হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবভূগোলবিদ ক্যামিলো মোরা এবং তাঁর সহকর্মীগণ পৃথিবীতে জীবিত প্রাণির সংখ্যা নির্ধারণ করার জন্য একটি গবেষণা পরিচালনা করেছিলেন। ‘হাউ মেনি স্পিশিজ আর দেয়ার অন আর্থ অ্যান্ড ইন দ্য ওশান?’ শিরোনামে ২০১১ সালে পিএলওএস বায়োলজি জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধে তাঁরা উল্লেখ করেন, পৃথিবীতে প্রায় ৮৭ লক্ষ প্রজাতি রয়েছে, যার মধ্যে ৬৫ লক্ষ প্রজাতি স্থলভাগে এবং ২২ লক্ষ প্রজাতি সমুদ্র ও জলজ পরিবেশে বসবাস করে। প্রবন্ধটিতে আরো উল্লেখ করা হয় যে, প্রায় ৮৬ শতাংশ স্থলজ এবং ৯১ শতাংশ সামুদ্রিক প্রজাতির বিবরণ দিতে তারা সক্ষম হননি। উন্নত প্রযুক্তি ও গবেষণার মাধ্যমে এই গবেষণা আরো সমৃদ্ধ হতে পারে বলে তারা মতামত ব্যক্ত করেন।
মহাবিশ্বের তুলনায় প্রায় অস্তিত্বহীন একটি বামন ছায়াপথের খুবই সাধারণ এক সৌরজগতের মাঝামাঝি শ্রেণির একটি গ্রহের নাম পৃথিবী। এই পৃথিবী নামক গ্রহে অসংখ্য সৃষ্টির মধ্যে জীবজগত, সেই জীবজগতের ক্ষুদ্র একটি অংশ আবিষ্কৃত হয়েছে, যার ৮৭ লক্ষ ভাগের এক ভাগ আমরা, এই মানব জাতি। আর কোনো প্রজাতির সন্ধান না পাওয়া গেলেও, অথবা যদি ধরেও নিই গবেষণার ঐ ফলাফলই চূড়ান্ত, তবে মানুষ ছাড়াও শুধু পৃথিবীতে আরো প্রায় ৮৬ লক্ষ ৯৯ হাজার নয়শো নিরানব্বই প্রকার প্রজাতি রয়েছে।
জীববিজ্ঞানের গবেষণায় মানুষের গঠন নিয়ে যে আলোচনা রয়েছে, সে অনুসারে মানুষ গঠিত হয়েছে অসংখ্য কোষের সমন্বয়ে। ২০১৩ সালে অ্যানালস্ অব হিউম্যান বায়োলজি নামক একটি জার্নালে ইভা বিয়ানকোনি ও তাঁর গবেষকদলের একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, যার নাম ‘অ্যান এস্টিমেশন অব দ্য নাম্বার অব সেলস্ ইন দ্য হিউম্যান বডি’। এই প্রবন্ধে গবেষকগণ উল্লেখ করেন একটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দেহ গঠিত হয় প্রায় ৩৭.২ ট্রিলিয়ন কোষের সমন্বয়ে। জীববিজ্ঞানের সূত্রমতে প্রতিটি কোষ গঠিত হয় সাধারণত নিউক্লিয়াস, সাইটোপ্লাজম, মাইট্রোকন্ড্রিয়া, রাইবোজম, সেল মেমব্রেনসহ অন্যান্য উপাদান নিয়ে। মানব জীবনের সূচনা হয় একটি জাইগোট থেকে, যেটি শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলনে তৈরি একটি একক কোষ। এই একটিমাত্র কোষ থেকে শুরু মানুষের জীবনের গল্প। আস্তে আস্তে বিভাজিত হতে হতে একটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষে পরিণত হওয়ার সময় এই কোষের পরিমাণ পৌঁছে ৩৭.২ ট্রিলিয়নে। প্রতিটি কোষের উপাদানগুলোর মধ্যে নিউক্লিয়াস থাকে, এই নিউক্লিয়াস ডিএনএ ধারণ করে। আর ডিএনএ কোষের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। প্রতিটি ডিএনএতে দুই কপি জিনোম থাকে, যার প্রত্যেক কপিতে রয়েছে ৩.২ বিলিয়ন বেস পেয়ার বা বর্ণ। অর্থাৎ, প্রতিটি ডিএনএ ৬.৪ বিলিয়ন বেস পেয়ার ধারণ করে। সেই হিসেবে প্রতিটি পূর্ণাঙ্গ মানবদেহে গড়ে ৬.৪ বিলিয়ন গুণন ৩৭.