গাজায় ইসরায়েলের চলমান গণহত্যা ও পশ্চিম তীরে ক্রমবর্ধমান মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক মহল আবারও ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে জোর দিয়েছে। জুলাইয়ের শেষে নিউইয়র্কে ফ্রান্স ও সৌদি আরবের যৌথ উদ্যোগে এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়। সেখানে ১০০টির বেশি দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নেন এবং এ বিষয়ে গতি সৃষ্টির চেষ্টা করেন।
এর পর থেকে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও কয়েকটি আরব দেশ এ দাবিকে সমর্থন করেছে। যুক্তরাজ্যও বলেছে, যদি ইসরায়েল যুদ্ধবিরতিতে রাজি না হয়, তবে তারা ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে। এ উদ্যোগকে অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক পদক্ষেপ হিসেবে স্বাগত জানালেও বাস্তবে প্রায় ২২ লাখ মানুষ যখন ইসরায়েলের পরিকল্পিত অনাহারের মুখোমুখি, তখন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ধারণা তোলাটা আসলে নিছক রাজনৈতিক নাটক ছাড়া আর কিছু নয়।
আন্তর্জাতিক মহল যে ধরনের ‘ফিলিস্তিন রাষ্ট্র’ নিয়ে কথা বলছে, তা গাজার গণহত্যা থামাবে না। তা সত্যিকার অর্থে স্বাধীন-সার্বভৌম কোনো রাষ্ট্রও এনে দেবে না। এ মুহূর্তে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রশ্ন আবার তোলা আসলে একটাই উদ্দেশ্য পূরণ করছে, সেটি হলো গাজায় হত্যাযজ্ঞ চালানো আর পশ্চিম তীরে চলমান দমননীতির জন্য ইসরায়েলকে বৈধতা ও কূটনৈতিক সুরক্ষা দেওয়া।
আরও পড়ুন
ফিলিস্তিন ইস্যুতে যেভাবে অস্ট্রেলিয়া-ইসরায়েল সম্পর্কে চূড়ান্ত ভাঙন
২২ আগস্ট ২০২৫
ফিলিস্তিন ইস্যুতে যেভাবে অস্ট্রেলিয়া-ইসরায়েল সম্পর্কে চূড়ান্ত ভাঙন
বিশ্বে এখন অনেক দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও সেটি বাস্তবে কোনো পরিবর্তন আনতে পারছে না। জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্যরাষ্ট্রের মধ্যে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত ১৪৭টি দেশ ফিলিস্তিনকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, যা সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য। কিন্তু স্বীকৃতি থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক মহল গাজায় ইসরায়েলের অবরোধ, গণহত্যা ও পরিকল্পিতভাবে মানুষকে অনাহারে রাখার নীতি থামাতে পারছে না। অনেক ক্ষেত্রে মনে হয়, তারা হয় এই নীতি থামানোর সক্ষমতা রাখে না অথবা থামানোর ইচ্ছাই নেই। যে শক্তি দিয়ে ইসরায়েলকে বাধ্য করতে হবে প্রকৃত অর্থে সমঝোতায় আসার জন্য, সেই রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ইচ্ছাশক্তি নেই বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলোর। আর সেই শক্তিই দরকার ছিল একটি সত্যিকারের স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গড়ার জন্য।
বাস্তবতা হলো বহুদিন আগেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের সুযোগ হারিয়ে গেছে। কয়েক দশক ধরে ইসরায়েল ধারাবাহিকভাবে এমন পদক্ষেপ নিয়েছে, যা ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র বানানোর পথ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। এটি ছিল দীর্ঘমেয়াদি কৌশল—বসতি স্থাপন, ভূমি দখল, অবকাঠামো নিয়ন্ত্রণ, প্রশাসনিক ক্ষমতা সীমিত করা, অর্থনৈতিকভাবে ফিলিস্তিনকে নির্ভরশীল করে রাখা এবং আইনের কাঠামো এমনভাবে সাজানো, যাতে ফিলিস্তিনি জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার সুযোগ না থাকে।
