উন্নয়নশীল দেশসমূহের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করিয়া শান্তি, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার দিকে পরিচালিত করিবার মতো রাষ্ট্রনায়কের বড়ই অভাব। ঔপনিবেশিকতার নাগপাশ হইতে স্বাধীনতা অর্জনকারী এই সকল দেশে পক্ষবিপক্ষ শক্তি ও বিভাজনের গভীর রেখা থাকিবে ইহাই স্বাভাবিক। এই সকল দেশে আনফিনিশড রেভ্যুলিউশন বা অসমাপ্ত বিপ্লবের রেশ বিরাজমান। বিভিন্ন সময় গণআন্দোলনের হাত ধরিয়া রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর যেইখানে সকলকে ঐক্যবদ্ধ করিয়া জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতির কথা চিন্তা করা প্রয়োজন, সেইখানে বিভাজন, হানাহানি, মারামারিসহ প্রতিহিংসাপরায়ণতাই সার হয়। এই সকল দেশে তাই দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়কের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। জাতিকে যদি এক করা না যায়, তাহা হইলে তাহা হইয়া উঠে সমূহ বিপদের কারণ। এইখানে আমরা দক্ষিণ আফ্রিকার দৃষ্টান্ত তুলিয়া ধরিতে পারি।
দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবিদিত বর্ণবাদবিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন একজন সত্যিকারের রাষ্ট্রনায়ক ও বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ। তিনি বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামের কারণে সুদীর্ঘ ২৭ বৎসর একটানা কারা অন্তরিন ছিলেন; কিন্তু তিনি যখন মুক্তিলাভ করিয়া সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশটির প্রেসিডেন্ট হন, তখন যাহার হস্তে তিনি নিপীড়িত হইয়াছিলেন সেই এফ ডব্লিউ ডি ক্লার্ককে তিনি ডেপুটি প্রেসিডেন্ট পদে মনোনীত করেন। বিস্ময়কর ব্যাপার হইল, ইহার পূর্বে ক্লার্ক ছিলেন সেই দেশটির প্রেসিডেন্ট ১৯৮৯-১৯৯৪ সাল পর্যন্ত। অর্থাৎ জাতীয় স্বার্থ ও সমঝোতার কারণে নেলসন ম্যান্ডেলা যেমন বিরোধী নেতার প্রতি উদারতার পরিচয় দেন, তেমনি শ্বেতাঙ্গ নেতা এফ ডব্লিউ ডি ক্লার্ক প্রেসিডেন্ট হইতে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে নামিয়া যাইতে কুণ্ঠিত বোধ করেন নাই। অতীত বিবাদবিসংবাদ ভুলিয়া গিয়া ধর্মবর্ণনির্বিশেষে সকলকে লইয়া দেশ ও জাতি গঠনে নূতন ব্রত গ্রহণের জন্যই তাহারা শান্তির পক্ষে ছিলেন এমন আপসকামী। নেলসন ম্যান্ডেলার এই রিকনসিলিয়েশন বা জাতিগত পুনর্মিলনের প্রক্রিয়া পৃথিবীর ইতিহাসে প্রশংসিত ও বহুল আলোচিত এক অনন্য ঘটনা। শুধু তাহাই নহে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রান্স ও জার্মানিতে একইভাবে রিকনসিলিয়েশন প্রক্রিয়াকে আগাইয়া লওয়া হয় এবং যুদ্ধের ভয়াবহ নৃশংসতার স্মৃতি ও গভীর শোককে পাশ কাটাইয়া তাহারা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করিয়া তোলেন। ফলে তাহারা ক্রমশ উন্নতি ও সমৃদ্ধির দিকে অগ্রসর হইতে সক্ষম হন।
কিন্তু উন্নয়নশীল দেশসমূহে জাতীয় ঐক্যকে গুরুত্ব না দেওয়ায় দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীরা বারংবার তাহার সুযোগ গ্রহণ করিয়া থাকে। সেই বিভক্তির জেরে দশকের পর দশক সেই সকল দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি বারংবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অথচ যুদ্ধবিগ্রহ, সংঘাত-সহিংসতা বা যে কোনো বড় ধরনের বিরোধ-বিপ্লব শেষে শান্তি প্রতিষ্ঠাকেই অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। লক্ষ্য অর্জনের পর বিজয়ী শক্তির প্রথম কর্তব্য হইল দেশে নিয়মশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি জাতীয় ঐক্যকে সংহত করা। ইহার অর্থ এই নহে যে, যাহারা খুন-গুম-ধর্ষণ, লুটপাট, মানবতাবিরোধী অপরাধ, অর্থপাচার ইত্যাদি গুরুতর অন্যায়-অপকর্মের সহিত জড়িত ছিল তাহাদের সকলকে মাফ করিয়া দেওয়া হইবে। তাহাদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করিয়া ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা আবশ্যক; কিন্তু যে কোনো বিজয়ের পর জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করিতে না পারিলে সেই দেশটিতে সংঘাত-সহিংসতা লাগিয়াই থাকে।
নেলসন ম্যান্ডেলা যেইভাবে বর্ণবাদের মতো একটি বৈশ্বিক সমস্যার সমাধান করিয়াছিলেন, সেইভাবে যত সমস্যা থাকুক, জাতীয় ঐক্য গঠনে উন্নয়নশীল দেশসমূহের সচেষ্ট হওয়া উচিত। এই জন্য প্রয়োজনে গঠন করা দরকার ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন। এই সকল দেশে এমন রাষ্ট্রনায়ক দরকার, যাহারা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণ ও দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় স্বার্থের কথা চিন্তা করিবেন এবং সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠিয়া দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণে আত্মনিয়োগ করিবেন। বিশ্বের জটিল ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করিয়া ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রাখিয়া যাইবেন একটি উন্নত ও স্থিতিশীল দেশ। জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখিবার এই কাজটি কঠিন বটে, তবে তাহা অসম্ভব নহে; কিন্তু দুঃখের বিষয়, সেই নেতৃত্ব ও গুণাবলি তৃতীয় বিশ্বের নেতাদের মধ্যে পরিলক্ষিত ও বিকশিত হইতেছে না। তাই স্বাধীনতা লাভের পর অর্ধশতাব্দীকাল অতিবাহিত হইয়া গেলেও অনেক দেশে এখনো বলা হইতেছে 'এই আজাদি ঝুটা হায়'। অতএব, এই সকল দেশে জাতীয় ঐক্য গড়িতে হইলে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের উদার মনমানসিকতার কোনো বিকল্প নাই।