গত বৃহ¯পতিবার (১৩ জুন) রাত থেকে ইরানের বিভিন্ন স্থানে পর্যায়ক্রমে বিমান হামলা চালায়িছে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ইসরাইল। পাঁচ ধাপে মোট আটটি স্থানে শতাধিক বিমান হামলা চালানো হয়েছে। হামলার উদ্দেশ্য ছিল ইরানের সামরিক ক্ষমতা দুর্বল করা এবং পারমাণবিক কর্মসূচি ব্যাহত করা। হামলায় ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) প্রধান হোসেইন সালামি ও দুইজন উচ্চপর্যায়ের পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন। হামলার পর তেহরানে বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে এবং তেহরানসহ আশপাশের এলাকায় অস্থিরতা বিরাজ করছে। এর মধ্যেই ইসরাইল তার আকাশসীমা বন্ধ ঘোষণা করেছে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা দিয়েছেন, এই সামরিক অভিযান যতদিন প্রয়োজন, ততদিন চালিয়ে যাবেন। ইসরাইল তার জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে কোনও ছাড় দেবে না এবং প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে জানিয়েছেন। ইসরাইলের এ হামলার পাল্টা জবাব হিসেবে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বলেছেন, এর কঠিন শাস্তি ইসরাইলকে পেতে হবে। এর কয়েক ঘন্টা পর ইরান ইসরাইলে পাল্টা হামলা চালিয়েছে। ইসরাইলের সামরিক বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, ইরান থেকে প্রায় ১০০টি ড্রোন ইসরাইলের ভূখ-ের দিকে ছোঁড়া হয়েছে। এসব ড্রোন প্রতিহত করতে ইসরাইল সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।
কয়েক মাস আগেও ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। নতুন করে আবার এই হামলা মধ্যপ্রাচ্যের অস্থির পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে। এই সংঘাত আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলতে পারে এবং পরবর্তী দিনগুলোতে উত্তেজনার মাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন। আগ বাড়িয়ে ইরানে হামলার কারণ হিসেবে ইসরাইল বলেছে, সে যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়েছে, তার আত্মরক্ষার জন্য এ হামলা জরুরি ছিল। অন্যদিকে, ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইলের হামলাকে ‘একতরফা পদক্ষেপ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। তার দাবি, এ ঘটনার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র জড়িত নয়। যুক্তরাষ্ট্রের এই বক্তব্য অনেকটা ‘ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না’র মতো হয়ে গেছে। ইসরাইলের যেকোনো হামলার পেছনে যে, যুক্তরাষ্ট্র জড়িত এবং তাতে পশ্চিমাবিশ্বের মদত থাকে, তা সকলেরই জানা। ইসরাইল এখানে কিছু না। তাকে তারা একটি ‘ইনস্ট্রুমেন্ট’ হিসেবে ব্যবহার করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাবিশ্বের যত যুদ্ধ ও পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ মদত থাকে, তার প্রায় সবই মুসলমানদের বিরুদ্ধে। বিশ্ব থেকে মুসলমানদের অগ্রযাত্রা ব্যাহত বা নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার তাদের এই পরিকল্পনা বহু পুরণো। আমরা দেখেছি, তথাকথিত ইসলামী জঙ্গীবাদ দমনের নামে যুক্তরাষ্ট্র ‘ওয়ার অন টেরর’ নামে এক অনন্ত যুদ্ধের সূচনা করেছিল, যাতে তার সঙ্গী ছিল পশ্চিমা মিত্ররা। সাম্প্রতিক সময়ে এ নীতি থেকে সরে এলেও তাদের মুসলমান বিদ্বেষ রয়েই গেছে। নানা ছুঁতোয় মুসলমানদের উপর হামলা ও হত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। ইসলামো ফোবিয়া বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়ে তারা ইসলামের বিরুদ্ধে যে অনন্ত যুদ্ধের সূচনা করেছিল, তাতে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়ার মতো সমৃদ্ধ দেশ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। নির্বিচারে লাখ লাখ মুসলমান হত্যা ও উদ্বাস্তুতে পরিণত করেছে তারা। তারা যুদ্ধের কনভেশন মানেনি। