দেশে বড় ধরনের সহিংস অপরাধের সংখ্যা বাড়েনি বলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং যে দেশবাসীকে সান্ত্বনা দিতে চাইছে, তা কতটা যৌক্তিক? সংখ্যা বা পরিসংখ্যানের মারপ্যাঁচ যা–ই হোক, সবচেয়ে বড় কথা হলো দেশের মানুষ নিজেদের নিরাপদ বোধ করছে কি না। বাস্তবতা হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও নিরাপত্তা নিয়ে দেশের জনগণের মধ্যে উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা বেড়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নানা উদ্যোগের কথা শোনা গেলেও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে সোমবার পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত সরকারি অপরাধ পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি বছর বড় ধরনের অপরাধের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে—এমন দাবি সঠিক নয়। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ মাসে এ ধরনের অপরাধের প্রবণতা স্থিতিশীল আছে। এ ধরনের আত্মতৃপ্তি বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে।

প্রথম কথা হলো প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে এ রকম একটি বিবৃতি কেন দিতে হলো। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কী করছে? প্রেস উইংয়ের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘অনুল্লেখযোগ্য হারে’ যে অপরাধ বেড়েছে, তা কি উদ্বেগের কারণ নয়? পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যানের দোহাই দিয়েও কিন্তু তারা বলতে পারেনি, অপরাধের মাত্রা কমেছে। সেটি বলার সুযোগও নেই।

প্রথম আলো প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং ও পুলিশ সদর দপ্তরের বরাত দিয়েই লিখেছে, ‘চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত দেশে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে খুনের ঘটনা। জানুয়ারিতে সারা দেশে খুনের মামলা হয় ২৯৪টি, জুনে হয়েছে ৩৪৪টি। গত ছয় মাসে ডাকাতি, দস্যুতা, ধর্ষণ ও পুলিশ আক্রান্ত হওয়ার মতো ঘটনায় মামলা কখনো বেড়েছে, কখনো কমেছে।’

প্রেস উইং বলেছে, সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, চলতি বছরে অপরাধ বেড়েছে, যা নাগরিকদের মধ্যে ভয় ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করছে। অতীতে রাজনৈতিক সরকারগুলো যেমন সব দোষ নন্দ ঘোষ গণমাধ্যমের ওপর চাপিয়ে দিত, প্রেস উইংও কিছুটা নম্র ভাষায় সেটাই বলার চেষ্টা করছে। সংবাদমাধ্যমে অপরাধের খবর প্রকাশের কারণে যদি নাগরিকদের মধ্যে ভয় ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়, তাহলে কি অপরাধের খবর চেপে যাবে?

সম্প্রতি পুরান ঢাকায় চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে পিটিয়ে, কুপিয়ে ও ইট-পাথরের খণ্ড দিয়ে থেঁতলে হত্যা করার ঘটনাই বড় ধরনের অপরাধের একমাত্র উদাহরণ নয়। কাছাকাছি সময় খুলনায় যুবদল নেতাকে গুলি ও পায়ের রগ কেটে হত্যা করে মোটরসাইকেলে আসা তিন যুবক চলে যায়। পুলিশ এখনো তাঁদের নাগাল পায়নি। একই শহরে পুলিশ পরিচয়ে দুর্বৃত্তরা খাদ্য বিভাগের এক কর্মকর্তাকে অপহরণ করে ১৫ ঘণ্টা পর রাস্তার ওপর ফেলে রাখে, যিনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। এগুলো কি বড় অপরাধের মধ্যে পড়ে না? খুলনায় যুবদল নেতা হত্যার সঙ্গে চরমপন্থীদের যুক্ত থাকার খবরটি আরও শঙ্কিত করে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির অন্যতম কারণ মব ভায়োলেন্স, যা পুলিশের খাতায় লেখা থাকে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এর বিরুদ্ধে মামলাও হয় না। ফলে জনমনে আতঙ্ক তৈরি হয়। অতএব, বাস্তবতা অস্বীকার না করে দলমত-নির্বিশেষে অপরাধীদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান চালানোই অপরাধের মাত্রা কমিয়ে আনার একমাত্র পথ। আমরা আশা করি, সরকার সেই জরুরি কাজটি করবে। এ ক্ষেত্রে সফল হলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংকেও পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করার প্রয়োজন হবে না।

সূত্র, প্রথম আলো