আরও পড়ুন
ফিলিস্তিন সমস্যা, যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ব্যবসা ও পুঁজিপতিদের খেল
০১ ডিসেম্বর ২০২৩
ফিলিস্তিন সমস্যা, যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ব্যবসা ও পুঁজিপতিদের খেল
আজকে যে ‘ফিলিস্তিন রাষ্ট্র’ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, সেটি ভূগোলের দিক থেকে খণ্ডিত—পশ্চিম তীরের টুকরা টুকরা এলাকা এবং সম্ভবত গাজাকে বাদ দিয়ে কিছু অংশ মিলে রাষ্ট্রের নাম দেওয়া হবে। এর প্রশাসনিক ক্ষমতা কার্যত থাকবে না। কারণ, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো ইসরায়েলের হাতে। অর্থনৈতিকভাবে এটি ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। কারণ, রাজস্ব, বাণিজ্যপথ ও সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ—সবকিছু ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে। আইনের ক্ষেত্রেও এ প্রস্তাবিত রাষ্ট্রটি সমান অধিকার ভোগ করবে না। কারণ, দখল করা অঞ্চলে ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের জন্য ভিন্ন আইন কার্যকর থাকে।
শুরুতেই দেখা যায়, যে ভূখণ্ড নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তা বিচ্ছিন্ন অংশে ভাঙা। ওই ভূখণ্ড একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত নয়। আর সব মিলিয়ে পশ্চিম তীরের মাত্র ৪০ শতাংশজুড়ে ফিলিস্তিনিদের অধিকারে থাকতে পারে। আর সম্ভবত গাজা সম্পূর্ণ বাদই পড়বে। প্রশ্ন হলো, আন্তর্জাতিক মহল কি ইসরায়েলকে পশ্চিম তীরের অবশিষ্ট ৬০ শতাংশ (অর্থাৎ এরিয়া সি, যেখানে পুরোপুরি ইসরায়েলের সামরিক ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ আছে) ছেড়ে দিতে বাধ্য করবে? তারা কি ইসরায়েলকে গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে চাপ দেবে?
১৯৬৭ সালের পর থেকে প্রতিটি ইসরায়েলি সরকার দখল করা ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে বসতি সম্প্রসারণ করেছে এবং সেখানে ইহুদি নাগরিকদের পাঠাতে নানা সুবিধা দিয়েছে। আর্থিক প্রণোদনা ও অবকাঠামো উন্নয়নে সহযোগিতা করে ইসরায়েল সেখানে ইহুদিদের স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রতিটি অবৈধ বসতিতে একটি বেসামরিক নিরাপত্তা ইউনিট থাকে। এই ইউনিটগুলো ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ ও অস্ত্র পায়। এগুলো কার্যত ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সহায়তায় চলে।
প্রশ্ন হলো, আন্তর্জাতিক মহল কি ইসরায়েলকে এই বসতিগুলো ভেঙে দিতে চাপ দেবে? অথবা এমন একটি একক আইনি ব্যবস্থা চালু করতে তারা কি ইসরায়েলকে চাপ দেবে, যেখানে খ্রিষ্টান ও মুসলিম ফিলিস্তিনি ও ইহুদি ইসরায়েলিরা একই আইনের আওতায় থাকবে?
১৯৯৫ সালের অসলো-টু অন্তর্বর্তী চুক্তি অনুযায়ী, দখল করা এলাকায় সব পানিসম্পদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ইসরায়েলের হাতে। এ ব্যবস্থায় পশ্চিম তীরের পাহাড়ি ভূগর্ভস্থ পানির ভান্ডার থেকে ফিলিস্তিনিরা মাত্র ২০ শতাংশ পানি ব্যবহার করতে পারেন। অথচ এ সম্পদ ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি উভয়ের জন্যই বরাদ্দ।
প্রশ্ন হলো, আন্তর্জাতিক মহল কি ইসরায়েলকে ন্যায্যভাবে পানি ভাগ করে দিতে বাধ্য করবে, যাতে পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি গ্রামগুলো এবং ইহুদি বসতিগুলো সমান সুযোগ পায়?
