বিনিয়োগ স্থবির। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে আশানুরূপ কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হচ্ছে না; বেকারত্ব বাড়ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত দেড় দশকে রাজনৈতিক মদদে কতিপয় অলিগার্ক ব্যবসায়ী শ্রেণী তৈরি হয়েছে। তাদের ব্যাংক খাতে রয়েছে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ। একই সঙ্গে বিপুল পরিমাণ অর্থও পাচার হয়েছে। এছাড়া বর্তমানে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিদ্যমান। এটি বিনিয়োগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীরা এ অস্থিরতার মধ্যে বিনিয়োগ করতে চাইবেন না। এসব কর্মকাণ্ড সার্বিকভাবে অর্থনীতিতে ক্ষত সৃষ্টি করেছে। সেই ক্ষত এখনো পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা যায়নি। ব্যাংক খাতে অর্থ লেনদেন পরিসংখ্যানে সেটি ফুটে উঠেছে। দেশের অর্থনীতির আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংক খাতে অর্থ লেনদেনের পরিমাণও বাড়ার কথা। কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) দেশের ব্যাংক খাতে অর্থ লেনদেন না বেড়ে উল্টো কমে গেছে। চলতি অর্থবছরে ব্যাংক খাতে লেনদেন কমেছে প্রায় ৫ শতাংশ। অর্থনীতিতে গতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাসহ বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে। অর্থনীতি গতিশীল হলেই ব্যাংক খাতে লেনদেন বাড়বে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

চলতি অর্থবছরে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রধান তিন খাত তথা আমদানি, রফতানি ও রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধির ধারায় আছে। সে হিসেবে মানুষের অর্থের প্রয়োজনীয়তা ও লেনদেন আরো বাড়া উচিত ছিল। কিন্তু লেনদেনের পরিসংখ্যানে সেটি ফুটে ওঠেনি। লেনদেনের হিসাবায়নের ক্ষেত্রে চেক, ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার (ইএফটি), ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড, ইন্টারনেট ব্যাংকিং ও এজেন্ট ব্যাংকিংকে আমলে নেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে দেশের ব্যাংক খাতে পাঁচটি মাধ্যমে মোট লেনদেন হয়েছিল ৩৬ লাখ ১৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের একই সময়ে এ লেনদেন ৩৪ লাখ ৪০ হাজার ৫৭ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। সে হিসাবে গত অর্থবছরের তুলনায় ব্যাংক খাতে ১ লাখ ৭৬ হাজার ২৭৭ কোটি টাকার লেনদেন কম হয়েছে। এক্ষেত্রে লেনদেন কমার হার ৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যাংকে লেনদেন কমে যাওয়ার অর্থ হলো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের স্থবিরতা এখনো কাটেনি। বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধিও গত ২১ বছরের সর্বনিম্নে নেমে এসেছে। তবে ঘুস-দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত কালো টাকার দৌরাত্ম্য কমে যাওয়ার প্রভাবেও ব্যাংক লেনদেন কমে যাচ্ছে। অর্থনীতিতে স্বল্পমেয়াদি ও মধ্যমেয়াদি পদক্ষেপ নেয়া দরকার, যাতে অর্থনীতিতে গতিশীলতা ফিরে আসে। ভঙ্গুর অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য এটা অতীব জরুরি।

বিগত সরকারের আমলে ব্যাংক ও আর্থিক খাত ছিল সবচেয়ে ভুক্তভোগী। সুশাসন ও শৃঙ্খলার অভাব এতটাই যে স্বাধীনতার পর গত ৫৩ বছরে এ দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাত এত বেশি সমস্যার মুখোমুখি আর কখনো হয়নি। নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। ঋণ জালিয়াতি, অবৈধ অর্থ পাচার থেকে শুরু করে শেয়ারবাজারে কারসাজিসহ অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি খাতেই চলেছে দুর্বৃত্তপনা। তারল্য সংকটে পড়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত থেকে শুরু করে আধা সরকারি ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক। খেলাপি ঋণের হার অসহনীয় মাত্রায় বেড়ে গেছে। সরকারি ঋণপ্রবাহ বেড়ে গিয়েছিল। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমায় বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়ে। এর ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। এছাড়া ব্যাংকের মাধ্যমে আসা বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ কমে গিয়েছিল এবং বৈদেশিক বাণিজ্য তথা আমদানি-রফতানি কার্যক্রমে দেখা দিয়েছিল আস্থার সংকট; ভেঙে পড়েছিল পুরো আর্থিক খাত। অনেক ক্ষেত্রে স্বয়ং ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদই এসব অনিয়মে জড়িত ছিল। প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিকীকরণ, সুশাসনের অভাব ও নৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ায় সংকট তৈরি হয়েছিল ব্যাংক ও আর্থিক খাতে।

