বিশ্ব আজ এক গভীর অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি, ঋণের চক্র ও আর্থিক বৈষম্য যেন এক একটি বৈশ্বিক অভিশাপ। এই সংকটের মূল কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কেন্দ্রে অবস্থান করা সুদভিত্তিক ব্যাংকিং ও আর্থিক কাঠামোই এ বিপর্যয়ের জন্য বিশেষভাবে দায়ী। ইসলামী দৃষ্টিতে এই সুদভিত্তিক ব্যবস্থা কেবল একটি আর্থিক সমস্যাই নয়, বরং এটি মানবতা, ইনসাফ ও আল্লাহর বিধানের বিরোধী।

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। এখানে যেমন ইবাদত, নৈতিকতা ও সমাজবিধান আছে; তেমনি রয়েছে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও কল্যাণকামী অর্থনৈতিক দর্শন, যা সুদের মূলোৎপাটন করে মানুষের মাঝে ন্যায়ের ভিত্তিতে সম্পদ বণ্টনের পদ্ধতি শিক্ষা দেয়। ইসলামী অর্থনীতি হলো বাস্তবসম্মত, নৈতিক ও ভারসাম্যপূর্ণ একটি অর্থনৈতিক কাঠামো। ইসলামী অর্থনীতির কতিপয় বৈশিষ্ট্য নি¤েœ তুলে ধরা হল। যথা:

এক. সুদের নিষিদ্ধতা: কুরআনে সুদ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আর আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন।’ (সূরা বাকারা : ২৭৫)। এটি স্পষ্ট নির্দেশনা দেয় যে, ইসলামী অর্থনীতিতে সুদের কোনো স্থান নেই।

দুই. সম্পদের প্রকৃত মালিক আল্লাহ: মানুষ কেবল আল্লাহর দেওয়া সম্পদের তত্ত্বাবধায়ক বা খলিফা। তাই সম্পদের সঠিক ব্যবহার ও কল্যাণে ব্যয় করা ইসলামী অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু।

তিন. সাম্য ও সুষম বণ্টন: ইসলাম চায় সম্পদ যেন সমাজের মধ্যে ঘুরে ফিরে বণ্টিত হয়, এক শ্রেণির হাতে কেন্দ্রীভূত না হয়। এজন্য রয়েছে জাকাত, সদকা, ইনসাফভিত্তিক মিরাস আইন ও নিষ্পেষিতদের অধিকারের নিরাপত্তা।

চার. হালাল পন্থায় উপার্জন: ইসলাম উৎস ও উপার্জনের পদ্ধতিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। উৎপাদন, কৃষি, ব্যবসা, খেদমত ও প্রকৃত শ্রমনির্ভর আয়ের উৎসকে উৎসাহিত করে।

পাঁচ. হালাল ও হারামের স্পষ্ট সীমারেখা: ইসলাম সম্পদ উপার্জনে হালাল পদ্ধতির ওপর জোর দেয়, যেমন: ব্যবসা, মুদারাবা, মুশারাকা, ইজারা, সালাম ও মুয়াজ্জাল ইত্যাদি।

ছয়. মালিকানায় ভারসাম্য: ইসলামী অর্থনীতি ব্যক্তিগত মালিকানার অনুমতি দিলেও তা সীমাহীন নয়। ব্যক্তি তার সম্পদ দ্বারা সমাজেরও উপকার করবে, এটাই ইসলামের দর্শন।

সুদভিত্তিক অর্থনীতি এমন এক ব্যবস্থা, যেখানে মূলধনদাতারা কোনো প্রকার ঝুঁঁকি গ্রহণ না করেও স্থায়ী ও নিশ্চিত মুনাফা অর্জনের জন্য টাকা ধার দেয়। এই প্রক্রিয়ায় উৎপাদন নয়, বরং অর্থই অর্থ-উপার্জনের উৎসে পরিণত হয়। সুদভিত্তিক অর্থনীতির কয়েকটি কুফল তুলে ধরা হল। যথা:

