ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে যে সংঘাত শুরু হয়েছে তার অবসান কখন, কীভাবে ঘটবে তা বলা মুশকিল। যেভাবে দেশ দুটি একে অন্যের প্রতি হামলা চালিয়ে যাচ্ছে তা কল্পনাতীত। ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা চলছে। এতে ইরানে ছয় শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে বলে জানা যায়। তাদের মধ্যে দেশটির সামরিক বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের বেশ কয়েকজন সদস্যও রয়েছেন। এছাড়া রয়েছেন বেশ কয়েকজন বড় বড় পরমাণু বিজ্ঞানী। ইরান ইসরাইলের হামলায় এমনভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, যা দেশটি এর আগে কখনো দেখেনি। ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র তেলআবিব ও হাইফার মতো বড় শহরে ভয়াবহ ক্ষতি সাধন করেছে। গ্যালিলি, বাত ইয়াম শহরেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। নিহতের খবরও সামনে আসছে। এখন একদিকে অস্ত্রের যুদ্ধ, আর অন্যদিকে চলছে তথ্যযুদ্ধ। দুই পক্ষই প্রচারণার অংশ হিসেবে তথ্য গোপন করছে। ফলে কারা কোথায় আঘাত করেছে, কতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা নির্ভরযোগ্যভাবে জানা যাচ্ছে না। একইভাবে অজানা থেকে গেছে উভয় দেশের অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্রের মজুত কতটুকু রয়েছে এবং তারা কতদিন এ যুদ্ধ অব্যাহতভাবে চালিয়ে যেতে পারবে। জানা যায়, ইরান বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ক্ষেপণাস্ত্রের অধিকারী দেশ। তার সামরিক শক্তি ও সমরাস্ত্রের জোর অনেক বেশি। তার হাতে কয়েক হাজার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যেগুলোর পাল্লা ও গতি ভিন্ন ভিন্ন। এসব ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইরান আরও কয়েক সপ্তাহ ইসরাইলে আঘাত হানতে সক্ষম, যা ইসরাইলিদের জন্য হতে পারে এক ভীতিকর অভিজ্ঞতা। হতে পারে ইসরাইলের ধ্বংসের বড় উদাহরণ। কারণ, তারা এতদিন কেবল গাজা, লেবানন বা ইয়েমেন থেকে সীমিত শক্তির ক্ষেপণাস্ত্র বা রকেটে হামলার মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু ইরান অসাধারণ শক্তিশালী প্রযুক্তির ক্ষেপণাস্ত্রের অধিকারী। ইরান এবার তার সেই উন্নত প্রযুক্তির ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের ক্ষমতাও প্রদর্শন করেছে। ইসরাইলের ওপর প্রথমবারের মতো ‘হাজ কাসেম’ নামের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহৃত হয়, যা ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়। এর গতি ও ধ্বংসক্ষমতা পূর্বে ব্যবহৃত ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর চেয়ে অনেক বেশি।
তবে অনেকেই বলছেন, ইরানের এসব উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র সীমিত পরিমাণে আছে। ফলে এদের ব্যবহারে কৌশলগত সংযমশীলতা বজায় রাখা জরুরি। অবশ্য প্রচুর সংখ্যক সাধারণ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন থাকায় ইরান এখনো উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি করতে সক্ষম এবং এ যুদ্ধে টিকে থাকার মতো শক্তি তার রয়েছে, যা অনেকেই ধারণা করেননি। ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা তজাচি হানেগবি স্বীকার করেছেন, তাদের অনুমানের চেয়ে বেশি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে ইরানের হাতে। ইসরাইলি আর্মি রেডিওতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, এই বাস্তবতা ইরানের হুমকি মোকাবেলা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারবে কিনা সে বিষয়ে ইসরাইল আশঙ্কা করছে। তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদে এই লড়াইয়ের মাধ্যমে ইরানের হুমকি দূর করা সম্ভব নয়। ইসরাইলের অনুমান ছিল, ইরানের হাতে দেড় থেকে দুই হাজারের মতো ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র থাকতে পারে। এখন তাদের ধারণা পাল্টে যাচ্ছে। ১৩ ও ১৪ জুন ইরান ইসরাইলের দিকে দুই শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে, যার অনেকগুলো ইসরাইলের বিখ্যাত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে ঢুকে পড়ে। ইসরাইলের আয়রন ডোম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় চরমভাবে চাপে রয়েছে। তবে ইসরাইল তার প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করছে, যে কিনা কিছু হামলা প্রতিহত করতে সাহায্য করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অবশ্য ঘোষণা দিয়েছেন, তার দেশ এই যুদ্ধে সরাসরি জড়িত নয়। তবে তিনি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, যদি ইরান যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ঘাঁটি বা স্বার্থে আঘাত হানে, তবে চড়া মূল্য দিতে হবে।