বিগত সময়ে সুশাসনের অভাবে এবং আইন না মেনে রাজনৈতিক বিবেচনায় বিশেষ গোষ্ঠীকে ঋণ সুবিধা দিয়ে ব্যাংকগুলোর সংকট ডেকে আনা হয়েছে। খেলাপি ঋণ বেড়েছে। বিগত সময়ে ব্যাংকের যে ভালো চর্চাগুলো ছিল, সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই ব্যাংক ও আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে উদ্যোগ গ্রহণ করে। শুধু কাগজে-কলমে আইন থাকলেই হবে না, আইনকে অনুসরণ করার মানসিকতা থাকতে হবে। আইনকে যথাযথভাবে অনুসরণ ও জবাবদিহি করার সংস্কৃতি থাকলেই সুশাসন নিশ্চিত করা যায়। এগুলো চর্চার বিষয়। এসব না থাকলে কোনো প্রতিষ্ঠানই ভালো ফল দেয় না। তবে এর আগেও ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। সেগুলোর ধারাবাহিকতা দেখা যায়নি। বরং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আইনের অপপ্রয়োগ ঘটিয়ে প্রভাবশালী ও ব্যাংকের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সর্বেসর্বা হয়ে দুর্নীতি ও লুটপাট করেছে। ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরাতে হলে রাজনৈতিক প্রভাববলয় থেকে ব্যাংক খাতকে মুক্ত রাখতে হবে। ব্যক্তিকে নয়, প্রতিষ্ঠানকে গুরুত্ব দিয়ে আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিতের পাশাপাশি নৈতিকতার চর্চাও করতে হবে। শীর্ষ পদগুলোয় দায়িত্বশীল, সৎ ও দক্ষ ব্যক্তির পদায়নও জরুরি। এ খাতে এখন দরকার শৃঙ্খলা, সুশাসন, নিয়ন্ত্রণ ও পরিবীক্ষণ আরো সুদৃঢ় করা।

ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ হলেই অর্থনীতি গতিশীল হবে। এজন্য দরকার দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ নিশ্চিত করা। বিনিয়োগ ব্যতীত এ খাতের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ কঠিন। বিগত সরকারঘনিষ্ঠদের ব্যাংক লুটপাট, দেশী-বিদেশী উৎস থেকে সরকারের ঋণনির্ভরতা, লাগামহীন দুর্নীতি, ব্যয়বহুল মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া, রিজার্ভ সংকট ও বিনিময় হারের অস্থিতিশীলতায় ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ হয়নি। দেশের ব্যাংক খাতের ওপর সরকারের ঋণনির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি খাত সম্প্রসারণ বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ সম্প্রসারণে সবচেয়ে বড় বাধা দুর্নীতি। এরপর রয়েছে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আইনি সুরক্ষার অভাব, সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও মাত্রাতিরিক্ত সময়ক্ষেপণ, দুর্বল অবকাঠামো ও গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট, জমির অভাব ও ক্রয়ে জটিলতা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় অংকের ঋণ জোগানে সক্ষমতার অভাব এবং স্থানীয়দের সঙ্গে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের যোগসূত্র ও সমন্বয়ের অভাব। এগুলোর বাইরে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সুশাসনের অভাবও দায়ী। এখন এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করে অন্তর্বর্তী সরকারকে শিল্প ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করে অর্থনীতিতে গতিশীলতা ফেরাতে উদ্যোগ কাম্য।

সূত্র, বণিক বার্তা