২ ট্রিলিয়ন বেস পেয়ার বা বর্ণ রয়েছে। প্রশ্ন জাগতে পারে, এই অসংখ্য পরিমাণ বেস পেয়ার দিয়ে আসলে হয়টা কী? এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, মহাবিশ্বের মহান অধিপতি কোনো কিছুই প্রয়োজন ছাড়া সৃষ্টি করেননি (আল-কুরআন: সুরা-৩৮, আয়াত-২৭)। মানব শরীরে যে অসংখ্য বেস পেয়ার রয়েছে তার একটিও পরিবর্তন হয়ে গেলে ঘটতে পারে মহা বিপর্যয়। একটি বেসের পরিবর্তন বা অনুপস্থিতি হলে ভুল অ্যামিনো অ্যাসিড তৈরি হতে পারে, যা প্রোটিনের গঠন ও কার্যক্ষমতা নষ্ট করে দিতে পারে। ফলে ঘটে নানান রকম শারীরিক অসঙ্গতি ও রোগ-শোক। শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলনে সৃষ্টি একক কোষের মাধ্যমে মানব জীবনের সূচনা হওয়ার পর কোষ বিভাজনের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ কোষের জন্ম হতে থাকে। একই ধরনের বিভন্ন প্রকার কোষ একত্রিত হয়ে যখন অভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে তখন কোষের এই জোট গঠনকে বলা হয় টিস্যু। যেমন রক্ত, স্নায়ু, পেশী। এই টিস্যুগুলো আবার একত্রে গঠন করে অঙ্গসমূহ, যেমন, হৃদপি-, ফুসফুস, যকৃত, বৃক্ক ইত্যাদি। অঙ্গগুলো নির্দিষ্ট কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য একত্রে কাজ করে অঙ্গতন্ত্র গঠন করে, যেমন, রক্ত সঞ্চালন তন্ত্র, শ্বাসতন্ত্র, হজমতন্ত্র, স্নায়ুতন্ত্র ও প্রজননতন্ত্র। মানবদেহের কঙ্কালতন্ত্র শরীরকে কাঠামোগত দৃঢ়তা প্রদান করে এবং পেশিতন্ত্রের সহায়তায় চলাচল সম্ভব করে তোলে। স্নায়ুতন্ত্র ও মস্তিষ্ক দেহের যাবতীয় কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে, আর রক্ত ও লসিকা তরল পদার্থ পরিবহন করে কোষে পুষ্টি ও অক্সিজেন পৌঁছে দেয়। এই সমন্বিত কাঠামো ও কার্যপ্রণালী মানবদেহকে একটি সুসংহত ও কার্যকর জীব হিসেবে গঠন করে, যার প্রতিটি অংশ নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করে জীবনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে। রহস্যে ঘেরা মানুষের এই দেহাবয়বে আরেকটি উল্লেখযোগ্য রহস্য হচ্ছে তার স্নায়ু ও মস্তিস্ক। এর মাধ্যমেই মানুষ জগতের অন্যান্য প্রাণি থেকে আলাদা।
মানব মস্তিষ্ক, তিন পাউন্ডের এক জৈবিক অলৌকিকতা, যা জাগতিক বাস্তবতা ও কল্পনার সীমান্তে দাঁড়িয়ে আমাদের অস্তিত্বের ব্যাখ্যা রচনা করে। ২০২৫ সালের মার্চ মাসে ব্রেইন নামক জার্নালে প্রকাশিত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলজিয়ান অধ্যাপক আলাঁ গোরিয়েলির ‘এইটি-সিক্স বিলিয়ন অ্যান্ড কাউন্টিং: ডু উই নো দ্য নাম্বার অব নিউরনস ইন দ্য হিউম্যান ব্রেইন?’ শিরোনামীয় প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, মানব মস্তিস্কের ভেতরে রয়েছে প্রায় ৮৮ বিলিয়ন নিউরন। প্রতিটি নিউরন যেন একেকটি তারার মতো, আলো ছড়ায় ও সংযোগ গড়ে তোলে। তিন পাউন্ড মস্তিস্কে ৮৮ বিলিয়ন নিউরন, এটাই বিস্ময়ের শেষ নয়, প্রতিটি নিউরন আবার দশ হাজারের বেশি স্ন্যাপস দিয়ে অন্য আরেকটি নিউরনের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। এ যেন এক মহাজাগতিক কথোপকথন, যা আমাদের চিন্তা, স্মৃতি, অনুভূতি, স্বপ্ন ও সৃষ্টিশীলতার ভিত্তি। এই স্নায়বিক জালিকাটি এতই জটিল, যেন এক অদৃশ্য মহাবিশ্ব, যার প্রতিটি কোষে লুকিয়ে আছে একেকটি গল্প, একেকটি সম্ভাবনা। যখন আমরা একটি কবিতা পড়ি, একটি গান শুনি বা একটি শিশুর মুখে হাসি দেখি, এই নিউরনগুলোই সেই অনুভূতির ভাষা রচনা করে। তারা শুধু তথ্য বহন করে না, তারা অভিজ্ঞতা বুনে দেয়, স্মৃতি গেঁথে রাখে এবং স্বপ্নের রঙ তৈরি করে। মস্তিষ্কের এই জৈবিক জটিলতা যেন এক আত্মজ মহাবিশ্ব, যেখানে প্রতিটি স্ন্যাপস একটি আলোকবর্ষের দূরত্বে থাকা ভাবনার মতো। আমরা যখন ভাবি, অনুভব করি, সৃষ্টি করি, তখন এই স্নায়বিক মহাবিশ্বে তড়িৎ ও রাসায়নিক সুর বাজে, যা আমাদের অস্তিত্বকে সুরভিত করে তোলে।
