আরো আলোচনার পর বাংলাদেশ কিছুই না পেলে উচ্চ শুল্ক নিয়েই এগোতে হবে। এতে তৈরি পোশাক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শুধু একটি পণ্য ও নির্দিষ্ট কয়েকটি বাজারের ওপর নির্ভর করলে কেমন ধাক্কা আসে তা এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
ড. ফাহমিদা খাতুন, বাংলাদেশের অন্যতম আর্থ-উন্নয়নবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হিসেবেও কাজ করছেন তিনি। এছাড়া তিনি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য। বাংলাদেশী পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শুল্ক আরোপের নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তায়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাবরিনা স্বর্ণা
উচ্চহারের শুল্ক তিন মাস স্থগিতের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশী পণ্যে ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক নির্ধারণ করেছে। এর ফলাফল কী হতে যাচ্ছে?
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশী পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছেন। নতুন শুল্কহার ঘোষণা করে তিনি বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশকে সোমবার চিঠি দিয়েছেন। এ শুল্কহার ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আগেই বিদ্যমান ১৫ শতাংশ শুল্কহারের সঙ্গে যদি নতুন শুল্ক যুক্ত হয়, তাহলে সেটি দাঁড়াবে ৫০ শতাংশে। যেখানে ১৫ শতাংশ থেকে শুল্কহার ৩৫ শতাংশে উন্নীত করাটাই অনেক বেশি, সেখানে সেটি ৫০ শতাংশ হলে বড় ধাক্কা পাবে দেশের রফতানি পণ্য। বিশেষত আমাদের তৈরি পোশাক রফতানি খাত। এতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাবে।
তৈরি পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলোর জন্য নতুন শুল্কহার নির্ধারণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যেমন তৈরি পোশাক রফতানিতে প্রতিযোগী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম ভিয়েতনাম। এ দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করা হয়েছে ২০ শতাংশ। বাংলাদেশের ওপর আরোপিত শুল্কহারের তুলনায় এটি ১৫ শতাংশ কম। এতে ভিয়েতনামের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা আমাদের চেয়ে বেড়ে যাবে। এছাড়া ভারতও এক্ষেত্রে প্রতিযোগী দেশগুলোর একটি। ভারতের জন্য শুল্কহার কত শতাংশ নির্ধারণ করা হবে তা এখনো জানা যায়নি। তবে এর আগে এ বছরের এপ্রিলে ভারতের ওপর পাল্টা শুল্ক ২৬ শতাংশ নির্ধারণ করেছিল। যেটি আমাদের চেয়ে অনেক কম। অর্থাৎ এখানেও আমাদের প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতা কমে যাবে। ভারত এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিনি বাণিজ্য চুক্তি করতে যাচ্ছে। সেখানে শুল্ক আরো কমতে পারে। তাহলে বাংলাদেশের তুলনায় তাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা আরো বাড়বে। সারকথা, উচ্চহারের শুল্ক তিন মাস স্থগিতের পর এখন বাংলাদেশী পণ্যে ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা গুরুতর দুঃসংবাদ। কারণ এর প্রভাব কেবল রফতানি আয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। রফতানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে; পাশাপাশি সামগ্রিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। ব্যাংকিং ও ইন্স্যুরেন্স সেবা, পরিবহন খাত, কর্মসংস্থান এবং আয় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অর্থাৎ রফতানি পণ্যে উচ্চ শুল্কের প্রভাব যে বহুমাত্রিক ও গুরুতর হবে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকার এখন কী করতে পারে?
এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে প্রথমত নতুন শুল্কহার আগামী ১ আগস্ট কার্যকর হওয়ার আগ পর্যন্ত নীতিনির্ধারকদের কূটনৈতিক আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে, যাতে শুল্কহার যতটা সম্ভব কমিয়ে আনা যায়। যদিও এ নিয়ে আলোচনার জন্য আমরা তিন মাস সময় পেয়েছিলাম। কিন্তু এ তিন মাসে আলোচনা যে ফলপ্রসূ হয়নি সেটি বর্তমানে স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র মাত্র ২ শতাংশ কমিয়ে শুল্কহার ৩৫ শতাংশ করেছে। অথচ ভিয়েতনাম কার্যকরী আলোচনা করে এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানীকৃত পণ্যে তাদের দেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে শুল্ক ছাড় দিয়ে তাদের নিজেদের ওপর আরোপিত পাল্টা শুল্কহার ২০ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। আমরা তিন মাস সময় পেয়েও এমন কিছু করতে পারিনি।
আমাদের উচিত ছিল সব পক্ষের সঙ্গে বিশেষ করে রফতানিকারকদের সঙ্গে আরো গভীর আলোচনা করে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে যেসব পণ্য আমদানি করে সেগুলোর শুল্কহার উল্লেখ করে একটি তালিকা তৈরি করা। কিন্তু বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা গেছে সরকার থেকে এসব পণ্যের তালিকা পাঠানো হয়নি। আমাদের চলতি অর্থবছরের বাজেটে ১০০টি পণ্যের ওপর করছাড় দেয়া হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় হলো এতে যুক্তরাষ্ট্র কী ভাবছে—১০০টি পণ্যে কর বা শুল্কছাড়ে তাদের লাভ হলো কিনা। অবশ্য শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তরের (ইউএসটিআর) বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে এখনো আলোচনা চলছে। তবে এক্ষেত্রে এ আলোচনায় রফতানি বাণিজ্যের অংশীজনদের অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। তারা অনেকেই বলছেন তাদেরকে অন্ধকারে রাখা হয়েছে। কিন্তু বলার অপেক্ষা রাখে না যে এ ধরনের জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে মূল অংশীজনদের দূরে রাখা সঠিক নয়।
শুল্ক চুক্তির ক্ষেত্রে কিছু শর্তের কথাও উঠে এসেছে...
চুক্তির শর্তগুলো জনসম্মুখে আসেনি। তাই সেগুলো নিয়ে মন্তব্য করা যাচ্ছে না। তবে বাংলাদেশ পৃথিবীতে একা বসবাস করে না। পৃথিবীর কোনো দেশই এককভাবে বসবাস করে না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সঙ্গেও সম্পর্ক রাখতে হয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আইন এবং নিয়ম মেনে চলতে হয়। বাংলাদেশও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারণী প্রতিষ্ঠানের সদস্য। যেমন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সদস্য বাংলাদেশ। ডব্লিউটিওর সদস্য হয়ে বাংলাদেশ নিয়মকানুনের বাইরে গিয়ে পদক্ষেপ নিতে পারে না। তাহলে নীতি উপেক্ষা করা হবে। বড় ক্ষমতাধর দেশগুলো অনেক কিছু উপেক্ষা করতে পারে। কিন্তু ক্ষুদ্র দেশ তা পারে না। বাংলাদেশকে তাই একটা সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এখানে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো দেশের স্বার্থ রক্ষা করা।
একদিকে উচ্চ শুল্কহার কমানোর চেষ্টা, অন্যদিকে শর্ত মেনে নেয়া—এমন উভয় সংকটে পড়লে কী করা উচিত হবে বলে মনে করছেন?
অর্থনীতিকে রাজনীতি থেকে আলাদা করা যায় না। ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কের ভূরাজনৈতিক দিক রয়েছে। বাণিজ্যের বিষয়ে ভূরাজনৈতিক দিক থাকার কারণে বিভিন্ন দেশ সেটির অংশ হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে একটি ছোট অংশীজন। ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশ কেবল অংশীজনই নয়, বাংলাদেশকে বরং ব্যবহার করা হয়। সেই ভূরাজনৈতিক সমীকরণে বাংলাদেশ ঢুকে যাবে কিনা সেটি চিন্তার বিষয়। কারণ সেই রাজনৈতিক জালে আটকে গেলে তা সামলে নেয়ার সক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। সেজন্য ভূরাজনৈতিক সমীকরণে না জড়িয়ে শুধু অর্থনৈতিক এবং শুল্কের মধ্যেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখা উচিত।
শুল্ক ছাড়া যদি অন্যান্য শর্ত দেয়া হয়, সেগুলো পরিপালন করতে গেলে একদিকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বিনষ্ট হবে, অন্যদিকে অন্য দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সব মিলিয়ে তেমন পরিস্থিতিতে যাওয়া কারো জন্যই ভালো হবে না। বর্তমানে পারস্পরিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছাড়া কোনো দেশ চলতে পারে না। বাণিজ্য ছাড়া এককভাবে কোনো দেশ অগ্রগতি অর্জন করতে পারে না। বাণিজ্য সব দেশকে করতে হবে। বাণিজ্যের নিয়ম হচ্ছে, যে দেশ যে পণ্য উৎপাদনে ভালো, সেই দেশ সেই পণ্য উৎপাদন করবে এবং অন্য দেশ তা কিনবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভূরাজনৈতিক সমীকরণ এমন হয়ে উঠেছে যে সেখানে বাণিজ্য, অর্থনৈতিক বিষয় ও নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি বিষয়কে ব্যবহার করা হয়। এ ধরনের সমীকরণে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ করা ঠিক হবে না।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পোশাক রফতানির জন্য সবচেয়ে বড় বাজার। পাল্টা শুল্ক কার্যকর হলে খাতটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ খাতের জন্য আপনার সুপারিশ কী থাকবে?
