বাংলাদেশের গত সাড়ে পনের বছরের রাজনৈতিক অর্থনীতির দিকে তাকালে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে ওঠে, এদেশে যে ফ্যাসিবাদী কাঠামো গড়ে উঠেছে, তার পেছনে শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতার দম্ভ নয়, বরং একটি সুসংগঠিত অলিগার্কিক সিন্ডিকেটের কৌশলগত তৎপরতা কাজ করেছে। এই সিন্ডিকেটের অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ার হলো দেশের কিছু গণমাধ্যম। প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন, সমকাল থেকে শুরু করে সময় টিভি, ৭১ টিভি, ইনডিপেনডেন্ট টিভি এসব মিডিয়া হাউস শুধু সংবাদ পরিবেশনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে নয়, বরং একটি নির্দিষ্ট কর্পোরেট-রাজনৈতিক অলিগার্কির স্বার্থরক্ষাকারী যন্ত্র হিসেবে কাজ করেছে। গণতন্ত্রের কবরস্থানে কর্পোরেট সিন্ডিকেটের বিজয়োৎসব যে ফ্যাসিবাদী কাঠামো নির্মাণ করেছে, তার সাংস্কৃতিক ও মতাদর্শিক ভিত্তি তৈরিতে এই মিডিয়াগুলোর ভূমিকা নিঃসন্দেহে ইতিহাসের ঘৃণ্যতম অধ্যায়।
মিডিয়া-অলিগার্কি সংযোগের শিকড় ও অর্থনৈতিক স্বার্থের জটিল জাল: বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর মালিকানা কাঠামো বিশ্লেষণ করলে একটি স্পষ্ট চিত্র ফুটে ওঠে। অধিকাংশ গণমাধ্যমই বৃহৎ পুঁজিপতিদের নিয়ন্ত্রণে, যারা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, খাদ্য ও নিত্যপণ্য আমদানি ও সরবরাহ, পোশাকশিল্প, ওষুধশিল্প, বিমা, গ্যাস ও বিদ্যুৎখাত এবং আবাসন ব্যবসার মতো বিভিন্ন অর্থনৈতিক খাতে জড়িত। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের ২০২১ সালের গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৪৮টি বড় মিডিয়ার মালিকানা মূলত ৩২টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের হাতে, যা বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্কিত। তবে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, গণমাধ্যমের মালিকদের তালিকায় বেশ কয়েকজন সাংবাদিকও রয়েছেন। সাংবাদিকদের বেশির ভাগ রাজনৈতিক কারণে লাইসেন্স পেয়েছেন এবং পরে অন্য বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করে প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। এর ফলে রাজনৈতিক প্রভাব গণমাধ্যমের সংবাদ নীতি নির্ধারণে একটি বড় ভূমিকা রাখে। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার ট্রান্সকম গ্রুপের অধীনে মিডিয়াস্টার লিমিটেড দ্বারা প্রকাশিত হয়, যার সাথে সামিট গ্রুপসহ বিভিন্ন কর্পোরেট হাউসের গভীর আর্থিক সম্পর্ক রয়েছে। কালের কণ্ঠ ও বাংলাদেশ প্রতিদিনসহ অন্তত সাতটি গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ বসুন্ধরা গ্রুপের মতো বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর হাতে। যুগান্তর ও যমুনা টেলিভিশনের মালিকানায় রয়েছে যমুনা গ্রুপ। চ্যানেল ২৪ ও দৈনিক সমকাল আজাদের হা-মীম গ্রুপের মালিকানাধীন; স্কয়ার গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে মাছরাঙা টিভি। গত কয়েক বছরে ব্যাংক লুটের অভিযোগে পরিচিতি এস আলম গ্রুপের সাইফুল আলমও একুশে টিভিসহ বেশ কয়েকটি মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত। জেমকন গ্রুপের বাংলা ও ঢাকা ট্রিবিউন, রূপায়ন গ্রুপের দেশ রূপান্তর, গাজী গ্রুপের গাজী টিভি, কর্ণফুলি গ্রুপের দেশ টিভি ও ভোরের কাগজ, বেঙ্গল গ্রুপের আরটিভি, সিটি ও মেঘনা গ্রুপের সময় ও ৭১ টিভির মালিকানায় রয়েছে প্রভাবশালী রাজনৈতিক-ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ক, আর ইনডিপেনডেন্ট টিভির মালিকানা কাঠামো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বেক্সিমকোর মতো বৃহৎ পুঁজিপতি গোষ্ঠীর প্রভাব। এই মালিকানা কাঠামোর ফলে যা ঘটেছে তা হলো, মিডিয়াগুলো তাদের কর্পোরেট মালিকদের ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় সংবাদ নীতি নির্ধারণ করেছে। এই গভীর অর্থনৈতিক জাল মিডিয়াকে নিছক সংবাদ পরিবেশক থেকে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক হাতিয়ারে রূপান্তরিত করেছে। এর ফলে নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার আদর্শ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং গণমাধ্যমগুলো হয়ে উঠেছে অলিগার্কির প্রচারযন্ত্র।
