দেশের রাজনীতি এখন নির্বাচনমুখী। প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুসারে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে রোজার আগেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বহুল প্রত্যাশিত এই নির্বাচন। এ ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে নির্বাচন কমিশনকে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। কমিশন প্রস্তুতি কাজ পুরোদমে এগিয়ে নিচ্ছে।

সারা দেশে সম্ভাব্য প্রার্থীদের গণসংযোগ, মনোনয়নের জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে গেছে। গণমাধ্যমে সম্ভাব্য প্রার্থীদের পরিচিতি তুলে ধরা শুরু হয়ে গেছে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় নিয়ে দোদুল্যমানতার অবসান হওয়ায় গত বুধবার রাজধানীসহ সারা দেশে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) বিজয় শোভাযাত্রা করেছে। অর্থাৎ নির্বাচনের আমেজ দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে।

শুধু দেশের ভেতরেই নয়, বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনও তৎপর হয়ে উঠেছে। অনেক দেশই এরই মধ্যে বাংলাদেশের নির্বাচনে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। অনেক দেশ বাংলাদেশে এরপর কারা ক্ষমতায় আসছে, তা নিয়ে হিসাব-নিকাশ শুরু করে দিয়েছে। ভবিষ্যৎ সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরির প্রস্তুতিও নিতে শুরু করেছে অনেক দেশ।

গত মাসে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এক জরিপের ফল প্রকাশ করেছে। ওই জরিপে অংশ নেওয়া তরুণদের ৩৮.৭৬ শতাংশ মনে করে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার দৌড়ে বিএনপি শীর্ষে থাকবে। আর তার প্রতিফলন দেখা যায় বিদেশিদের মধ্যেও।

কালের কণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক ও উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিরা এরই মধ্যে লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। আসছে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে বিএনপি কোন কোন বিষয়ে অগ্রাধিকার দেবে, সে সম্পর্কে জানতে চাচ্ছেন বিদেশি কূটনীতিকরা।

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ, সম্ভাবনা এবং অন্যান্য দিক নিয়েও আলোচনায় আগ্রহ দেখাচ্ছেন বিদেশি প্রতিনিধিরা। জানা গেছে, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন কাতারের একজন মন্ত্রী। এ ছাড়া বৈঠক করেছেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র, কমনওয়েলথ ও উন্নয়ন বিষয়ক দপ্তরের ইন্দোপ্যাসিফিক বিষয়ক পার্লামেন্টারি আন্ডারসেক্রেটারি অব স্টেট, ব্রিটিশ এমপি ক্যাথরিন ওয়েস্ট, ব্রিটিশ কনজারভেটিভ দলের গবেষণা উন্নয়ন বিষয়ক সাবেক পরিচালক রজ ক্যাম্পসেল, ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক, যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ ডি অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন, ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক গোয়েন লুইস প্রমুখ।

নির্বাচনের সময় ঘোষণা এবং প্রস্তুতি শুরু হওয়ায় আশান্বিত ব্যবসায়ীমহলও। দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার নেতিবাচক প্রভাব তাদের উদ্বেগ অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছিল। অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, এর ফলে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে, আর ব্যবসা ও বিনিয়োগের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অত্যন্ত জরুরি।

রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, নির্বাচন, সংস্কার, বিচার এবং আরো কিছু বিষয়ে কয়েকটি দলের কিছুটা আপত্তি বা ভিন্নমত থাকলেও তা নির্বাচনী জোয়ারে বাধা হবে না। সামর্থ্য আছে এমন সব দলই দ্রুত নির্বাচনী কাফেলায় যোগ দেবে। আমরা আশা করি, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে অত্যন্ত সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক এবং এটি বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।

আইসিডিডিআরবির এক সাম্প্রতিক গবেষণা প্রতিবেদন বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এক গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। এই গবেষণায় উঠে এসেছে যে ঢাকার দুই থেকে চার বছর বয়সী ৯৮ শতাংশ শিশুর রক্তে সিসার মাত্রা আশঙ্কাজনক। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) নির্ধারিত নিরাপদ মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি সিসা এই শিশুদের শরীরে পাওয়া গেছে, যা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এই নীরব ঘাতক শুধু শিশুদের বুদ্ধিমত্তা ও শারীরিক বিকাশে বাধা দিচ্ছে না, বরং সামগ্রিকভাবে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেই দুর্বল করে দিচ্ছে।

গবেষণায় আরো দেখা গেছে, যেসব শিশু সিসানির্ভর শিল্প-কারখানার কাছাকাছি বসবাস করে, তাদের রক্তে সিসার মাত্রা অন্যদের তুলনায় ৪৩ শতাংশ বেশি। এর পাশাপাশি ঘরের ভেতরের ধোঁয়া, দূষিত ধূলিকণা, সিসাযুক্ত প্রসাধনসামগ্রী এবং রান্নার পাত্র থেকেও শিশুরা সিসার সংস্পর্শে আসছে। এটি কেবল ঢাকার সমস্যা নয়, ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, সিসাদূষণে আক্রান্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে, যেখানে প্রায় তিন কোটি ৬০ লাখ শিশু উচ্চমাত্রার সিসা নিয়ে জীবনধারণ করছে। এই ভয়াবহ চিত্র আমাদের সামনে এক কঠিন বাস্তবতা তুলে ধরে : সিসাদূষণ একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য সংকট, যা আমাদের মনোযোগের বাইরে থেকে যাচ্ছে।

এই সংকট মোকাবেলায় আইসিডিডিআরবির পূর্ববর্তী একটি সফল উদ্যোগ আমাদের জন্য আশার আলো দেখাচ্ছে। ২০১৯ সালে হলুদে ভেজাল হিসেবে ব্যবহৃত লেড ক্রোমেট চিহ্নিত করার পর বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের নেতৃত্বে সচেতনতামূলক কার্যক্রম এবং আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়। এই সাফল্যের ঘটনা প্রমাণ করে যে যদি সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালানো যায়, তবে সিসাদূষণের মতো গুরুতর সমস্যাও প্রতিরোধ করা সম্ভব।

এখন সময় এসেছে এই সাফল্যের পুনরাবৃত্তি করার।

সিসা-এসিড ব্যাটারি কারখানা, সিসা গলানো বা পোড়ানো হয় এমন সব শিল্প-স্থাপনা এবং সিসাযুক্ত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া আবশ্যক। এসব প্রতিষ্ঠানকে হয় নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিতে হবে অথবা দূষণ নিয়ন্ত্রণের অত্যাধুনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য করতে হবে। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের মধ্যে সিসাদূষণের কারণ ও এর মারাত্মক প্রভাব সম্পর্কে ব্যাপক সচেতনতা তৈরি করা জরুরি।

ড. তাহমিদ আহমেদ যথার্থই বলেছেন, ‘সিসা বিষক্রিয়া নীরবে আমাদের শিশুদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা কেড়ে নিচ্ছে।’ শিশুদের সুস্থ ও বুদ্ধিমান হয়ে বেড়ে ওঠার অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের পাশাপাশি আমাদের সবার নৈতিক দায়িত্ব।

এটি কেবল একটি স্বাস্থ্যগত সমস্যা নয়, বরং দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের পথে এক বড় বাধা। তাই শিশুদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষায় এখনই পদক্ষেপ না নিলে এর দায়ভার আমাদের সবাইকেই বহন করতে হবে।

সূত্র, কালের কন্ঠ