১. ধনী-গরিব বৈষম্য বাড়ায়: সুদভিত্তিক ঋণে মূলধনধারীরা অত্যধিক লাভবান হয়, আর প্রান্তিক মানুষদের কাঁধে চাপে সুদের পাহাড়। ফলে গরিব আরও গরিব হয়, ধনী আরও ধনী হয়। বিশ্বের ১% লোক এখন বিশ্বের প্রায় ৫০% সম্পদের মালিক, এটি এই ব্যবস্থারই ফসল।

২. চক্রবৃদ্ধি ঋণ ও দারিদ্র্যের ফাঁদ: সুদ ব্যবস্থা গরিব দেশগুলোকে ঋণের চক্রে ফেলে ধ্বংস করে দিচ্ছে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর মত প্রতিষ্ঠানগুলো উন্নয়নের নামে সুদের ফাঁদে ফেলে বহু দেশকে সর্বস্বান্ত করে দিয়েছে।

৩. অর্থনৈতিক অস্থিরতা: ২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দা, কিংবা আধুনিক বেকারত্ব ও দেউলিয়াপনার মূল কারণ সুদভিত্তিক ব্যাংকিং ও মুনাফাভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি। লাভের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ, কৃত্রিম দামের উল্লম্ফন এবং ফাটকা ব্যবসার প্রলয়ঙ্করী ফল এখন পৃথিবী ভোগ করছে।

৪. নৈতিক অবক্ষয়: সুদভিত্তিক পদ্ধতিতে মুনাফাই একমাত্র উদ্দেশ্য। এতে মানবিকতা, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও ন্যায়ের কোনো স্থান থাকে না। মানুষ শুধু টাকা বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকে, হালাল-হারামের বোধ লোপ পায়।

ইসলামী অর্থনীতি ও সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থায় ব্যাপক পার্থক্য বিদ্যমান রয়েছে। তন্মধ্যে কয়েকটি মৌলিক পার্থক্য হল:

ক. নীতি ও ভিত্তি: ইসলামী অর্থনীতি আল্লাহর বিধান, ন্যায়বিচার ও সামাজিক কল্যাণের উপর ভিত্তি করে গঠিত। আর সুদভিত্তিক অর্থনীতি গঠিত হয় নিছক লাভ ও পুঁজির আধিপত্যের ভিত্তিতে।

খ. সুদের অবস্থান: ইসলামে সুদ (রিবা) কঠোরভাবে নিষিদ্ধ এবং এটিকে গুনাহে কবীরা বলা হয়েছে। সুদভিত্তিক অর্থনীতিতে সুদকে বৈধ ও স্বাভাবিক আয় হিসেবে গণ্য করা হয়।

গ. লাভ-ক্ষতির নীতি: ইসলামী অর্থব্যবস্থায় লাভ ও ক্ষতি উভয়ের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বিনিয়োগ হয়। আর সুদভিত্তিক ব্যবস্থায় কেবল লাভের নিশ্চয়তা থাকে, ক্ষতিতে ঋণদাতা অংশ নেয় না।

ঘ. ঝুঁঁকি প্রবণতা: ইসলামী অর্থনীতিতে ঝুঁঁকি ও দায়িত্ব উভয় পক্ষের মধ্যে ভাগ হয়। আর সুদভিত্তিক ব্যবস্থায় সব ঝুঁকি থাকে ঋণগ্রহীতার উপর।

ঙ. সম্পদ বণ্টন: ইসলামী অর্থনীতিতে যাকাত, সদকা ও ইনসাফের মাধ্যমে সম্পদের ন্যায্য অধিকার বণ্টন হয়। আর সুদভিত্তিক অর্থনীতি সম্পদকে ধনী শ্রেণির হাতে কেন্দ্রীভূত করে।

চ. নৈতিকতা ও জবাবদিহিতা: ইসলামী অর্থনীতিতে আল্লাহভীতি ও পরকালীন জবাবদিহিতার ভয় থাকে। আর সুদভিত্তিক অর্থনীতিতে পার্থিব লাভই মুখ্য, নৈতিকতার কোনো গুরুত্ব নেই।

ছ. ভোগ ও ব্যয়নীতি: ইসলামী অর্থনীতি হালাল ভোগ, পরিমিতি ও প্রয়োজনীয় ব্যয়ের প্রতি গুরুত্ব দেয়। আর সুদভিত্তিক অর্থনীতি অপচয় ও ভোগবাদকে উৎসাহিত করে।