ফ্যাসিবাদী কাঠামো নির্মাণে মিডিয়ার কৌশলগত ভূমিকা: বাংলাদেশে যে ফ্যাসিবাদী কাঠামো গড়ে উঠেছে, তার চারটি প্রধান স্তম্ভ রয়েছে: রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, অর্থনৈতিক একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ, প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ এবং মতাদর্শিক আধিপত্য। এই চতুর্থ স্তম্ভ, মতাদর্শিক আধিপত্য, নির্মাণে মিডিয়ার ভূমিকা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, এই মিডিয়াগুলো ‘উন্নয়নের ন্যারেটিভ’ তৈরি করে জনমানসে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করেছে যে, গণতান্ত্রিক অধিকার ও মানবাধিকারের চেয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মেগা প্রকল্পের বর্ণাঢ্য প্রচারণা, প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে অতিরঞ্জিত উপস্থাপনা এবং ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ হিসেবে বাংলাদেশের ইমেজ প্রচারের মাধ্যমে তারা জনগণের মধ্যে এক ধরনের মানসিক অসাড়তা তৈরি করেছে। এর ফলে সরকারের সমালোচনাকে দেশের উন্নয়নের বিরুদ্ধে পরিচালিত কাজ হিসেবে দেখানোর প্রবণতা তৈরি হয়েছে। দ্বিতীয়ত, বিরোধী রাজনীতি ও ভিন্নমতের দুর্বৃত্ততায়ন প্রক্রিয়ায় এই মিডিয়াগুলো অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। যেকোনো বিরোধী আন্দোলনকে ‘জঙ্গিবাদের সাথে সংশ্লিষ্ট’, ‘দেশের উন্নয়নের শত্রু’ বা ‘বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ’ হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। এর ফলে জনমানসে বিরোধী রাজনীতির প্রতি এক ধরনের ভীতি ও অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। ভিন্নমতের কণ্ঠকে রুদ্ধ করতে এবং সরকারবিরোধী আন্দোলনকে দুর্বল করতে এই কৌশল অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, নির্বাচন-পূর্ববর্তী সময়ে বিভিন্ন বিরোধী দলের আন্দোলনকে বিশৃঙ্খল বা নৈরাজ্যমূলক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা তাদের জনসমর্থন কমাতে সাহায্য করেছে। তৃতীয়ত, রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের স্বাভাবিকীকরণে এই মিডিয়াগুলো প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছে। গুম, খুন, নির্যাতনের ঘটনাগুলোকে হয় এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, অথবা এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যাতে মনে হয়, এগুলো ‘আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার’ অংশ। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, রাজনৈতিক কর্মীদের উপর হামলা বা ভিন্নমত দমনের ঘটনাগুলোকে সামান্যীকরণ করা হয়েছে, যা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার জন্য এক ধরনের অলিখিত সমর্থন জুগিয়েছে। এই নীরবতা বা কৌশলগত উপস্থাপন জনমনে এক ধরনের হতাশা ও অসহায়ত্ব তৈরি করেছে, যেখানে মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে, এই ধরনের দমন-পীড়নই স্বাভাবিক।
কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষায় মিডিয়ার অস্ত্রায়ন: বাংলাদেশের অলিগার্কিক কাঠামোর মূল চালিকাশক্তি হলো কয়েকটি বৃহৎ কর্পোরেট গ্রুপ। এই গ্রুপগুলো শুধু নিজ নিজ ব্যবসায়িক ক্ষেত্রেই একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করেনি, বরং রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায়ও গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। এই প্রভাব বিস্তারের প্রধান মাধ্যম ছিল নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া। কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষার এই প্রক্রিয়ায় মিডিয়াগুলো যে কৌশল অবলম্বন করেছে তা হলো:
১. সিলেক্টিভ রিপোর্টিং: কর্পোরেট দুর্নীতি, অর্থপাচার, একচেটিয়া ব্যবসার ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে নীরবতা পালন। বাংলাদেশের ব্যাংক খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হওয়ার ঘটনা বা বড় বড় ঋণখেলাপির তালিকা নিয়ে গণমাধ্যমগুলোতে খুব কমই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দেখা যায়। যদি কিছু প্রকাশিতও হয়, তা সাধারণত উপরিস্তরের তথ্যমাত্র, মূল হোতাদের নাম প্রায়শই অপ্রকাশিত থাকে।
২. গ্ল্যামারাইজেশন: কর্পোরেট কর্তাদের ‘সফল উদ্যোক্তা’, ‘অর্থনীতির চালিকাশক্তি’ হিসেবে উপস্থাপন। প্রায়শই দেখা যায়, যারা বিপুল অর্থ পাচার বা দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন, তাদেরকেই সমাজের ‘আইকন’ হিসেবে তুলে ধরা হয়, যা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে এবং দুর্নীতির প্রতি এক ধরনের স্বাভাবিকীকরণ তৈরি করে।
৩. ক্যারেক্টার অ্যাসাসিনেশন: যেকোনো বিরোধিতাকারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অদক্ষতা বা ব্যর্থতার অভিযোগ এনে তাকে জনমানসে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়। যারা কর্পোরেট বা সরকারি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, তাদের বিরুদ্ধে প্রায়শই মিথ্যা বা বানোয়াট অভিযোগ আনা হয়েছে এবং মিডিয়া সেগুলোকে ফলাও করে প্রচার করেছে। এর উদ্দেশ্য হলো, জনমনে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করা এবং অন্যদের একই ধরনের প্রতিবাদ থেকে বিরত রাখা।
নিয়ন্ত্রিত বিতর্ক ও মতামতের একরঙাকরণ: বাংলাদেশের মূলধারার মিডিয়ায় যে ‘বিতর্ক’ বা ‘মতবিনিময়’ দেখা যেত, তা ছিল সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত। টকশো, সম্পাদকীয়, বিশ্লেষণধর্মী অনুষ্ঠানে যারা অংশগ্রহণ করতেন, তাদের একটি নির্দিষ্ট মতাদর্শিক সীমানার বাইরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। প্রথম আলোর সম্পাদকীয় নীতি, ডেইলি স্টারের বিশ্লেষণ, ৭১ ও সময় টিভির টকশো, সবখানেই একই ন্যারেটিভ: সরকার ভালো কাজ করছে, উন্নয়ন হচ্ছে, বিরোধীরা অশান্তি সৃষ্টি করছে, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র রয়েছে। এই একপক্ষীয় প্রচারণার ফলে জনমানসে একটি মিথ্যা ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, এই মিডিয়াগুলো কখনোই গভীর অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ করেনি। আয় বৈষম্য, খেলাপি ঋণ, ব্যাংক খাতের সংকট, কর ফাঁকি, অর্থপাচার, এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে কোনো অনুসন্ধানী রিপোর্ট বা গভীর বিশ্লেষণ ছিল না। বরং এসব বিষয়ে কৌশলে নীরবতা পালন করা হয়েছে। যখনই দেশের অর্থনীতির দুর্বল দিকগুলো নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, তখনই মিডিয়াগুলো কৌশলে সেগুলোকে এড়িয়ে গিয়েছে অথবা এমনভাবে উপস্থাপন করেছে, যাতে সমস্যাগুলো সাধারণ মানুষের চোখে ধরা না পড়ে। এর ফলে, সাধারণ মানুষ দেশের প্রকৃত অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারেনি এবং বিদ্যমান অলিগার্কিক শোষণ অব্যাহত থেকেছে। গণমাধ্যমগুলোর এই আচরণ দেশের সুশীল সমাজ ও বুদ্ধিজীবী মহলের মধ্যেও এক ধরনের বিভেদ তৈরি করেছে। যারা ক্ষমতাসীন অলিগার্কির বিরুদ্ধে কথা বলতে চেয়েছেন, তাদের কণ্ঠস্বর হয় অবদমিত করা হয়েছে, নয়তো তাদের কথাকে গুরুত্বহীন করা হয়েছে। অন্যদিকে, যারা অলিগার্কির স্বার্থরক্ষায় কাজ করেছেন, তাদেরকেই বেশি প্রচার ও সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