৮৭ লক্ষ প্রাণির জীবনের রহস্য এমনই কিনা বা এর চেয়ে রহস্যজনক কিনা সেকথা কেউ জানে না। এমনই রহস্যে ঘেরা মহান সৃষ্টকর্তার সবকিছুতেই, ক্ষুদ্র সৃষ্টি যা আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না, আবার বৃহৎ সৃষ্টি যেগুলোও পূর্ণরূপে চোখে দেখা বা ধারণা করা সম্ভব হয় না। সৃষ্টির খুব ছোট্ট একটা স্থানে আমাদের বাস। পৃথিবী নামে এই গ্রহেই যে রহস্য লুকিয়ে আছে তার খুব কম জটই মানুষ উন্মুক্ত করতে পেরেছে। যে পৃথিবীতে আমরা বসবাস করি, তা মহাবিশ্বের মানচিত্রে একটি বিন্দুরও কম, একটি ক্ষুদ্র গ্রহ, যা সূর্যের চারপাশে ঘূর্ণায়মান। অথচ এই সূর্য নিজেই একটি সাধারণ নক্ষত্র, যার চারপাশে ঘুরছে বৃহস্পতি, শনির মতো দৈত্যাকার গ্রহ এবং আরও অগণিত মহাজাগতিক বস্তু। এই সৌরজগতের সীমা ছাড়িয়ে, শত শত আলোকবর্ষ দূরে রয়েছে আরও অসংখ্য সৌরজগৎ, যাদের অস্তিত্ব আমাদের কল্পনার পরিধিকে চূর্ণ করে দেয়। এই অসংখ্য সৌরজগতের সমাহারে গঠিত আমাদের ছায়াপথÑ মিল্কি ওয়ে, যা মহাবিশ্বের অন্যান্য ছায়াপথের তুলনায় এক বামন ছায়াপথ মাত্র। বিজ্ঞানীরা বলেন, মহাবিশ্বে ছায়াপথের সংখ্যা এত যে, তা পৃথিবীর সমুদ্রপৃষ্ঠের বালুকণার চেয়েও বেশি। নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্রিস্টোফার কনসেলিস ২০১৬ সালে রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটিতে প্রকাশিত ‘দ্য ইউনিভার্স হ্যাজ টেন টাইমস মোর গ্যালাক্সিস দ্যান প্রিভিয়াসলি থট’ নামক আর্টিকেলে এমনটিই দাবি করেন। প্রতিটি ছায়াপথে রয়েছে শত শত বিলিয়ন নক্ষত্র, প্রতিটি নক্ষত্রের চারপাশে সম্ভাব্য গ্রহম-ল এবং প্রতিটি গ্রহে হয়তো লুকিয়ে আছে প্রাণের সম্ভাবনা, ইতিহাসের সম্ভাবনা, এমনকি সৃষ্টির নতুন ব্যাখ্যা। এই মহাবিশ্বের বিস্তৃতি এমন যে, এক আলোকবর্ষের দূরত্ব পাড়ি দিতে আমাদের বর্তমান প্রযুক্তিতে লাগবে হাজার হাজার বছর। অথচ এই আলোকবর্ষের মাপকাঠিতে মহাবিশ্বের দূরত্ব পরিমাপ করা হয় লক্ষ, কোটি, বিলিয়ন এককে। এই বিশালতা শুধু পদার্থের নয়, এটি ভাবনার, সম্ভাবনার এবং সৃষ্টির বিশালতা।
মহাগ্রন্থ আল-কুরআন এভাবে বর্ণনা করেছে, ‘বল, সমুদ্রগুলো যদি আমার প্রতিপালকের কথা লেখার জন্য কালি হয়ে যায়, তবে আমার প্রতিপালকের কথা লেখা শেষ হওয়ার আগেই সমুদ্র অবশ্যই নিঃশেষ হয়ে যাবে, আমি যদি এর সাহায্যের জন্য আরো অনুরূপ পরিমাণ সমুদ্র নিয়ে আসি তবুও’ (সুরা-১৮, আয়াত-১০৯)।’ পবিত্র আল-কুরআনের উক্ত আয়াত নিছক সাহিত্যিক বা আলঙ্কারিক শব্দ প্রয়োগের একটি দৃষ্টান্ত নয় আদতে এটি তা কখনও করে না, বরং অন্যান্য আয়াতের মতো এটিও বিজ্ঞানের ভিতের উপর প্রতিষ্ঠত এক বাস্তবতা। আসলেই তো এত সাগর, মহাসাগরই বা কোথায়, আর সেগুলো এত পানিই বা কোথায় পাবে, যা ক্ষুদ্র কোষ থেকে শুরু করে অন্তহীন মহাকাশের পরতে পরতে লেগে থাকা মহান করুণাময়ের মহত্ত্বের কথা বর্ণনা করে শেষ করতে পারবে?
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রামদিয়া সরকারি শ্রীকৃষ্ণ কলেজ।