আরো আলোচনার পর বাংলাদেশ কিছুই না পেলে উচ্চ শুল্ক নিয়েই এগোতে হবে। এতে তৈরি পোশাক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শুধু একটি পণ্য ও নির্দিষ্ট কয়েকটি বাজারের ওপর নির্ভর করলে কেমন ধাক্কা আসে তা এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আমরা আগে থেকেই বলেছি, রফতানি বহুমুখীকরণ করতে হবে। শুধু রফতানি বহুমুখীকরণ নয়, বাজারের বহুমুখীকরণও জরুরি। অন্যান্য বাজার খোঁজা ও সেই বাজারের চাহিদা অনুপাতে পণ্য তৈরি করা দরকার। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজারে তৈরি পোশাক যাচ্ছে। অন্য বাজারের জন্য অন্য পণ্য তৈরি করতে হবে। লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য—এ দেশগুলোতে বাজার খুঁজতে হবে। পোশাক শিল্পের বাইরে অন্য যেসব পণ্য রয়েছে, সেগুলোর সম্ভাব্য বাজার খুঁজতে হবে। পোশাক শিল্প ছাড়াও আমাদের চামড়া শিল্প, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, ফার্মাসিউটিক্যালস ও পাটজাত পণ্য আছে। তাছাড়া আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হচ্ছে মানবসম্পদ। যখন আমরা রফতানি বহুমুখীকরণের কথা বলছি, তখন মানবসম্পদ বা সেবা বাণিজ্যের কথাও বলতে হবে। আমাদের বাণিজ্য কৌশল বদলাতে হবে। বাণিজ্যকে দুই-একটি পণ্যে সীমিত না রেখে আরো প্রসারিত করতে হবে।
নতুন রফতানিমুখী খাত ও রফতানি গন্তব্য তৈরিতে সময় লাগবে। স্বল্পমেয়াদে বাংলাদেশের সামনে কোন পথ খোলা রয়েছে?
হ্যাঁ, অন্যান্য শিল্প ও বাজার গড়ে তোলার জন্য সময় লাগবে। এ মুহূর্তে আমাদের পোশাক খাতে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো দরকার। প্রযুক্তি ও দক্ষ জনশক্তির মাধ্যমে উৎপাদন খরচ কমাতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য রফতানিতে বাড়তি ৩৫ শতাংশ শুল্ক যদি গুনতে হয়, তাহলে এখন উৎপাদন খরচ ৫ শতাংশ কমানো গেলেও সেটি মোট উৎপাদন ব্যয়ে সাশ্রয় আনবে। উৎপাদন ব্যয় বেশি হওয়ার পেছনে আমাদের এখানে নানা সমস্যা বিদ্যমান। যেমন বিদ্যুৎ খরচ বেশি, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া যায় না, রাস্তাঘাটের অবকাঠামোর মান ভালো নয়, পণ্য শিপমেন্ট ও পণ্য ছাড়াতে দেরি হয়। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং ঘুস-দুর্নীতিও বড় বাধা। যদি এসব সমস্যার সমাধান না হয় তাহলে উৎপাদন খরচ কমানো সম্ভব হবে না। তাই আমাদের মূল প্রচেষ্টা থাকতে হবে উৎপাদন খরচ কমিয়ে উৎপাদন দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা। এছাড়া সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতাও দরকার। ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল না হলে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন বাণিজ্য অংশীদারদের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করতে হবে, যাতে বাণিজ্য বাধাগুলো দূর হয়। ভিয়েতনাম বহু দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করে আমাদের তুলনায় অনেক সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা যখন মুক্ত বাণিজ্য বাড়ানোর ক্ষেত্রে ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, তাই এখন দেশগুলো নিজেদের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করে বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশকে দ্রুততার সঙ্গে এ পদক্ষেপ নিতে হবে। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বহুমুখী প্রচেষ্টা চালাতে হবে।