জনমানসে ভীতি ও অসহায়ত্বের সংস্কৃতি: মিডিয়ার এই একপক্ষীয় প্রচারণার ফলে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে একটি বিশেষ ধরনের মানসিকতা গড়ে উঠেছে। এই মানসিকতা তৈরির পেছনে মিডিয়ার ভূমিকা ছিল অপরিসীম। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এই একই বার্তা প্রচার করে তারা জনমানসে একটি নিষ্ক্রিয় গ্রহণশীলতা তৈরি করেছে। এর ফলে সমাজের একটি বিশাল অংশ নীরব হয়ে গেছে এবং নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়া থেকে বিরত থেকেছে। তারা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে:
১. বর্তমান ব্যবস্থার বিকল্প নেই: গণমাধ্যমগুলো এমনভাবে পরিবেশ তৈরি করেছে, যেখানে সরকারের বাইরে অন্য কোনো কার্যকর রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক মডেল নেই বলে মনে হয়। এর ফলে জনগণ বিশ্বাস করে যে, বর্তমান শাসনব্যবস্থাই একমাত্র পথ এবং এর কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়।
২. যেকোনো পরিবর্তনের চেষ্টা বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীলতা আনবে: যখনই কোনো পরিবর্তনের কথা উঠেছে, তখনই মিডিয়াগুলো সম্ভাব্য বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীলতার ভয় দেখিয়েছে। এর ফলে মানুষ বিদ্যমান ব্যবস্থার প্রতি এক ধরনের আনুগত্য দেখাতে বাধ্য হয়েছে, যদিও তারা মনে মনে অসন্তুষ্ট ছিল।
৩. বিরোধী রাজনীতি মানেই সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য: বিরোধী দলগুলোকে ক্রমাগত নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করার ফলে জনগণের মনে তাদের প্রতি এক ধরনের ঘৃণা ও ভয় তৈরি হয়েছে। যেকোনো আন্দোলনকে ‘নাশকতা’ বা ‘সন্ত্রাস’ হিসেবে দেখানো হয়েছে, যা মানুষকে প্রতিবাদের অধিকার থেকে দূরে রেখেছে।
৪. সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা অদেশপ্রেম: সরকার বা ক্ষমতাসীন দলের সমালোচনাকারীদের প্রায়শই ‘দেশবিরোধী’ বা ‘বিদেশি এজেন্ট’ হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। এর ফলে, সমালোচনা বা প্রশ্ন করাকে এক ধরনের ‘দেশদ্রোহিতা’ হিসেবে দেখা হয়েছে, যা স্বাধীন চিন্তা ও মতপ্রকাশের পথ রুদ্ধ করেছে।
মানবসম্পদ উন্নয়নে বাধা ও তথ্যের অপপ্রয়োগ: বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো মানবসম্পদের অনুন্নয়ন। একটি শিক্ষিত, সচেতন ও সমালোচনামূলক চিন্তাশক্তিসম্পন্ন জনগোষ্ঠী অলিগার্কিক কাঠামোর জন্য সবসময়ই হুমকিস্বরূপ। তাই এই মিডিয়াগুলো সুকৌশলে এমন একটি তথ্য পরিবেশ তৈরি করেছে, যা মানুষের চিন্তাশক্তিকে অবদমিত রাখে। সংবাদের নামে গুজব, বিশ্লেষণের নামে প্রোপাগান্ডা, শিক্ষার নামে প্রচারণাÑ এই সবকিছু মিলে একটি বিকৃত তথ্য পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এর ফলে নতুন প্রজন্ম সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং গুণগত শিক্ষার অভাবের পাশাপাশি, মিডিয়ার এই ভূমিকা মানুষকে আরও অন্ধকারাচ্ছন্ন করেছে। যখন একটি দেশের গণমাধ্যম সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্য পরিবেশনে ব্যর্থ হয়, তখন তা জনগণের মননে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং তাদের মধ্যে সমালোচনামূলক চিন্তার বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। এই তথ্যের অপপ্রয়োগ মানবসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, দক্ষ ও কার্যকর মানবসম্পদ গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন সঠিক তথ্য, জ্ঞান এবং স্বাধীন চিন্তা করার ক্ষমতা। কিন্তু নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া এই প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে, যা দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