এ মুহূর্তে ইসরায়েল কার্যত দখল করা সব এলাকার বাইরের সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করছে। প্রত্যেক ফিলিস্তিনি, এমনকি ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের (পিএ) প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসও ইসরায়েলের অনুমতি ছাড়া বাইরে যেতে বা ভেতরে ঢুকতে পারেন না। এমনকি অনেক সময় নিজের এলাকার ভেতর চলাফেরার জন্যও অনুমতি লাগে।
প্রশ্ন হলো, আন্তর্জাতিক মহল কি ইসরায়েলকে সীমান্ত ও প্রবেশপথের নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে বাধ্য করবে?
১৯৯৪ সালে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়েছিল পশ্চিম তীর ও গাজায় ফিলিস্তিনি জনগণের প্রশাসনিক কাজ দেখার জন্য। কিন্তু বাস্তবে এটি সরকারের চেয়ে বেশি ইসরায়েলের দখলদারির একপ্রকার ঠিকাদার হিসেবেই কাজ করছে। এমনকি নির্বাচন হলে তার ফলাফল অনুমোদনের ক্ষমতাও ইসরায়েলের হাতে।
প্রশ্ন হলো, আন্তর্জাতিক মহল কি দাবি করবে যে ইসরায়েল ও তার মিত্ররা সত্যিকারের মুক্ত ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে দেবে এবং ফলাফল মেনে নেবে?
১৯৯৪ সালের প্যারিস প্রটোকল অনুযায়ী, ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রধান আয়ের উৎস—ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন করের রাজস্ব ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে থাকে। ইসরায়েল চাইলেই এ অর্থ আটকাতে পারে। প্রশ্ন হলো, আন্তর্জাতিক মহল কি ইসরায়েলকে বাধ্য করবে যাতে একটি ফিলিস্তিন সরকার নিজের অর্থ নিজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে?
এ প্রশ্নগুলো আসলে ভবিষ্যতে কোনো ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের পথে থাকা অসংখ্য ভৌগোলিক ও প্রশাসনিক বাধার সামান্য অংশ মাত্র। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, রাষ্ট্রগুলো এখনো সেই ঐতিহাসিক অবিচারগুলোর কথা তোলে না, ফিলিস্তিনিরা বহুদিন ধরে যেগুলোর শিকার হয়ে আসছেন। যেমন লাখ লাখ শরণার্থীর অধিকার, যা আজও অস্বীকার করা হচ্ছে।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্র নিয়ে যে আলোচনা চলছে, যদি তাতে এসব সমস্যার সমাধান না থাকে, তবে তা শুধু ইসরায়েলের চলমান নৃশংসতাগুলো থেকে দৃষ্টি সরানোর চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। ইতিহাস বলে, কখনো কোনো গণহত্যা অপরাধীদের ভালো কথা ভালোভাবে বোঝানোর মাধ্যমে থামানো যায়নি। কেবল নিষেধাজ্ঞা আর অস্ত্র বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞার মতো পদক্ষেপই ইসরায়েলকে তার অমানবিক শক্তি প্রয়োগ কমাতে বাধ্য করতে পারে।
অর্থহীন রাজনৈতিক প্রদর্শনীর বদলে বিশ্বনেতাদের সামনে তিনটি মৌলিক প্রশ্ন দাঁড় করাতে হবে—আন্তর্জাতিক আইন কি ইসরায়েলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে? ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার কি রক্ষা করা হবে? আর আন্তর্জাতিক মহল কি সত্যিই যুদ্ধ-পরবর্তী বৈশ্বিক শৃঙ্খলা রক্ষা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ?
এই তিন প্রশ্নের উত্তর কেবল ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানই ঠিক করবে না; বরং বিশ্বে যে নিয়মকানুন মেনে চলা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা আছে, সেটি আসলেই বিশ্বাসযোগ্য কি না, সেটাও এই উত্তরগুলো দিয়ে বোঝা যাবে।
মানাল এ জামাল জেমস ম্যাডিসন ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