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল মুসলমান হত্যা ও সম্পদ লুট করা। একশ্রেণীর বিভ্রান্ত মুসলমানদের দিয়ে আইএসসহ বিভিন্ন সংগঠন তৈরি করে এবং তাদেরকে দমনের নামে দেশগুলোতে হামলা চালিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র নিজে টুইন টাওয়ার ধ্বংস করে ইসলামকে সন্ত্রাসবাদ আখ্যা দিয়ে তা দমনে যুগের পর যুগ যুদ্ধ চালিয়ে যায়। এখন ইসরাইলকে দিয়ে গাজায় সাধারণ মানুষকে হত্যার মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, যখনই যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাবিশ্ব মুসলমানদের অপবাদ দিয়ে হামলা চালিয়ে দেশ ধ্বংস ও লাখ লাখ মুসলমান হত্যা করছে, তার বিরুদ্ধে ওআইসি এবং মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলমান দেশগুলো অতি মৃদু প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাবিশ্বের বিরুদ্ধে পাল্টা কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। যুদ্ধ করে নয়, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে যদি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিত, তাহলে মুসলমানদের এই দুর্দশায় পড়তে হতো না। ইরানে ইসরাইলের হামলার পর সউদী আরব গাজায় ইসরাইলের নৃশংসতার পাশাপাশি ইরানে আগ্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে দেশটি এই হামলাকে আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতির ¯পষ্ট লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছে। এ ধরনের বিবৃতি যে, লিপসার্ভিস বা শুধু প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য দেয়া, তা বলাই বাহুল্য। অতীতে ওআইসি ও প্রভাবশালী মুসলমান দেশগুলোকে এ ধরনের বিবৃতি দিতে দেখা গেছে। তাতে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাবিশ্বের কিছুই হয়নি। তাদের মুসলমান নিধন মিশন বন্ধ হয়নি। অথচ ওআইসি ও প্রভাবশালী মুসলমান দেশগুলোর উচিৎ, ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় এমন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া যাতে তারা নিবৃত্ত হতে বাধ্য হয়। মুসলামনদের হত্যার চিন্তা করতে না পারে। মুসলিম বিশ্বের মধ্যে এই ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধের অভাবের কারণেই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা একের পর এক হামলা চালিয়ে যাওয়ার সাহস দেখাতে পারছে।
আত্মরক্ষার উসিলায় ইসরাইল আগ বাড়িয়ে ইরানে যে হামলা চালিয়েছে, একইভাবে ইরানেরও আত্মরক্ষায় হামলা চালাতে পারে। তবে যুদ্ধ কখনো শান্তি বয়ে আনে না। বিশ্বের এক প্রান্তে যুদ্ধ লাগলে তার প্রভাব পুরো বিশ্বেই পড়ে। এ থেকে কেউই বাদ যায় না। ইসরাইল-ইরানের পাল্টাপাল্টি হামলা পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে যেমন অস্থিতিশীল করে তুলেছে, তেমনি যুদ্ধ পুরোপুরি লেগে গেলে তা ধ্বংস করে দেবে। এমন পরিস্থিতি কারো জন্যই ভালো হবে না। হামলা-পাল্টা হামলার মাধ্যমে স্থায়ী যুদ্ধ লাগার আগেই যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাবিশ্ব, জাতিসংঘ, ওআইসি এবং মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশসহ মুসলিম বিশ্বকে জরুরি ভিত্তিতে তা থামানোর উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে পাশ কাটানো বা দায় এড়ানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না। ওআইসি ও মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এর প্রতিবাদ ও প্রতিকারের জোরালো ভূমিকা নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও পশ্চিমা প্রভাবশালী দেশগুলোকে এ হামলা-পাল্টা হামলার রাস টেনে ধরতে হবে।