প্রতিরোধের পথ ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা: বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদী উত্থানে অলিগার্কি-পৃষ্ঠপোষক মিডিয়ার যে ভূমিকা, তা একটি গভীর কাঠামোগত সমস্যার প্রকাশ। এই সমস্যার সমাধান শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যে নেই, বরং প্রয়োজন সামগ্রিক সংস্কার।
প্রথমত, মিডিয়ার মালিকানা কাঠামোতে স্বচ্ছতা এনে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ সীমিত করতে হবে। এটি নিশ্চিত করতে হবে যে মিডিয়া হাউসগুলো কোনো নির্দিষ্ট ব্যবসায়িক বা রাজনৈতিক গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষায় কাজ না করে, বরং জনস্বার্থকে প্রাধান্য দেয়। এর জন্য প্রয়োজন স্বাধীন রেগুলেটরি বডি এবং কঠোর নীতিমালা।
দ্বিতীয়ত, বিকল্প মিডিয়ার বিকাশে সহায়তা প্রদান করতে হবে। ক্ষুদ্র ও স্বাধীন অনলাইন মিডিয়া, কমিউনিটি রেডিও এবং নাগরিক সাংবাদিকতার প্ল্যাটফর্মগুলোকে উৎসাহ দিতে হবে। এগুলো মূলধারার মিডিয়ার একপেশে প্রচারণার বিরুদ্ধে একটি পাল্টা শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। প্রযুক্তির সাহায্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে সঠিকভাবে ব্যবহার করে তথ্য প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে।
তৃতীয়ত, মিডিয়া সাক্ষরতা বৃদ্ধির মাধ্যমে জনগণকে সঠিক তথ্য যাচাইয়ের ক্ষমতা দিতে হবে। স্কুল-কলেজ পর্যায়ে মিডিয়া সাক্ষরতা কোর্স চালু করা উচিত, যেখানে শিক্ষার্থীদের তথ্যের উৎস যাচাই করা, গুজব ও প্রোপাগান্ডা চিহ্নিত করা এবং সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ করার দক্ষতা শেখানো হবে। এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষ মিডিয়ার অপপ্রয়োগ সম্পর্কে সচেতন হতে পারবে এবং নিজেদের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবে।
সর্বোপরি প্রয়োজন মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ। একটি শিক্ষিত, সচেতন ও বিবেকবান জনগোষ্ঠীই পারে এই অলিগার্কিক-মিডিয়া সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই প্রতিরোধ কতটা শক্তিশালী ও টেকসই করা যায় তার উপর। মানবসম্পদের বিকাশ ছাড়া টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। আমাদের মনে রাখতে হবে, অলিগার্কির জাল ছিঁড়ে গণতন্ত্রের পথে ফিরতে হলে একটি সচেতন ও জ্ঞাননির্ভর সমাজ অপরিহার্য।
গণমাধ্যম সমাজের দর্পণ; এই দর্পণ যখন কলুষিত হয়, তখন তা সমাজের প্রকৃত চিত্র উন্মোচন করতে ব্যর্থ হয়। একটি প্রকৃত অর্থে স্বাধীন গণমাধ্যম ব্যবস্থা গড়ে তোলার স্বপ্ন বাংলাদেশের জন্য সুদূরপরাহত মনে হলেও, তা অর্জনের পথ রুদ্ধ নয়। তবে এই পথ রাজনৈতিক অর্থনীতির কাঠামোগত জটিলতা বিবেচনায় রেখেই অলিগার্কির জাল ছিন্ন করার মধ্য দিয়েই প্রশস্ত হবে। ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান অমিত সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে, তবে অদূরদর্শিতার কারণে সৃষ্ট ব্যর্থতা অনেকের মধ্যে হতাশার জন্ম দিয়েছে। তাই, দেশে স্বাধীন গণমাধ্যমের স্বপ্নপূরণে আশার আলো জ্বালিয়ে রাখতে হবে। এই আশাই ভবিষ্যতে একটি সচেতন ও সমালোচনামূলক চিন্তাধারার সমাজ গঠনে ইন্ধন যোগাবে, যা দীর্ঘমেয়াদে অলিগার্কিক শোষণ থেকে মুক্তি এবং প্রকৃত গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।
লেখক: বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার কর্মকর্তা, অর্থনীতির শিক্ষক ও গবেষক