যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা পাল্টা শুল্ক নিয়ে দর-কষাকষিতে পিছিয়ে পড়ার কারণে ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের মধ্যে যে গভীর শঙ্কা ও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে তা নিরসন করতে হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদে যে শুল্কযুদ্ধ শুরু করেছেন, এর ব্যাপ্তি শুধু বাণিজ্যের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নেই, সেটি একই সঙ্গে অরাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ভূকৌশলগত বিষয়। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করতে না পারায় প্রতিযোগী অনেক দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুবিধাজনক শর্তে চুক্তি করতে পারলেও বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে রয়েছে।

বাস্তবতা হলো, এই মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তিতে না পৌঁছাতে পারলে আগের ১৫ শতাংশের সঙ্গে নতুন আরও ৩৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে দেশটির বাজারে আমাদের প্রবেশ করতে হবে। নিশ্চিতভাবেই আমাদের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে এর বড় অভিঘাত এসে লাগবে। সরকার শেষ মুহূর্তে এসে উদ্যোগ নেওয়ায় তাতে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটা রক্ষিত হবে, তা নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

রাজধানীর একটি হোটেলে রোববার (২০ জুলাই) প্রথম আলোর ‘যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক: কোন পথে বাংলাদেশ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অর্থনীতিবিদ, নিরাপত্তা বিশ্লেষক, সাবেক সচিব, শিল্পোদ্যোক্তা ও বাণিজ্য সংগঠনের শীর্ষ নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের হার কমাতে সরকারের উদ্যোগের সমালোচনা করেছেন। পাল্টা শুল্ক ঘোষণা করে ট্রাম্প প্রশাসন দর–কষাকষির জন্য তিন মাস সময় দিলেও সেই সময়কে কাজে লাগানো যায়নি। এর কারণ হলো সরকার সময়মতো প্রস্তুতি নিতে পারেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করতে সরকার অহেতুক সময় নষ্ট করেছে এবং ভুল লোক দিয়ে ভুলভাবে এগিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) সঙ্গে দুই দফা আলোচনা হলেও পাল্টা শুল্ক কমানোর যথাযথ কর্তৃপক্ষ যে ট্রাম্প প্রশাসন, সেটা বুঝে উঠতেই সরকারের সময় লেগেছে। অনেক দেশ লবিস্ট নিয়োগ করে সফলতা পেলেও বাংলাদেশ সেটা করেনি।

সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ, বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ, নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞসহ গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনদের সঙ্গে আগে থেকে কোনো আলোচনা করা হয়নি। অথচ দর–কষাকষির প্রক্রিয়ার সঙ্গে গত এপ্রিল মাস থেকে বেসরকারি খাতকে যুক্ত করার অনুরোধ জানিয়ে আসছিলেন ব্যবসায়ীরা। এমনকি লবিস্ট নিয়োগের পরামর্শও তাঁরা দিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার সেই পথে হাঁটেনি। এরপর আবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট (প্রকাশ না করার চুক্তি) করায় কী নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছিল, সে বিষয়ে পুরো অন্ধকারে থেকেছেন তাঁরা।

শুল্ক নিয়ে চুক্তির কথা বলা হলেও এর সঙ্গে রাজনীতি, অর্থনীতি ও ভূরাজনীতি জড়িত রয়েছে। বঙ্গোপসাগরের প্রবেশমুখে অবস্থানের কারণে ভূরাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান যে জটিল, সেটি একটি বড় বাস্তবতা। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ভূরাজনৈতিক ও কৌশলগত প্রতিযোগিতা এবং চীন ও ভারতের আঞ্চলিক প্রতিযোগিতার কারণে বাংলাদেশের সামনে ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জটা দিন দিন জটিল হয়ে উঠছে। এ বাস্তবতায় ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে দেখতে না পারাটা শুধু দুঃখজনকই নয়, সরকারের সক্ষমতা ও সমন্বয় দক্ষতা নিয়েও বড় প্রশ্নের জন্ম দেয়। এই গাফিলতির খেসারত ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষকে কেন দিতে হবে?

এটা ঠিক যে কোনো দর–কষাকষি শেষ মুহূর্তে শুরু করলে এর ফল নিজেদের স্বার্থের অনুকূলে নিয়ে আসাটা খুবই কঠিন। দেরিতে হলেও সরকার অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করেছে। আমরা আশা করি, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে সক্রিয়ভাবে উদ্যোগ নেওয়া হবে এবং বাণিজ্য, কূটনীতি, নিরাপত্তা ও অর্থনীতি খাতের অংশীজনদের নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে একটা সন্তোষজনক ফল আনা সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ নেই। কেননা তাতে বহুমুখী সংকটে পড়বে দেশ।

সূত্র, প্রথম আলো