ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী- বিএসএফ’র গুলি ও নির্যাতনে বাংলাদেশি নিহত হওয়ার ঘটনা অব্যাহতই শুধু নয়, আরো বেড়েছে। সর্বশেষ ফেনী সীমান্তে বিএসএফ’র গুলিতে দু’জন বাংলাদেশি নিহত ও একজন আহত হয়েছে। এর আগে ১৯ জুলাই সুনামগঞ্জ সীমান্তে একজন ও দিনাজপুর সীমান্তে অপর একজন বাংলাদেশি নিহত হয়েছে। এর দু’দিন আগে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সীমান্ত থেকে তিনজন বাংলাদেশিকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে বিএসএফ। এভাবে প্রায় প্রতিমাসেই বিএসএফ’র হত্যা নির্যাতন অপহরণের শিকার হচ্ছে বাংলাদেশের সীমান্ত নাগরিকেরা। তাদের জানমালের এতটুকু নিরাপত্তা নেই। সীমান্তে বিএসএফ’র দৌরাত্ম্য অব্যাহত আছে শুরু থেকেই। তবে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই দৌরাত্ম্য বেড়েছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, ভারতের দাস হাসিনা সরকার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত হওয়ার পর সীমান্তে বিএসএফ রীতিমত বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। যতদূর জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের ১১ মাস সময়ে অন্তত ৩৪ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে বিএসএফ। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে বিএসএফ’র হাতে ২০২৪ সালে ৩০ জন এবং ২০২৩ সালে ৩১ জন নিহত হয়। গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থার তথ্য মতে, স্বৈরাচারের সাড়ে ১৫ বছরে কমপক্ষে ৬শ’ বাংলাদেশি নিহত ও ৭শ’র বেশি আহত হয়েছে। তখন অবশ্য সীমান্তে হত্যা, নির্যাতন, অপহরণ, অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে খুব কমই প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। এতে বিএসএফ ‘স্বরাজ’ পেয়ে যাচ্ছেতাই করার সুযোগ পেয়েছে। যখন তখন বাংলাদেশিদের ওপর গুলি চালিয়ে বিএসএফ সদস্যরা টাগের্ট প্রাকটিস করেছে। এখন তো সীমান্তে অস্থিরতা ও উত্তেজনা জিইয়ে রাখার জন্য পরিকল্পিতভাবেই বিএসএফ হত্যাসহ নানা রকম দুষ্কর্ম করছে। এখন বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবি আগের মতো নতজানু নয়। তবে তারা বিএসএফ’র উসকানিতে প্ররোচিত হচ্ছে না। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে বিএসএফ এত বাংলাদেশি হতাহত করলেও বিজিবি কিন্তু একটাও গুলি ছোড়েনি বা একজন ভারতীয়কেও হত্যা করেনি। এক্ষেত্রে বিজিবির সদস্যরা সংযম ও মানবিকতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। বিজিবি ক্ষেত্র বিশেষ বিএসএফ’র আগ্রাসী তৎপরতা ও অপকর্মের উচিত জবাব দিলেও সীমা অতিক্রম করছে না। এ কারণেই সীমান্ত উত্তেজনা সংঘাতে রূপ নিতে পারেনি।

