যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই ধারণা করা হচ্ছিল পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপের পলিসিতে যাবেন তিনি। যথারীতি সেদিকেই এগোচ্ছেন রিপাবলিকান পার্টি থেকে নির্বাচিত এ প্রেসিডেন্ট। এর আগেও প্রথম মেয়াদে চীন ও ইউরোপের সঙ্গে শুল্কযুদ্ধ শুরু করেছিলেন তিনি। মাঝখানে করোনা মহামারী ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং সর্বশেষ গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের পরিপ্রেক্ষিতে পুরো বিশ্ব অর্থনীতিতেই মন্দা ভাব চলছে। ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত নিয়ে আসছে। এতে চীন, ইইউর পাশাপাশি বাংলাদেশের মতো অর্থনীতিগুলোও ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।

বণিক বার্তার খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশের রফতানি পণ্যে শুল্ক আরোপের হার ৩৭ শতাংশ, যার আওতায় রয়েছে তৈরি পোশাক, জুতাসহ আরো অনেক পণ্য। দেশটিতে বাংলাদেশের মোট রফতানি অর্থমূল্যের ৮৭ শতাংশই তৈরি পোশাক। ফলে এ পণ্যের ওপরই নতুন শুল্কের বেশি প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষকরা। এদিকে ট্রাম্পের ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে শুরু করে একাধিক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।

আমেরিকা থেকে পণ্য আমদানিতে যে দেশ যতটা শুল্ক আরোপ করে, সেই দেশের পণ্যে উপযুক্ত হারে রেসিপ্রোকাল বা পাল্টা শুল্ক আরোপের কথা বলে আসছিলেন ট্রাম্প। ২ এপ্রিল ওয়াশিংটনের স্থানীয় সময় বুধবার বিকাল ৪টায় (বাংলাদেশ সময় বুধবার দিবাগত রাত ২টা) হোয়াইট হাউজে সংবাদ সম্মেলন করে নতুন করে শুল্ক ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। হোয়াইট হাউজের রোজ গার্ডেনে উপস্থিত সাংবাদিকসহ সমবেতদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন ট্রাম্প। দিনটিকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিবস হিসেবে অভিহিত করেন তিনি।

রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ বা পাল্টা শুল্ক আরোপের হার নির্ধারণে নিজস্ব ফর্মুলা ব্যবহার করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। এক্ষেত্রে প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অন্য দেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দেখা হয়েছে। তারপর একটি দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতিকে ওই দেশের রফতানির পরিমাণ দিয়ে ভাগ করা হলে যে সংখ্যাটা পাওয়া যায়, সেই সংখ্যাকে শতকরা হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ওই দেশের আরোপিত শুল্ক বিবেচনা করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৮৩৬ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করেছে বাংলাদেশ। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি ছিল ২২১ কোটি ডলারের। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬১৫ কোটি ডলারের। ৬১৫-কে ৮৩৬ দিয়ে ভাগ করে পাওয়া যায় ৭৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ বা প্রায় ৭৪ শতাংশ। ট্রাম্প প্রশাসন এ হারকে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর বাংলাদেশের আরোপিত শুল্ক হিসেবে বিবেচনা করেছে। এর অর্ধেক হলো ৩৭ শতাংশ, যা বাংলাদেশের ওপর পাল্টা শুল্কহার হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে।

বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের ওপর চলমান শুল্কহার গড়ে ১৫ শতাংশ। এর সঙ্গে যোগ হতে পারে নতুন আরোপ করা ৩৭ শতাংশ। সব মিলিয়ে প্রায় ৫২ শতাংশ শুল্ক বসবে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর। এ রকম হলে বাংলাদেশের পণ্যকে যুক্তরাষ্ট্রের বড় মাত্রার আমদানি শুল্কের মুখোমুখি হতে হবে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হওয়া বাংলাদেশের প্রধান পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে তৈরি পোশাক। এ পণ্যই মোট রফতানি অর্থমূল্যের ৮২ শতাংশ। এছাড়া অন্য পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে হেডগিয়ার, জুতা, অন্যান্য বস্ত্রপণ্য, পালক ও পালক দ্বারা তৈরি সামগ্রী, চামড়াজাত পণ্য, মাছ, শস্যদানা, আসবাব প্রভৃতি।

প্রথাগত অর্থনৈতিক পলিসির বাইরে নেয়া ট্রাম্প প্রশাসনের পদক্ষেপে বিভিন্ন রাষ্ট্র পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপের পলিসির দিকেই যাচ্ছে। চীন, কানাডাসহ ইউরোপের অনেক দেশ মার্কিন পণ্য আমদানিতে উচ্চ শুল্ক আরোপ করেছে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে বড় অংকের বিনিয়োগের রাশ টেনে ধরছে অনেক বড় বড় কোম্পানি। রক্ষণশীল এ নীতি বিশ্ব অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হবে বলে মনে করছেন না বিশ্লেষকরা। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সংরক্ষণবাদী পলিসি আখেরে তার দেশের অর্থনীতির জন্যই কল্যাণকর হবে না বলে মত তাদের।

