জাতীয় নাগরিক পার্টির যুব সংগঠন জাতীয় যুবশক্তির সম্মেলনে দলটির একজন নেতা যে ভাষায় পুরো সাংবাদিক সমাজকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন, তা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। তাঁর অজানা নয় যে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে অন্যান্য শ্রেণি ও পেশার মানুষের মতো সাংবাদিক সমাজও সাধ্যমতো ভূমিকা পালন করেছে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে তৎকালীন সরকার ইন্টারনেট-সেবা বন্ধ করে দিলে সংবাদমাধ্যম, বিশেষ করে মুদ্রিত পত্রিকা ও অনলাইনই ছিল আন্দোলনের প্রধান সহায়, যা সভা-সেমিনারে নেতারা স্বীকারও করেছেন।
গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পর সংবাদমাধ্যম যখন সরকার ও বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতা ও অসংগতির খবর প্রকাশ করছে, তখনই তাদের বিরুদ্ধে মহলবিশেষের ঢালাও অভিযোগ আমাদের উদ্বিগ্ন করে। সংশ্লিষ্টদের এটাও জানানো দরকার যে কেবল জুলাই অভ্যুত্থান নয়, আওয়ামী লীগ সরকারের প্রায় পুরো মেয়াদেই অনেক সম্পাদক-সাংবাদিক মামলা-হামলার শিকার হয়েছেন, সত্য প্রকাশের দায়ে অনেককে জেল খাটতে হয়েছে। আবার সাংবাদিকদের একাংশ ক্ষমতাসীনদের অন্যায্য কাজকে সমর্থন করেছেন, সেটাও অসত্য নয়।
জাতীয় যুব সম্মেলনে ‘গণমাধ্যম গণ-অভ্যুত্থানে জড়িতদের চরিত্রহননের চেষ্টা করছে’ এবং শেখ হাসিনার স্বৈরাচার আমলের মতো ‘গোয়েন্দা সংস্থার মুখপত্র’ হিসেবে কাজ করছে বলে এনসিপির নেতা যে মন্তব্য করেছেন, সেটা ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যমূলক। তাঁর ঢালাও ও অনাকাঙ্ক্ষিত অভিযোগের প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে সম্পাদক পরিষদ। একই সঙ্গে তারা সব পক্ষকে তথ্যভিত্তিক ও দায়িত্বশীল বক্তব্য দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত যেকোনো খবরে ভুল বা অসত্য তথ্য থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তার প্রতিবাদ করতে পারেন। সংবাদমাধ্যম তা প্রকাশ করতে বাধ্য। সেই প্রতিবাদ প্রকাশেও কেউ সন্তুষ্ট না হলে প্রেস কাউন্সিলে মামলা করতে পারেন। কিন্তু এনসিপি নেতা সেসব না করে যেভাবে সাংবাদিকদের আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন, সেটা কেবল গণতান্ত্রিক রীতির পরিপন্থী নয়, স্বাধীন সাংবাদিকতার ওপরও হুমকি বলে মনে করি।
সম্পাদক পরিষদের বিবৃতিতে যথার্থই বলা হয়েছে, অভ্যুত্থান চলাকালে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু গণমাধ্যমের সাহসী প্রতিবেদনে জনগণের সামনে উঠে এসেছে। বিশেষ করে অধিকাংশ মুদ্রণ গণমাধ্যম নির্ভীকভাবে তথ্য তুলে ধরে গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষে জনমত গঠনে বিশেষ অবদান রেখেছে এবং একই সঙ্গে অনেক ভয়ভীতির মধ্যে কাজ করতে হয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা হলো কেউ তিক্ত সত্য কথা শুনতে চান না। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের লক্ষ্য ছিল একটি বৈষম্যহীন ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠন, যেখানে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সমুন্নত থাকবে। অতীতের স্বৈরাচারী শাসকের মতো কেউ তার টুঁটি চেপে ধরবে না। অথচ আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, ভিন্ন আদলে হলেও সেই অপপ্রয়াস চলছে।
এর আগে সংবাদপত্রের মালিকদের সংগঠন নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) একটি পত্রিকা অফিস দখলের ঘটনায় প্রতিবাদ ও উদ্বেগ প্রকাশ করলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। আমরা মনে করি, নোয়াবের বিবৃতির কোন অংশ নিয়ে তাদের আপত্তি, সেটা তাদের স্পষ্ট করা উচিত ছিল। অঘটন বা অন্যায় যার দ্বারাই সংঘটিত হোক না কেন, প্রতিকারের দায়িত্ব সরকারেরই।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং নোয়াবের বিবৃতির প্রতিবাদ করলেও সরকার গঠিত গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন সম্পর্কে নীরব থেকেছে। সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরা যদি সাংবাদিকদের অপরাধ হয়, তাহলে বাংলাদেশে সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ আছে বৈকি।