রাজধানীতে ছিনতাই বেড়েছে। রাজধানী কেন, সারা দেশেই বেড়েছে। পত্রিকান্তরে খবর বেড়িয়েছে, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সন্ধ্যার পর থেকে ভোর রাত পর্যন্ত ফুটপাত, নির্জন গলি, বাসস্ট্যান্ড, ফুট ওভারব্রিজ ও পার্কসংলগ্ন এলাকায় চলে ছুরি-চাকু নিয়ে ছিনতাই। পথচারীদের পকেট ও ব্যাগ থেকে টাকা-পয়সা ও মূল্যবান সামগ্রী ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। ভয় দেখিয়ে মহিলাদের ভ্যানিটি ব্যাগ, মোবাইল, স্বর্ণালংকার লুটে নেয় তারা। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, তেজগাঁও, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, ফার্মগেট, নিউমার্কেট, গুলিস্থান প্রভৃতি এলাকা ছিনতাইকারীদের নির্ভয়ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। রাজধানীর আশেপাশের বিভিন্ন এলাকাসহ দেশের সকল শহর ও রাস্তাঘাটে ছিনতাইকারী ও রাহাজানদের দৌরাত্ম্য মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ছিনতাইকারী ও রাহাজানদের হাতে হতাহতের ঘটনা পর্যন্ত ঘটছে। পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে সারা দেশে এক হাজার ১৪৮৩টি ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে। বলা বাহুল্য, ছিনতাইয়ের ঘটনা ও ছিনতাইমামলার মধ্যে বিরাট ফারাক রয়েছে। অনেকেই পুলিশী ঝামেলা এড়াতে থানার দারস্থ হয় না। ছিনতাই-রাহাজানির পাশাপাশি চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, খুন, অপহরণ ইত্যাদি অপরাধ বেড়েছে এবং ক্রমাগত বাড়ছে। অপরাধ ও অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি নাগরিক জীবনে ভয়-আতংক বাড়িয়ে দিয়েছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। পর্যবেক্ষকদের মতে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী পুলিশ বাহিনী জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ধাক্কা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। পতিত ও বিতাড়িত স্বৈরাচারের হাতের লাঠি হিসেবে এই বাহিনী যথেচ্ছ ব্যহৃত হওয়ায় জনরোষ তার ওপর পতিত হয়। সেই বিপর্যয় সামলে ওঠা এখনো তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। ট্রমা এখনো কাজ করছে। আইন-শৃংখলা রক্ষা ও নাগরিক নিরাপত্তা বিধানে পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নাতীত। পুলিশের অপারগতা ও ব্যর্থতায় আইন-শৃঙ্খলায় অবনতি ঘটতে বাধ্য। অন্তর্বর্তী সরকার শুরু থেকেই আইন-শৃঙ্খলার সুরক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করে আসছে। পুলিশ বাহিনীকে পুনর্গঠিত ও সক্ষম করে তোলার নানা পদক্ষেপ ইতোমধ্যে নেয়া হয়েছে। এর সুফল আসতে শুরু করেছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ক’দিন আগেই দাবি করেছেন, আইন-শৃঙ্খলার অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। এই উন্নতি যে এখনো সন্তোষজনক হয়ে উঠতে পারেনি, অপরাধের পরিসংখ্যান তার সাক্ষী।
প্রশ্ন উঠতে পারে, পুলিশকে সুগঠিত ও তৎপর করলেই কি আইন-শৃঙ্খলার কাক্সিক্ষত উন্নতি নিশ্চিত হবে? পর্যবেক্ষকদের মতে, না। পুলিশের সক্রিয়তা এই নিশ্চয়তা দেয় না। কারণ, আইন-শৃঙ্খলার অবনতির পেছনে বিবিধ কারণ বিদ্যমান। এর মধ্যে দরিদ্র, বেকারত্ব, সামাজকি ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মানুষকে অমানুষ করে তোলে। ক্ষুধার্ত ও দারিদ্র্য পীড়িত মানুষের পক্ষে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাজাহানি, খুন ইত্যাদি অপরাধ করা মোটেই অসম্ভব নয়। আমাদের দেশের মানুষের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ দরিদ্র। এই সংখ্যা বাড়ছে। এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে দারিদ্র্য বেড়েছে ২১ শতাংশের ওপর। দারিদ্র্য বাড়া মানে দরিদ্রের সংখ্যা বাড়া। শুধু দারিদ্র্য নয়, দারিদ্র্যের সঙ্গে বেকারত্ব বেড়েছে এবং বাড়ছে। দারিদ্র্য ও বেকারত্ব একে অপরকে অনুষঙ্গী, উপযুক্ত কর্মসংস্থানই এ দু’য়ের অবসান ঘটাতে পারে। এ জন্য দরকার কর্মসংস্থান। দুঃখজনক, কর্মসংস্থান বাড়ছে না, বরং কমছে। বিনিয়োগ, শিল্পায়ন, ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশ কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বাড়াতে পারে। এক্ষেত্রে শোচনীয় বন্ধ্যাত্ব বিরাজ করছে। সর্বশেষ সরকারি পরিসংখ্যান মতে, দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ২০ হাজারের বেশি। আগের বছরের তুলনায় এ সংখ্যা দেড় লাখ বেশি। বেকারদের মধ্যে অশিক্ষিত যেমন আছে, তেমনি আছে শিক্ষিতও। উচ্চশিক্ষিতরাও অনেকেই বেকার। বিবিএস’র তথ্য মোতাবেক, মোট বেকারের সাড়ে ১৩ শতাংশ ¯œাতক ডিগ্রিধারী। আর উচ্চমাধ্যমিক পাস বেকারের সংখ্যা ৭.