাতজনই সাধারণত প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য হয়ে থাকেন। উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদে নিয়োগের জন্য এ কমিটিতেও প্রশাসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় সংগত কারণেই প্রশাসন ক্যাডারের পদোন্নতির সুযোগ অন্য ক্যাডারের তুলনায় অনেক বেশি থাকছে। প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যদের জন্য স্বায়ত্তশাসিত সব প্রতিষ্ঠানে একচেটিয়া নিয়োগের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। যার মাধ্যমে সমগ্র প্রশাসনে একটি ভারসাম্যহীন এককেন্দ্রিক পদোন্নতি ও নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু রয়েছে। সাবেক আমলা আকবর আলি খান তার একটি গ্রন্থে দেখিয়েছেন, ২০১৩ সালে ৭০ জন সচিবের মধ্যে ৬১ জনই ছিলেন প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য। অন্য ২৬টি ক্যাডার থেকে মাত্র নয়জন সচিব হতে পেরেছেন এবং ১৮টি ক্যাডার থেকে কেউই সচিব হতে পারেননি। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায় আমলাতন্ত্রের সর্বস্তরের পদোন্নতি ও পদায়নের ক্ষেত্রে এক মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর ও অসাধু প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। অথচ প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগদানের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেয়ার উদ্দেশ্যে যাচাই ও পরীক্ষা পরিচালনাকারী সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হলো সরকারি কর্ম কমিশন বা পিএসসি। কিন্তু পিএসসিকে পাশ কাটিয়ে সাধারণ মানুষের অগোচরে জন-আকাঙ্ক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীতে আমলাতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে চরম নৈরাজ্যকর এ পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। কাজেই বিদ্যমান পদোন্নতি প্রক্রিয়া যে অন্যায়, অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক তা সহজেই অনুমেয়। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের পুরো পদোন্নতি ব্যবস্থার ওপর একটি ক্যাডারের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এর মাধ্যমে আমলাতন্ত্রের সর্বস্তরে দক্ষতা ও বহুমাত্রিক সক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ বাড়ছে। ফলে একদিকে আন্তঃক্যাডার সম্পর্কের ভিত্তি দুর্বল হচ্ছে, অন্যদিকে সরকারি কর্মচারীদের সেবার মান কমে যাচ্ছে।

ডিপিসি ও এসএসবির এ কাঠামো শুধু প্রশাসন ক্যাডারকেই জোরালো করেছে, শক্তিশালী করছে। আর অন্য সব ক্যাডারকে, অন্য সব পেশার কর্মকর্তাকে দুর্বল করে তুলেছে। অথচ রাষ্ট্র শুধু প্রশাসনিক কাজেই চলে না; রাষ্ট্র চলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, প্রকৌশল, পরিসংখ্যান, অর্থনীতি, বিচার, পরিবেশ—সব মিলিয়ে এক বহুবিধ পেশাজীবী কাঠামোর সম্মিলনে।

কাজেই এ অবস্থার পরিবর্তন জরুরি। রাষ্ট্রের জন্য একটি জনবান্ধব আমলাতন্ত্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে ডিপিসি ও এসএসবি বিলুপ্ত করে নতুন পদোন্নতি পদ্ধতি চালু করতে হবে। পদোন্নতির সামগ্রিক প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ, দক্ষতানির্ভর ও বিজ্ঞানসম্মত করে তুলতে হবে। এজন্য পদোন্নতি প্রক্রিয়ার সঙ্গে পিএসসিকে যুক্ত করতে হবে। পিএসসি নির্ধারিত সময়ে পঞ্চম গ্রেড পর্যন্ত পদোন্নতির ক্ষেত্রে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা আয়োজন করবে। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ফলাফল, চাকরির পারফরম্যান্স এবং উদ্ভাবনী দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে নম্বর বণ্টনের মাধ্যমে পদোন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে। পদোন্নতি বোর্ডে পেশাভিত্তিক বৈচিত্র্য নিশ্চিত করতে হবে। আর অবশ্যই উপসচিব পদে প্রশাসন ক্যাডারের জন্য বিদ্যমান ৭৫ শতাংশ কোটা বিলুপ্ত করে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে উন্মুক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে উপসচিব নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। এবং উপসচিব পদে পার্শ্বপ্রবেশের ব্যবস্থা রাখতে হবে। উপসচিবের ঊর্ধ্বতন পদে নিয়াগ ও পদোন্নতির জন্য মেরিট ম্যাট্রিক্স প্রথা চালু করতে হবে। একজন কর্মকর্তার পারফরম্যান্স রিপোর্ট ও কাজের অভিজ্ঞতা, উদ্ভাবনী দক্ষতা, প্রশিক্ষণ, উচ্চতর শিক্ষা ও মৌখিক পরীক্ষার নম্বরের সমন্বয়ে এ মেরিট ম্যাট্রিক্স চালু করতে হবে।

সফিক ইসলাম: শিক্ষক ও লেখক

সূত্র, বণিক বার্তা