কানাডায় জি-৭ সম্মেলনে যাওয়ার আগে রোববার ১৫ জুন ট্রাম্প হোয়াইট হাউসের বাইরে কথা বলতে গিয়ে আরও জানান, ‘আমি মনে করি সমঝোতার ভালো সম্ভাবনা আছে। ইরানের সঙ্গে আমাদের খুব ভালো সম্পর্ক বিদ্যমান।’ তিনি মনে করেন, ‘ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে পরস্পরের প্রতি যথেষ্ট সম্মান আছে।’ ওদিকে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি দাবি করেন, ইসরাইলের সামরিক অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা ও ঘাঁটিগুলোর সরাসরি সহযোগিতার অনেক প্রমাণ তেহরানের কাছে রয়েছে। বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি বলেন, আমাদের কাছে জোরালো প্রমাণ রয়েছে যে, এই অঞ্চলে থাকা মার্কিন বাহিনী ও ঘাঁটিগুলো ইসরাইলের হামলায় সহায়তা করেছে।
ইরানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে আক্রমণ করা সর্বশেষ বিকল্প, যা তারা এড়িয়ে চলতে চায়। দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি সবসময়ই তুলনামূলকভাবে সংযত পন্থা অনুসরণ করেছেন। তিনি চান না, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে যাক বা তাদের ওপর হামলার অজুহাত পেয়ে যাক। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল মিলে একযোগে হামলা চালালে ইরানের সবচেয়ে সুরক্ষিত পরমাণু স্থাপনাগুলো ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এতে ইসরাইলের অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক ঘাঁটিগুলোর মাধ্যমে এমন হামলা হতে পারে, যেগুলো কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব ও তুরস্কের মতো দেশগুলো থেকে পরিচালিত হবে, যারা ইরানের শত্রু নয় এবং যাদের সঙ্গে ইরানের কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। ফলে এসব দেশকে যুদ্ধে জড়াতে ইরান চাইবে না।
ইরানের হাতে আরও একটি প্রভাবশালী বিকল্প রয়েছে, তা হলো হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়া। এই প্রণালী দিয়ে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণে তেল পরিবহন হয়। যদি ইরান তা সাময়িক বন্ধ করে দেয়, তবে তেলের দাম অনেক বেড়ে যাবে। ইতোমধ্যে তেলের দাম বেড়েছে এবং তা কয়েকশ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। তবে সবশেষ কথা হলো, ইরান যুদ্ধ থামাতে চায়। কারণ, এই সংঘাত আরও বড় আকার ধারণ করে আঞ্চলিক যুদ্ধে পরিণত হতে পারে। এতে ইরানের অর্থনীতি ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং দেশে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। ইসরাইলও যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে না দীর্ঘদিন ধরে। কারণ তার সক্ষমতাও তেমন নেই।
ইরান ইতোমধ্যে জানিয়েছে, ইসরাইল হামলা বন্ধ করলে সেও প্রতিক্রিয়া জানানো বন্ধ করবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারমাণবিক আলোচনায় ফিরতে প্রস্তুত রয়েছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি বলেছেন, ইসরাইলের হামলা বন্ধ হলেই আমরাও স্বাভাবিকভাবে প্রতিক্রিয়া দেখানো বন্ধ করব। ইরানের পক্ষ থেকে বারবার এ কথাই সামনে আসছে। তবে বিষয়টি নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার অস্থির নেতৃত্বের ওপর। ট্রাম্প কখনো ইসরাইলকে শান্ত থাকার আহ্বান জানাচ্ছেন, আবার কখনো ইরানকে হুমকি দিচ্ছেন। ইরান জানে, ট্রাম্পকে বিশ্বাস করা কঠিন। ইসরাইল আক্রমণের আগে যুক্তরাষ্ট্র তেহরানকে বুঝিয়েছে, পারমাণবিক আলোচনা হবে, যা ছিল একটি প্রতারণামূলক চাল। আসলে ইসরাইল তো সবসময় প্রতারণামূলক কাজে বিশ্বাসী। প্রতারণার মাধ্যমে সে বিশ্ববাসীকে যুক্তরাষ্ট্রের জুজুর ভয় দেখাতে চায়। মুসলমানদের অপাংক্তেয় মনে করতে চায়। কিন্তু ইসরাইলের এ অশুভ পরিকল্পনা তার নিজের ওপরই পড়বে বলে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকগণ মনে করছেন। তারপরও, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হওয়া কোনো চুক্তিই আপাতত ইরানের জন্য সবচেয়ে সম্ভাব্য ও কার্যকর পথ, যার মাধ্যমে ইসরাইলের হামলা বন্ধ করানো এবং যুদ্ধের ইতি টানা সম্ভব। কারণ, যুদ্ধের শুরুর ধাপে ইরান তার শক্তির প্রমাণ দেখিয়েছে, তবে দীর্ঘমেয়াদে এই যুদ্ধ ধরে রাখা তার জন্য কঠিন হবে। আবার ইসরাইলের পক্ষেও ইরানকে মোকাবেলা করা সত্যিকার অর্থে কঠিন। তাই ইরান-ইসরাইলের মধ্যে চলমান সংঘাতের পরিণতি কোন দিকে মোড় নেবে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তবে এহেন সংঘাতময় পরিস্থিতিতে ইরানের পাশে দাঁড়ানো মধ্যপ্রাচ্যসহ গোটা মুসলিম উম্মাহর অপরিহার্য দায়িত্ব।
লেখক: শিক্ষাবিদ গবেষক ও কলামিস্ট।