১৩ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি পাঁচজন বেকারের মধ্যে একজন ¯œাতক বা উচ্চমাধ্যমিক পাস। আগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতিবছর চাকরির বাজারে প্রবেশ করছে ২০ লাখের ওপর মানুষ। দেশে-বিদেশে নানাভাবে তাদের মধ্যে অর্ধেকের মতো কর্মসংস্থান হচ্ছে। বাকীরা বেকার থাকছে। গত বছরাধিককাল ধরে বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে চরম মন্দাবস্থা বিরাজ করায় একের পর এক শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। গণঅভ্যুত্থানের পর এক পোশাক শিল্পেই ১৮২টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যান্য খাতে শিল্প-কারখানা বন্ধ হওয়া অব্যাহত আছে। বন্ধ কারখানাগুলোতে কর্মরত লাখ লাখ শ্রমিক-কর্মী বেকার হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অভাবে চালু কারখানাগুলোর উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। রফতানিতে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। গত দু’মাসে পোশাক রফতানি কমেছে ৫ থেকে ৬ শতাংশ। পতিত স্বৈরাচারের সহযোগিতাকারী শিল্প-মালিক ও ব্যবসায়ীদের অনেকের কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের কেউ কেউ দেশছাড়া, কেউ কেউ কারাগারে। এমতাবস্থায়, সরকারের উচিত ছিল কারখানাগুলো চালু রাখার ব্যবস্থা করা। তাতে উৎপাদন অব্যাহত থাকতো এবং শ্রমিক-কর্মীরা বেকার হতো না। সরকার এ ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। শুধু তাই নয়, সরকার নতুন বিনিয়োগ আনতেও ব্যর্থ হয়েছে। দেশি-বিদেশি সব ধরনের বিনিয়োগেই স্থবিরতা বিরাজ করছে।
বিনিয়োগ হলে শিল্প-কারখানা হতো। তাতে উৎপাদন রফতানি বাড়তো। নতুন কর্মসংস্থান হতো। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বড়তো। দারিদ্র্য কমতো। সমাজ ও আইন-শৃঙ্খলায় তার শুভ প্রভাব প্রতিফলিত হতো। দারিদ্র্য ও বেকারত্ব একদিকে অস্থিরতা বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে অপরাধপ্রবণতায় ঘি ঢালছে। পারিবারিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধে এমনিতেই ধস চলছে। দারিদ্র্য ও বেকারত্ব তাকে আরো টেনে নামাচ্ছে। এক শ্রেণির মানুষ হতাশ, ক্ষুব্ধ ও বেপরোয়া। তারা যে কোনো অপরাধ করতে পিছপা হচ্ছে না। পুলিশ দিয়ে এ অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও দমন করা সম্ভব নয়। অপরাধী ও অপরাধপ্রবণ হতে যেসব বিষয় প্ররোচক ও নিয়ামকের ভূমিকা পালন করছে, সেগুলো অপনোদন করার বিকল্প নেই। এভাবে আমরা উপসংহার টানতে পারি যে, সর্বাগ্রে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব দূর করতে হবে। সবার জন্য কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। ক্রয় ক্ষমতা বাড়াতে হবে। মূল্যস্ফীতি কমাতে হবে। বাজারে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। এই সঙ্গে পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে হবে। এ লক্ষ্যে শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করতে হবে। এমন মানুষ তৈরি করতে হবে, যারা কোনো পরিস্থিতিতেই অপরাধ করবে না। অপরাধ করতে প্ররোচিত হবে না। এটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু উদ্যোগ নিতে, চেষ্টা শুরু হতে হবে এখনই। চলমান চুরি, ছিনতাই, রাহাজানিসহ বিভিন্ন অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। শীত কড়া নাড়ছে। শীতের সময় মানুষের মুভমেন্ট সঙ্গতকারণেই বেড়ে যাবে। মানুষ যাতে পথেঘাটে যথাযথ নিরাপত্তা পায় তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।