বিএসএফ সীমান্তে হত্যা ও অপকর্ম জোরদার করার পাশাপাশি পুশইন কার্যক্রম শুরু করেছে, যা কয়েকমাস ধরে লাগাতার চলছে। বলা হচ্ছে, যাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া হচ্ছে, তারা ভারতে অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশি। কিন্তু ভারতের এ দাবি সঠিক নয়। এর আগেও বিভিন্ন সময় অনুপ্রবেশকারী বলে সীমান্ত দিয়ে নারী-পুরুষ-শিশুদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া হয়েছে। শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে, যাদের ঠেলে দেয়া হয়েছে, তারা বাংলাদেশি নয়, ভারতীয় নাগরিক। এবারও সে অভিজ্ঞতারই পুনরাবৃত্তি লক্ষ করা যাচ্ছে। যাদের ঠেলে দেয়া হয়েছে বা হচ্ছে তারা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার অধিবাসী। তাদের অপরাধ, তারা মুসলমান ও বাংলাভাষাভাষী। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার রাজ্য সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশি বলে ভারতীয় নাগরিকদেরই বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। তাদের সঙ্গে কিছু রোহিঙ্গা নাগিরক শামিল আছে বলে জানা গেছে। কোনো দেশে প্রতিবেশী অন্য কোনো দেশের নাগরিকদের অনুপ্রবেশ ঘটলে, কীভাবে তাদের দেশে ফেরত পাঠাতে হবে, তার আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুন আছে। ভারত সে নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করছে না। জোর করে অথবা চোরাপথে তাদের ঠেলে দিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের তো মিয়ানমারে ঠেলে দেয়ার কথা, বাংলাদেশে কেন? জানা গেছে, চলতি বছরের ৭ মে থেকে এ পর্যন্ত দু’ হাজারের বেশি মানুষকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এই মানুষগুলোও বাংলাদেশের জন্য বোঝা ও অস্বস্তির কারণ। বাংলাদেশকে বিপাকে বা বেকায়দায় ফেলার জন্যই পুশইনের খেলা শুরু করা হয়েছে, তা বলার অপক্ষো রাখে না। ভারত কতটা অমানবিক ও নিষ্ঠুর, এ ঘটনায় তারও প্রমাণ মেলে। বাংলাদেশের বক্তব্য এক্ষেত্রে অত্যন্ত স্পষ্ট। বিভিন্ন রাজ্য থেকে জোর করে ধরে এনে সীমান্তে জড়ো করা মানুষগুলো যদি বাংলাদেশি হয়, তাদের নিতে বাংলাদেশের কোনো আপত্তি নেই। আন্তর্জাতিক রীতি-নিয়ম মেনে তাদের পাঠাতে হবে। অন্যথায় তারা গ্রহণযোগ্য হবে না। ঠেলে দেয়া মানুষগুলো যখন দাবি করছে তারা ভারতীয়, তখন বাংলাদেশ তাদের নেবে কেন? পুশইনের ঘটনা ভারতেই ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে। ভারতের বাংলাভাষী মুসলমানদের এভাবে হেনস্থা, নির্যাতন ও রাষ্ট্রহীন-নাগরিকত্বহীন করার চক্রান্ত রুখতে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ভারতীয়দেরই এগিয়ে আসতে হবে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ স্পষ্ট বলে দিয়েছে, ভারতীয় বাঙালি মুসলমানদেরই ঠেলে পাঠানো হচ্ছে বাংলাদেশে।

সীমান্তে হত্যাক-সহ নানা অপকর্ম যেমন বিএসএফ’র মাধ্যমে করা হচ্ছে, তেমনি পুশইনের কাজও তাকে দিয়েই করা হচ্ছে। সীমান্তে বিনা কারণে গুলি ছোড়া, বিষ্ফোরণ ঘটানো, ড্রোন উড়ানো ইত্যাদি উসকানিমূলক কাজও করা হচ্ছে। অবৈধ বেড়া বা বাঁধ নির্মাণ, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ, ভূমিদখলের অপচেষ্টা প্রভৃতি বেড়ে চলেছে। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি কুড়িগ্রামের দিনাহাট সীমান্তে কিশোরী ফেলানী খাতুনকে গুলি করে হত্যা করার ঘটনা বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ওই সময় হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বিএসএফকে ‘একটি ঘাতক বাহিনী’ হিসাবে অভিহিত করেছিল। বিএসএফ’র ঘাতক চরিত্র এখনো বহাল আছে। সীমান্ত হত্যার বিচার না হওয়াই এর কারণ বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। ফেলানী খাতুনদের হত্যার বিচারের নামে হয়েছে প্রহসন। হত্যাকারীর কোনো শাস্তি হয়নি। বাংলাদেশ বারবার সীমান্ত হত্যার বিচার দাবি করেছে। ভারত তাতে কর্ণপাত করেনি। শীর্ষ রাজনৈতিক পর্যায়ে সীমান্তে হত্যা বন্ধে আলোচনা হয়েছে, বিএসএফ, বিজিবি’র শীর্ষ পর্যায় থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে কত আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। সব আলোচনাতেই সিদ্ধান্ত হয়েছে শূন্য হত্যাকা- নিশ্চিত করা হবে। আজ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়নি। ভারত ইচ্ছাকৃতভাবেই সীমান্তে উত্তেজনা-অস্থিরতা বহাল রাখতে চায়। এটা সৎ প্রতিবেশীসূলভ কোনো আচরণ না। দু’দেশের পারস্পরিক সুসম্পর্ক অক্ষুণ রাখতে সীমান্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা অপরিহার্য। ভারত কতদিনে এটা উপলদ্ধি করবে, সেটাই প্রশ্ন। বাংলাদেশকে অবশ্যই সীমান্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতা, নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সর্বদা সচেষ্টা থাকতে হবে। বিজিবিকে সেভাবে আধুনিক ও নিরাপত্তসক্ষম বাহিনী হিসাবে গড়ে তুলতে হবে।

সূত্র, ইনকিলাব