জ. সামাজিক প্রভাব: ইসলামী অর্থনীতি সমাজে সহানুভূতি, দান এবং সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করে। আর সুদভিত্তিক অর্থনীতি সমাজে শোষণ, ঋণের বোঝা ও বৈষম্য সৃষ্টি করে।

ঝ. অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা: ইসলামী অর্থনীতি সুদের অনুপস্থিতির কারণে স্থিতিশীল ও ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে। আর সুদভিত্তিক অর্থনীতি চক্রবৃদ্ধি ঋণ ও মন্দার মাধ্যমে সংকট তৈরি করে।

ঞ. চূড়ান্ত লক্ষ্য: ইসলামী অর্থনীতির লক্ষ্য হলো, দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ লাভ। আর সুদভিত্তিক অর্থনীতির লক্ষ্য হলো, দুনিয়াবি লাভ ও পুঁজির বৃদ্ধিই প্রধান।

ইসলামী অর্থনীতিতে ঝুঁকি ভাগাভাগির ভিত্তিতে মুনাফা নির্ধারণ করা হয়। এতে উভয় পক্ষ লাভের অংশীদার ও ক্ষতির দায়ভার বহনে প্রস্তুত থাকে। ইসলামী অর্থনীতি শুধু সুদ নিষিদ্ধ করেনি; বরং বাস্তবসম্মত বিকল্প পদ্ধতিও দিয়েছে। যেমন:

১. মুশারাকা (অংশীদারিত্ব ভিত্তিক ব্যবসা): যেখানে একাধিক ব্যক্তি যৌথভাবে মূলধন দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে এবং লাভ-ক্ষতি চুক্তি অনুযায়ী বণ্টন হয়।

২. মুদারাবা: একজন পুঁজি দেয়, অন্যজন ব্যবসা পরিচালনা করে; লাভ ভাগ হয় পূর্ব নির্ধারিত আনুপাতিক হারে, ক্ষতি হলে মূলধনদাতা তা বহন করে। এতে দু’পক্ষেরই দায়-দায়িত্ব থাকে।

৩. ইজারা: ভাড়াভিত্তিক অর্থব্যবস্থা, যেখানে সম্পদ (যেমন বাড়ি, গাড়ি, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি) ভাড়া দেওয়া হয়। এটি সুদ ছাড়াই দীর্ঘমেয়াদি আয় ও সেবা প্রদানের পদ্ধতি।

৪. বাই’ সালাম ও বাই’ মুয়াজ্জাল: পণ্য আগাম বিক্রি বা পরিশোধযোগ্য সময়সীমার ভিত্তিতে লেনদেন। বিশেষত কৃষি ও শিল্প খাতে এটি অত্যন্ত কার্যকর।

পরিশেষে, ইসলাম শুধু একটি ধর্ম নয়; এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যার মধ্যে অর্থনীতিরও একটি সুবিন্যস্ত কাঠামো রয়েছে। যেখানে নিষ্ঠুর সুদের পরিবর্তে ইনসাফ ও পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে সম্পদ লেনদেন হয়। যেখানে ধনশালী ব্যক্তি দাতা, আর দরিদ্র ব্যক্তি শোষিত নয়; বরং অংশীদার। যেখানে অর্থ শুধু মুনাফা অর্জনের উপায় নয়; বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে আমানত ও ইবাদতের মাধ্যম।

ইসলামী অর্থনীতি ইনসাফ, কল্যাণ ও তাকওয়ার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা একটি মানবিক ব্যবস্থা। অন্যদিকে সুদভিত্তিক অর্থনীতি শোষণ, বৈষম্য, ও দাসত্বের নতুন রূপ। বর্তমান বৈষম্য, ঋণচক্র ও ধনতান্ত্রিক শোষণ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হলো এই ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। এটা কেবল মুসলিম সমাজের নয়, বরং মানবজাতির সার্বিক মুক্তির দিশা।

লেখক: মুহাদ্দিস, ছারছীনা দারুস্সুন্নাত জামেয়া নেছারিয়া দীনিয়া, নেছারাবাদ, পিরোজপুর।

সূত্র, ইনকিলাব