শুল্ক আরোপের ফলে যুক্তরাষ্ট্রে গাড়ির দাম বাড়বে। তবে এটি এ নীতির একমাত্র নেতিবাচক দিক নয়। উদাহরণস্বরূপ, অটোমোবাইল ও সেমিকন্ডাক্টরের মতো খাতে উৎপাদন খরচের একটি বড় অংশই স্থায়ী বা অবকাঠামোগত বিনিয়োগের সঙ্গে জড়িত। জমি অধিগ্রহণ, কারখানা নির্মাণ এবং অনুমোদন সংগ্রহের মতো খরচ একবার হয়ে গেলে, হঠাৎ করে শুল্ক প্রত্যাহার করা হলে বিনিয়োগকারীরা উল্লেখযোগ্য লোকসানের মুখে পড়তে পারেন। ফলে বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করতে হবে যে এ শুল্ক অন্তত ১০-১৫ বছর পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। সরকার যদি কোনোভাবে এ বার্তা দিতে পারে যে শুল্ক দীর্ঘমেয়াদে বলবৎ থাকবে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন গাড়ির কারখানা স্থাপনের সম্ভাবনা তৈরি হবে এবং শ্রমবাজারে চাহিদা বাড়বে।

তবে এটিকে সবদিক থেকে ইতিবাচক বলা যাবে না। ‘আমেরিকান গাড়িকে আবারো মহান’ করার প্রচেষ্টা যে ফল দেবে তা দীর্ঘমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকরও হতে পারে। শুল্কের সুরক্ষা থাকায় দেশের ভেতরে উৎপাদন খরচ ক্রমাগত বেড়ে যাবে, অন্যদিকে স্বাভাবিকভাবেই কম মজুরির দেশগুলো—যেমন চীন, ভারত, মেক্সিকো ও ইন্দোনেশিয়া—অত্যন্ত সাশ্রয়ী মূল্যে গাড়ি উৎপাদনে সক্ষম হবে। ফলে তারা বিশ্ববাজারে যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে শক্ত অবস্থান নিতে পারবে।

ট্রাম্পের এ মরিয়া উদ্যোগ একেবারেই অতীতে চর্চিত তাদের পলিসির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যুক্তরাষ্ট্র তার টেক্সটাইল শিল্পের পতনের সময় যৌক্তিক নীতি গ্রহণ করেছিল বলে মনে করেন কৌশিক বসুর মতো অর্থনীতিবিদরা। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে যুক্তরাষ্ট্র ছিল বিশ্ব টেক্সটাইল শিল্পের শীর্ষস্থানীয় দেশ, যেখানে তুলা ও উলের মিলগুলো পূর্ণ উৎপাদনশীলতায় চলছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়েও টেক্সটাইল ও পোশাক খাত বেশ সমৃদ্ধ ছিল, বিশেষ করে নর্থ ক্যারোলাইনা অঙ্গরাজ্য ছিল এ শিল্পের কেন্দ্রস্থল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ধনী হতে থাকে এবং শ্রম খরচ বেড়ে যায়। ফলে দেশটি ধীরে ধীরে তার তুলনামূলক সুবিধা হারায় এবং গবেষণা ও উদ্ভাবননির্ভর খাতে গুরুত্ব দেয়—যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ছিল তুলনামূলকভাবে মজবুত। বর্তমানে টেক্সটাইল শিল্পে নেতৃত্ব দিচ্ছে ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ ও তুরস্কের মতো দেশগুলো।

ট্রাম্পের লোকরঞ্জনবাদী পলিসির ভুক্তভোগী হবে তার স্বদেশের মানুষের পাশাপাশি অন্যরাও। বাংলাদেশের জন্য তা আরো বেশি উদ্বেগজনক। আমাদের রফতানিমুখী পণ্য এমনিতেই কম, তার মধ্যে আবার সিংহভাগ নিয়ে রেখেছে তৈরি পোশাক। এ খাতের সিংহভাগ পণ্য আবার রফতানি হয় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো বাজারে রফতানি বাধাগ্রস্ত হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রফতানি পণ্য ও রফতানি গন্তব্যে বৈচিত্র্য আনার দীর্ঘমেয়াদি পলিসি গ্রহণের পাশাপাশি আমাদের স্বল্পমেয়াদে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের জন্য অবশ্যই এটা ইতিবাচক যে সরকারপ্রধান হিসেবে এমন একজন ব্যক্তি আছেন যিনি মার্কিন রাজনৈতিক মহলে অপরিচিত নন। এখানে ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে সুবিধা নেয়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিক কূটনীতিতে আমাদের মুনশিয়ানার পরিচয় দিতে হবে। একই সঙ্গে ভবিষ্যতেও এ ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আমাদের শিল্প ও রফতানিমুখী খাতকে কীভাবে টেকসই করা যায় তার পথ অনুসন্ধান করতে হবে।

সূত্র, বণিক বার্তা